রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের যীশুপূজা নিয়ে অনেকেই চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। একদিকে হিন্দুধর্মের ধ্বজাধারীদের দাবি এঁরা আদৌ হিন্দু নামের যোগ্য নন, বরং এঁরা নাকি খ্রিস্টধর্ম প্রচারে সহায়তা করছেন। অন্যদিকে আরেকদলের দাবি এই পূজা মিশনের ধান্দাবাজি ও ব্যবসায়িক মনোবৃত্তির নিদর্শন! এই দুই দাবির সারবত্তা নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক!রামকৃষ্ণের জীবনীপাঠক খুব ভালোভাবেই রামকৃষ্ণের সর্বধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতার কথা জানেন। সকল ধর্ম ও ধর্মগুরুদের উদ্দেশ্যে রামকৃষ্ণ তাঁর সশ্রদ্ধ প্রণতি জানিয়েছেন। দক্ষিণেশ্বরে তাঁর ঘরে বিভিন্ন ধর্মের ধর্মগুরুদের ছবি রাখা থাকত, তাঁর মধ্যে যীশুর ছবিও ছিল। সন্ধ্যাবেলায় তিনি এই ছবিগুলির সামনে ধূপ দিয়ে প্রণাম করতেন। কথামৃতেও যীশু ও বাইবেলের প্রসঙ্গ এসেছে। একাধিকবার তিনি তাঁর শিষ্যদের বাইবেল পড়ে শোনাতে বলেছেন, মেরীনন্দন যীশুকে প্রণাম জানিয়েছেন! অর্থাৎ স্বয়ং রামকৃষ্ণই যীশুর একনিষ্ঠ ভক্ত!
গুরুর আদর্শ শিষ্যের মধ্যেও সঞ্চারিত হয়েছে! গুরু প্রয়াত হবার পর নরেন্দ্রনাথ তাঁর তরুণ শিষ্যদের পরিচালনা করেছেন। তাঁর নেতৃত্বে আঁটপুরে ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দের ২৪শে ডিসেম্বর গভীর রাতে ধুনি জ্বালিয়ে রামকৃষ্ণের শিষ্যরা প্রতিজ্ঞা করেন, তাঁরা আর সংসারে ফিরবেন না, গুরুর আদর্শকে সামনে রেখে ত্যাগের জীবনযাপন করবেন! যীশুর শিষ্যরা যেমন তাঁদের গুরুর আদর্শ প্রচার করেছেন, তাঁরাও তেমনি গুরুর শিক্ষা জনসমাজে প্রচার করবেন! এরপর ১৮৮৭ সালের জানুয়ারি মাসে বিরজাহোমের মাধ্যমে তাঁরা সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করেন। অর্থাৎ রামকৃষ্ণ ভাবান্দোলনের সঙ্গে ২৪শে ডিসেম্বর ও যীশু অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত!
রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের আদিপর্ব বরাহনগর মঠ। রামকৃষ্ণের ষোলো-সতেরোজন শিষ্য এই ভাঙাবাড়িতে চূড়ান্ত আর্থিক অনটনের মধ্যে জীবনযাপন করতেন। এই আর্থিক দৈন্যের মধ্যেও মঠে খ্রিস্টমাস ইভ তাঁরা পালন করতেন। শুধু তাই নয়, মঠে বিভিন্ন সময় যীশুর জীবনী ও বাণী নিয়ে আলোচনা হত। মহেন্দ্রনাথ দত্ত ও স্বামী সদানন্দের স্মৃতিচারণা থেকে আমরা এইকথা জানতে পারি। প্রসঙ্গত, বরাহনগর মঠে থাকার সময় বিবেকানন্দ প্রখ্যাত খ্রিস্টসাধক টমাস ও কেম্পিসের "ইমিটেশন টু ক্রাইস্ট" গ্রন্থের অনুবাদ করতে শুরু করেন। এই আংশিক অনুবাদ "ঈশানুসরণ" নামে বিবেকানন্দ রচনাবলীতে প্রকাশিত হয়েছে। অর্থাৎ সূচনাকাল থেকেই রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন ত্যাগমূর্তি যীশুর আদর্শের প্রতি গভীরভাবে শ্রদ্ধাশীল!
পরবর্তীকালে বেলুড় মঠ প্রতিষ্ঠার পরও এই অনুষ্ঠান শ্রদ্ধাসহকারে পালিত হয়েছে। মহেন্দ্রনাথ দত্তের স্মৃতিচারণা থেকে জানা যায় স্বামী শিবানন্দ তরুণ সন্ন্যাসীদের বলেছেন, স্বয়ং বিবেকানন্দ এই অনুষ্ঠান সূচনা করেছেন, শ্রদ্ধার সঙ্গে এই অনুষ্ঠান পালন করতে হবে! এইকথা মনে রেখে বেলুড় মঠ ও অন্যান্য শাখাকেন্দ্রে প্রত্যেক বছর এই পূজা অনুষ্ঠিত হয়!
তবে এখানে আরেকটি কথা বলা প্রয়োজন। বিবেকানন্দ খ্রিস্টের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাশীল হলেও প্রচলিত খ্রিস্টধর্ম, ধর্মযাজকদের ছলেবলে ধর্মান্তরকে তীব্রভাবে সমালোচনা করেছেন। ইতিহাসের ছাত্র হিসাবে বিবেকানন্দ জানতেন কিভাবে খ্রিস্টধর্ম ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদের সহায়করূপে কাজ করেছে! পাশ্চাত্যে দাঁড়িয়ে তাই তিনি খ্রিস্টধর্মের নামে অত্যাচার ও শোষণকে তীব্রভাবে আক্রমণ করেছেন, প্রকাশিত করেছেন পাদরীপুঙ্গবদের ভণ্ডামি ও মিথ্যাচারকে! মনে করিয়ে দিয়েছেন আধুনিক ইউরোপের জন্মই হয়েছে চার্চকে অস্বীকারের মাধ্যমে! যদি চার্চের ক্ষমতা আগের মতো হতো; তবে ভলতেয়ার, পাস্তুর, ডারউইন- এঁদের পরিণতিও গ্যালিলিও বা ব্রুনোর মতো হতো! তবে যীশু ও যথার্থ সাধকের প্রতি তিনি বারংবার সশ্রদ্ধ প্রণাম জানিয়েছেন! আবেগাপ্লুত কণ্ঠে তিনি বলেন- যীশুর সময় জন্মালে চোখের জলে নয়, বুকের রক্ত দিয়ে যীশুর পা ধুয়ে দিতেন!
এই লেখার মাধ্যমে আমরা ত্যাগমূর্তি মেরীনন্দন যীশুর প্রতি রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের গভীর শ্রদ্ধা প্রকাশ করেছি! রামকৃষ্ণ বলতেন "যত মত, তত পথ!" গুরুর এই উদার আদর্শকে মনে রেখে তাঁর শিষ্যরা খ্রিস্টসন্ধ্যা পালন করতেন, যীশুর পুণ্যজীবনী পাঠ করতেন, গাইতেন খ্রিস্টসঙ্গীত। রামকৃষ্ণ মিশন আজো এই উদার আদর্শকে পালন করে চলেছে! হিন্দুধর্মের ধ্বজাধারী ও অন্যান্য মাতব্বরদের পক্ষে এই উদার চিন্তাকে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়! তবে তাঁদের অসংখ্য কটূক্তি ও আক্রমণ এই উদার চিন্তাকে মন্দীভূত করতে পারবেনা! যতো দিন যাবে, এই উদার ভাবনা সমাজকে পরিপ্লাবিত করবে!