বারো মাসে তেরো পার্বণ - এর বাঙালির সর্ববৃহৎ পার্বণের নাম শারদোৎসব। অর্থের প্রাচুর্যে, রাজনৈতিক বদান্যতায়, বৃহৎ ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর কল্যাণে আমরা এখন পাঁচদিনের পার্বণকে টেনে এগারো থেকে বারো দিনে নিয়ে গিয়েছি। মহালয়া থেকে শুরু করে কার্নিভাল অব্দি। মফস্বল শহরগুলোতে কার্নিভাল একদিন বা দুদিন আগে হয় বলে সময়টা এক দুদিন কম এখনও। অন্যসব পার্বণ বা উৎসবকে পেছনে ফেলে শারদোৎসব বহুদিন যাবৎ দেশের সর্ববৃহৎ ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের রূপ নিয়েছে। এত অর্থের আমদানি হয় এই পার্বণে, খুব ভালো লক্ষণ নিশ্চয়ই। উৎস জানার প্রয়োজন আমাদের অন্ততঃ থাকার কথা নয়। যেসব সরকারী দপ্তর এই কাজের জন্য নির্দিষ্ট, তারাই না হয় সেই দ্বায়িত্ব পালন করুক। সাধারণ মানুষদের অর্থের সমাগমকে সাদরে মেনে নেওয়াই উচিত। তারা তো পরিশ্রমের ফলেই সেই অর্থ উপার্জন করছে। কে দিচ্ছে সেই টাকা, কত হাত ঘুরে সেই টাকা সাধারণ মানুষের হাতে পৌঁছচ্ছে, মাঝের কত হাতে সেই টাকার কত অংশ উবে যাচ্ছে, টাকার রং কালো না সাদা সেসব নিয়ে ভেবে সাধারণ মানুষের রাতের ঘুম নষ্ট করার কোনো মানে হয়না।
শারদোৎসবের সাথে যে শুধু কর্মকর্তা বা ব্যবসায়ীরা যুক্ত থাকেন তা তো নয়, অসংখ্য নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং প্রান্তিক লোকেরা যুক্ত থাকেন। চর্মকার থেকে কর্মকার, ঢাকি বাদক, দশকর্মা ভান্ডারের মালিক, দোকানের কর্মচারী, ফুল বিক্রেতা, ছোট ছোট দোকানের মালিক প্রত্যেকেরই পূজো। আবার এরা প্রত্যেকেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পুজোর সাথে যুক্ত। এই প্রান্তিক মানুষগুলোর হাতে সেই অর্থের কতটা পৌঁছয়? এই প্রান্তিক মানুষগুলো কতটা নিম্ন মধ্যবিত্ত স্তরে উন্নীত হচ্ছে? আধুনিককালের ব্যবসায় বড় হাঙরের দখলদারি বেশী, প্রভাব বেশী। ব্যবসার আঙিনায় প্রায় তিন চতুর্থাংশ বড় হাঙরের দখলে বা জবর দখলে। ছোট মাছগুলো ব্যবসার আঙিনা থেকে পাততাড়ি গোটাতে বাধ্য হচ্ছে ক্রমশঃ। চারিদিকে বিভিন্ন নামের বাজার, মল, শপিং কমপ্লেক্স ইত্যাদি। আমাদের যৌবনে যে দোকানগুলো ভালো ব্যবসা করত শহর বা মফস্বল শহরে, সেই দোকানগুলো আর দেখা যায়না। হয় তারা ধীরে ধীরে হাঙরের পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে না হয় হাঙরের মুখে পড়ে পাততাড়ি গুটিয়েছে।
শারদোৎসবে কয়েক হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হয় বলেই জানা যায়। কিন্তু প্রান্তিক মানুষগুলোর পকেটে এই টাকার কতটা ঢোকে? পুজোর পাঁচদিন যে ঢাক বাজায় মণ্ডপে, দশমী শেষে পাড়ার প্রতিটি ঘরে পৌঁছে যায় সে ঢাকের বাদ্যিসহ। যে বাড়ী থেকে যা কিছু জোটে তাই নিয়ে সে নিজের বাড়ী ফিরে যায়। তবেই তার বাড়ীতে পূজোর আনন্দ শুরু হয়। যে ফুল বিক্রেতার কাছ থেকে ফুল কিনে বিশ তিরিশটা মণ্ডপে মায়ের পূজো হচ্ছে, তারও একই অবস্থা। প্রান্তিক মানুষগুলোর জীবন এইরকমই চলছে যুগ যুগ ধরে, এখনও কোনো পরিবর্তন হয়নি। সে আমরা যতই পরিবর্তনের ডাক দিয়ে সরকার পাল্টে ফেলি না কেনো। পুজোর দু তিনমাস আগে থেকে পুজোর যে বাজার শুরু হয় সেই বাজারে প্রান্তিক মানুষেরা এখনও ব্রাত্য। পুজোর বাজারে এখনও আমরা কজন প্রান্তিক মানুষের দেখা পাই? তাদের বাড়ীতেও ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা আছে, স্ত্রী আছে, বাবা - মা আছে। তাদেরও তো পুজোয় নতুন জামাকাপড় পড়তে ইচ্ছে করে। পুজোয় উপার্জিত টাকাগুলো তাদের ভবিষ্যতের সংসার খরচ হিসেবেই রেখে দিতে হয়, নতুন জামাকাপড় বা শখ আহ্লাদের জন্য খরচ করা তাদের কাছে বাতুলতারই নামান্তর।
বিশ্বায়ন শুরু হওয়া তিরিশ বছরের বেশী হয়ে গেছে। সমস্ত ধরনের বাজার, শিক্ষা, কর্মস্থান এমনকি শারদোৎসবেরও বিশ্বায়ন সম্পূর্ণ হয়েছে। শুধু প্রান্তিক মানুষগুলোর জন্য সেই দরজা আজও বন্ধ। দারিদ্র্য সীমার নীচের মানুষগুলো নিয়ে কারুর কোনো মাথা ব্যথা নেই। দুর্গাপূজার নাম কি কারণে শারদোৎসব দেওয়া হয়েছিল, যে উৎসবে সকলের একইভাবে আনন্দিত হওয়ার ব্যবস্থা অনুমোদিত নয়?
অনেকেই হয়তো তেড়ে আসবেন, যুক্তি দেবেন, এই সমস্ত বামপন্থী কথাবার্তা প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে দীর্ঘকাল আগেই। আমরা অনেক কিছুই গুলিয়ে ফেলি অথবা আমাদের গুলিয়ে দেওয়া হয় বামপন্থার নামে। সাম্যতার আর এক নাম কি বামপন্থা? প্রশ্নটা এখানেই। রাজনৈতিক সাম্যতার কথা বাদ দিয়েই বলছি অর্থনৈতিক সাম্যতা এবং সামাজিক সাম্যতা কি মানুষের চাহিদা, রাষ্ট্রের চাহিদা হতে পারে না? কাম্য নয় কোনোভাবেই? যদি না হয় তাহলে আমরা মেনেই নিচ্ছি যে সমাজের এক শ্রেণী চিরকাল গরীব থেকে আরও গরীব হবে আর এক শ্রেণী বিত্তের পাহাড় তৈরী করবে। সেই গরীব শ্রেণীকে দারিদ্র্য সীমার ওপরে তোলার জন্য রাষ্ট্রের কোনো ভূমিকা থাকবে না বা একজন নাগরিকেরও কোনো ভূমিকা থাকবে না। যে বা যারা এই অসাম্যের গুনগান গায় তাদের জন্য আমার সহানুভূতি থাকতে পারে কিন্তু এই লেখা তাদের জন্য নয়। এই সাম্যতা একজন সুস্থ নাগরিক হিসেবে দেশের উন্নতির জন্য অবশ্যই চাই। কোনো একটি বা কয়েকটি অংশকে বাদ দিয়ে কোনো রাষ্ট্রই এগিয়ে যেতে পারে না। রাষ্ট্রের সার্বিক উন্নতি সম্ভব নয়। যে দেশে শ্রেণীবৈষম্য একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে নেই সেই দেশ সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারেনি কোনোকালেই। পুঁজিবাদী দেশে বা মিশ্র অর্থনীতির দেশেও কিন্তু এই ত্বত্ত মেনে চলা হয়। পুঁজিবাদী দেশেও রাষ্ট্র কিন্তু এই দ্বায়িত্ব এড়িয়ে যায় না। তাই দয়া করে এই সাম্যতার সাথে বামপন্থী সাম্যবাদকে গুলিয়ে ফেলবেন না। তাহলে সাম্যের গান গাওয়ার জন্য কাজী নজরুল ইসলামকে বামপন্থী আখ্যা দেওয়া উচিত আগে।
গাহি সাম্যের গান-
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহিয়ান্ ।
নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্মজাতি,
সব দেশে সব কালে ঘরে-ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।
..........
গাহি সাম্যের গান-
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান
যেখানে মিশছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুস্লিম-ক্রীশ্চান।
গাহি সাম্যের গান!
কে তুমি?- পার্সী? জৈন? ইহুদী? সাঁওতাল, ভীল, গারো?
কন্ফুসিয়াস্? চার্বআখ চেলা? ব’লে যাও, বলো আরো!
বন্ধু, যা-খুশি হও,
পেটে পিঠে কাঁধে মগজে যা-খুশি পুঁথি ও কেতাব বও,
কোরান-পুরাণ-বেদ-বেদান্ত-বাইবেল-ত্রিপিটক-
জেন্দাবেস্তা-গ্রন্থসাহেব প’ড়ে যাও, য্ত সখ-
কিন্তু, কেন এ পন্ডশ্রম, মগজে হানিছ শূল?
দোকানে কেন এ দর কষাকষি? -পথে ফুটে তাজা ফুল!
তোমাতে রয়েছে সকল কেতাব সকল কালের জ্ঞান,
সকল শাস্র খুঁজে পাবে সখা, খুলে দেখ নিজ প্রাণ!
তোমাতে রয়েছে সকল ধর্ম, সকল যুগাবতার,
তোমার হৃদয় বিশ্ব-দেউল সকল দেবতার।
কেন খুঁজে ফের’ দেবতা ঠাকুর মৃত পুঁথি -কঙ্কালে?
হাসিছেন তিনি অমৃত-হিয়ার নিভৃত অন্তরালে!
বন্ধু, বলিনি ঝুট,
এইখানে এসে লুটাইয়া পড়ে সকল রাজমুকুট।
এই হৃদয়ই সে নীলাচল, কাশী, মথুরা, বৃন্দাবন,
বুদ্ধ-গয়া এ, জেরুজালেম্ এ, মদিনা, কাবা-ভবন,
মস্জিদ এই, মন্দির এই, গির্জা এই হৃদয়,
এইখানে ব’সে ঈসা মুসা পেল সত্যের পরিচয়।
এই রণ-ভূমে বাঁশীর কিশোর গাহিলেন মহা-গীতা,
এই মাঠে হ’ল মেষের রাখাল নবীরা খোদার মিতা।
এই হৃদয়ের ধ্যান-গুহা-মাঝে বসিয়া শাক্যমুনি
ত্যজিল রাজ্য মানবের মহা-বেদনার ডাক শুনি’।
এই কন্দরে আরব-দুলাল শুনিতেন আহবান,
এইখানে বসি’ গাহিলেন তিনি কোরানের সাম-গান!
মিথ্যা শুনিনি ভাই,
এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির-কাবা নাই।
(মানুষ - কাজী নজরুল ইসলাম)
প্রান্তিক মানুষেরাও যেদিন আনন্দের সাথে দুর্গাপূজার অংশ হতে পারবে, শুধুমাত্র ভবিষ্যতের সংসার প্রতিপালনের কারণে অংশগ্রহণ করবে না দুর্গাপূজায়, পুজোর দিনগুলোয় তাদের মুখে হাসি ফুটে উঠবে, সেইদিনই আক্ষরিক অর্থে দুর্গাপূজা শারদোৎসবে পরিণত হবে। জোর করে নামকরণের প্রয়োজন হবে না। সেইদিনই প্রকৃত সাম্যের গান গাওয়ার সময় হবে।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।