পা বাড়ানোর কথা তো বললাম। কিন্তু কাজটা বেশ কঠিন। উনিশ শতকের রসায়ন ছিল পরমাণুর গাথাকাব্য। সেই সঙ্গে অণুর যোগ্য এবং সম মর্যাদাপূর্ণ সঙ্গদান। মৌলিক পদার্থের যাবতীয় বৈশিষ্ট্য পরমাণু ধরে পাওয়া যাবে এবং বোঝা যাবে—এই ছিল উনিশ শতকের রসায়ন বিজ্ঞানীদের দৃঢ় বিশ্বাস। পদার্থের ক্ষুদ্রতম অবিভাজ্য কণা হল পরমাণু। পরমাণুর আপেক্ষিক ওজন এবং যোজ্যতা—এই দুটি ছিল তাদের পরম ধর্ম। পরিচিতি জ্ঞাপক যাচকাঠি।
সেই ধারণায় চিড় ধরে গেল জার্মানি ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্সে ঊনবিংশ শতাব্দের শেষ দশকের পর পর কয়েকটি যুগান্তকারী আবিষ্কারে। যথা:—
১। ১৮৯৫ সালের শেষ দিকে হ্বিলহেল্ম কনরাড রয়েন্টগেন এক্স-রশ্মি আবিষ্কার করেন।
২। ১৮৯৬ সালের গোড়ায় আতোয়াঁ অঁরি বেকারেল ইউরেনিয়াম যৌগের ভিত্তিতে তেজষ্ক্রিয়তার ঘটনা খুঁজে পেলেন।
৩। ১৮৯৭ সালে জোসেফ জন টমসন প্রথম অবপারমাণবিক কণা হিসাবে ইলেকট্রন আবিষ্কার করেন।
৪। ১৮৯৮ সালে পিয়র কুরি এবং মারি কুরি যৌথ ভাবে আরও তিনটি তেজষ্ক্রিয় মৌল থোরিয়াম, পলোনিয়াম এবং রেডিয়াম এক সঙ্গে আবিষ্কার করে ফেললেন।
৫। ১৮৯৯ সালে অদ্রে লুই দবির্নে অ্যাক্টিনিয়াম নামক আরও একটি তেজষ্ক্রিয় মৌলের সন্ধান পেলেন।
৬। ১৮৯৯ সালেই আর্নস্ট রাদারফোর্ড তেজষ্ক্রিয় বিকিরণের মধ্যে আলফা ও বিটা রশ্মি সনাক্ত করলেন ও নামকরণ করলেন।
৭। ১৯০০ সালে পল ভিলার্দ এই দুইয়ের মাঝখানে দেখলেন গামা রশ্মির নির্গমন।
এই সমস্ত আবিষ্কারের অভিঘাতে শুধু পদার্থবিজ্ঞানে নয়, রসায়ন শাস্ত্রেও এত কাল ধরে চর্চিত পুরনো ধ্যান ধারণায় প্রবল আলোড়ন উঠল। সব কিছুকে নতুন ভাবে দেখার আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত এবং সমস্যা উত্থিত হল। পর্যায় সারণিকেও সেই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হল। ১৯০০ সালে জানা গিয়েছিল পাঁচটা তেজষ্ক্রিয় মৌলের খোঁজ; ১৯১১ সালেই সংখ্যাটা দাঁড়িয়ে গেল তিরিশে। আর এদিকে সিসা আর ইউরেনিয়ামের মধ্যে এদের জন্য মেন্দেলিয়েভের টেবিলে খালি জায়গা ছিল মোটে নটা। কে কে সেখানে জায়গা পাবে? বাকিদের তাহলে কী হবে? কোথায় যাবে তারা?
ইতিমধ্যে দেখা গেল, এই তিরিশটা মৌলের মধ্যে তেজষ্ক্রিয়তায় ও অন্যান্য ভৌত ধর্মে বেশ খানিক তফাৎ থাকলেও এবং এদের পারমাণবিক গুরুত্ব আলাদা আলাদা হলেও কয়েকটা করে মৌলের রাসায়নিক আচরণ প্রায় অভিন্ন। ইংল্যান্ডের ফ্রেডরিক সডি এবং পোল্যান্ডের কাশিমির ফাজানস—দুই রসায়নবিদ স্বতন্ত্রভাবেই পরামর্শ দিলেন, অভিন্ন রাসায়নিক ধর্ম দেখে দেখে কয়েকটা করে মৌলকে একই ঘরে রেখে দেওয়া হোক। সডি এদের নাম দিলেন আইসোটোপ (isotope)—বাংলায় সমস্থানিক।
তাতে একটা সমস্যা মিটল। কিন্তু প্রতিটি মৌলের পারমাণবিক গুরুত্বের আগে যে গুরুত্ব ছিল, এবারে বোঝা গেল, সেটা দিয়ে মৌলগুলিকে চেনার কাজ করতে গেলে ঝামেলা হতে পারে। যেমন দেখা গেল, C-১৪ এবং N-১৪—কার্বন এবং নাইট্রোজেনের এই দুটি আইসোটোপের পারমাণবিক গুরুত্ব এক হওয়া সত্ত্বেও দুটির রাসায়নিক ধর্ম অনেকাংশেই আলাদা। এরকম উদাহরণ আরও অনেক দেখানো যায়।
প্রশ্ন হল, মৌলগুলির পরিচিতি জ্ঞাপক যাচকাঠি তাহলে কী?
এই সমস্যার সমাধান হয়েছিল অনেকগুলি ধাপে, বিভিন্ন বিজ্ঞানীর হাতে। যেমন, নিলস বোহর পদার্থবিজ্ঞানের তরফ থেকে মাক্স প্লাঙ্কের কোয়ান্টাম তত্ত্বকল্প প্রয়োগ করে পরমাণুর ইলেকট্রনিক বিন্যাস সম্পূর্ণ নতুন ভাবে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ১৯১৩ সালে দেখালেন, কেন্দ্রে প্রোটনের সংখ্যা কেন্দ্রের বাইরে বিভিন্ন শক্তি স্তরে থাকা ইলেকট্রনের মোট সংখ্যার সমান। এই সংখ্যাটাই একটা মৌলের স্বতন্ত্র পরিচিতি প্রদান করে। আবার এই সংখ্যাটি ঘটনাচক্রে পর্যায় সারণিতে মৌলটির স্থানক্রমের সঙ্গে মিলে যায় (পরে আমরা দেখব, কয়েকটি ব্যতিক্রম সহ)। ইতিমধ্যেই এই সংখ্যাটিকে রাদারফোর্ড এবং আন্টনিয়াস ভ্যান ডার ব্রুক পরমাণু সংখ্যা (atomic number) হিসাবে নামাঙ্কিত করেছিলেন।
হেনরি মোজলে (১৮৮৭-১৯১৫)
এই ব্যাপারে সবচাইতে সুনির্দিষ্ট এবং উল্লেখযোগ্য পরীক্ষামূলক কাজটি করেছিলেন হেনরি গুইন জেফ্রেজ মোজলে। তিনি ১৯১০ সালে ম্যাঞ্চেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে রাদারফোর্ডের ল্যাবরেটরিতে এসে যোগ দেন এবং প্রধানত বিরল ধাতু গ্রুপের মৌলগুলির এক্স-রে বিকিরণের বর্ণালী বিশ্লেষণ করার কাজে হাত লাগান। পরে তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েও এই কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন এবং অচিরেই (১৯১৪ সাল নাগাদ) দেখাতে সক্ষম হন যে প্রতিটি মৌলের এক্স-রে বিশ্লেষণ করে যে কোনো নির্দিষ্ট রেখায় বিকিরণের প্রাপ্ত কম্পাঙ্ক মৌলটির পরমাণুক্রমের সঙ্গে অনন্য রূপে এক গাণিতিক অপেক্ষকের মাধ্যমে সম্পর্কিত। এটিকে পরবর্তী কালে মোজলের সূত্র হিসাবে বলা হয়ে থাকে। অর্থাৎ, পরমাণু ক্রমাঙ্কই একটি মৌলের একমাত্র সত্য পরিচিতি জ্ঞাপক মাপনী।
এই বিষয়টি জানার পর মেন্দেলিয়েভের সারণিতে তিনটি উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রমী অবস্থান বৈজ্ঞানিক যৌক্তিকতা খুঁজে পেল। উচ্চতর পারমাণবিক ওজন বিশিষ্ট তিনটি মৌলকে তাদের চাইতে হ্রস্বতর পারমাণবিক গুরুত্বের মৌলের আগে গিয়ে বসতে হয়; যথা: টেলুরিয়াম (৫২ – ১২৭.৬০) ও আয়োডিন (৫৩ – ১২৬.৯০), আর্গন (১৯ – ৩৯.৯৫) ও পটাশিয়াম (২০ – ৩৯.০৯), এবং, কোবাল্ট (২৭ – ৫৮.৯৩) ও নিকেল (২৮ – ৫৮.৭০)।
তারপরই ঘটে যায় এক চরম দুঃখজনক ব্যাপার।
১৯১৪ সালে শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। সেই যুদ্ধে যুবক মোজলে যোগ দেন এবং সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। তিনি গোলন্দাজ বাহিনীতে টেলিসংযোগ ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিটে কর্মরত অবস্থায় তুরস্কের গ্যালিপলি নামক ফ্রন্টে শত্রুপক্ষের গুলিতে প্রাণ হারান। মাত্র সাতাশ বছর বয়সে এই অসাধারণ প্রতিভাবান পদার্থবিজ্ঞানীর মৃত্যু হয়। ফলে তিনি তাঁর কাজ আর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারলেন না।
অথচ তখনও একটা অত্যন্ত জরুরি কাজ বাকি থেকে গেছে। পর্যায় সারণিতে বিরল ধাতুর ঘরে (বা এফ-ব্লকে) ৬১ নম্বর মৌলটি কে বা কী, তা খুঁজে বের করা।
অতঃপর তা নিয়ে শুরু হয়ে যায় বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীদের মধ্যে এক প্রবল প্রতিযোগিতা। ফ্রান্স, ডেনমার্ক, আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, জার্মানি—ইত্যাদি বিভিন্ন দেশের এক এক দল বিজ্ঞানী দাবি করতে লাগলেন, তাঁরা সেই মৌলটি সনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন। সেই অনুযায়ী তার বিভিন্ন নামও দিয়ে ফেললেন। আর বার বারই অন্যদের তরফে সেই দাবিগুলি নস্যাৎ ও নামগুলি বাতিল হতে লাগল। একটা সময় বোঝা গেল, এই ধাতুটি বিশুদ্ধ অবস্থায় পৃথিবীতে অবস্থান করে না। জার্মান রসায়নবিদ ইডা নোড্ডাক, যিনি তৎকালীন জার্মান আইনের বলে (১৯৩২) বিজ্ঞানীর পেশা ছাড়তে বাধ্য ছিলেন, এবং বিনা পয়সায় তাঁর স্বামী হ্বালটার নোড্ডাকের সহকারী হিসাবে গবেষণার কাজ করতেন, প্রস্তাব দিলেন, এই মৌলটি তেজষ্ক্রিয় এবং হয়ত এর অর্ধজীবন শেষ হয়ে গেছে বলে একে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
ইডা নোড্ডাক (১৮৯৬-১৯৭৮)
অবশেষে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন আমেরিকায় ম্যানহাটন প্রকল্পে যুক্ত এক দল বিজ্ঞানী—জ্যাকব আকিবা ম্যারিন্সকি, লরেন্স এলগিন গ্লেন্ডালিন এবং চার্লস দ্যুবোয়া কোরিয়েল ১৯৪৫ সালে ইউরেনিয়ামের নিউক্লীয় ভাঙন থেকে এবং নিওডিমিয়াম পরমাণুকে নিউট্রন দিয়ে বোমাঘাত করে ৬১ নং মৌলের দুটি আইসোটোপ তৈরি করতে সক্ষম হন।
এবার সমস্যা হল, এর নাম কী দেওয়া হবে? আগে এর এত নামানামি হয়ে গেছে যে নতুন করে কোনো নামই আবিষ্কারকদের পছন্দ হচ্ছিল না। অবশেষে চার্লসের স্ত্রী প্রস্তাব দিলেন, গ্রিক পুরাণের এক বীর চরিত্র অনুযায়ী এর নাম হোক প্রমিথিয়াম। সেই নামই বহাল হল। ১৯৪৭ সালে সেই নামেই মেন্দেলিয়েভের একষট্টিতম সন্তান পর্যায় সারণিতে স্থান পেলেন।
অতঃ কিম?
গ্লেন সিবর্গ (১৯১২-৯৯)
একজন প্রথিতযশা আমেরিকান বিজ্ঞানী গ্লেন থিওডোর সিবর্গ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে অবশেষে কৃত্রিম ভাবে পরীক্ষাগারে তৈরি তেজষ্ক্রিয় মৌলগুলির জন্য বিরল ধাতুবর্গের মতো এক ব্লক বানানোর প্রস্তাব দিলেন। যারা অ্যাকটিনাইডস হিসাবে পরিচিত হল। তার ভিত্তিতেই নতুন ভাবে সাজানো হল পর্যায় সারণিকে। আজ অবধি আমরা মেন্দেলিয়েভের সারণিকে সিবর্গের প্রদত্ত রূপে দেখে এবং পড়ে চলেছি।
শেষ করার আগে দুটো বিশেষ খবর বলে রাখছি। মেন্দেলিয়েভ নোবেল পুরস্কার পাননি। তাঁর নামে একটি (১০১ নং) অ্যাকটিনাইড মৌল মেন্দেলিয়েভিয়াম পরিচয় লাভ করেছে ১৯৯৭ সালে, মৃত্যুর নব্বই বছর বাদে। সিবর্গ অতটা ভাগ্যহীন নন। নোবেল পুরস্কার থেকে শুরু করে অসংখ্য পুরস্কার ও মেডেল তিনি পেয়েছেন। যোগ্য হিসাবেই নিঃসন্দেহে। আবার তাঁর জীবদ্দশাতেই ১৯৯৪ সালে একটি (১০৬ নং) অ্যাকটিনাইড মৌলের নাম দেওয়া হয় সিবর্গিয়াম।
এও হয়ত এক রকম ঠান্ডা যুদ্ধের রাসায়নিক প্রভাবই বলা যেতে পারে।
[অনেক বিজ্ঞানীর ছবি দেওয়া যেত। স্থান সঙ্কুলানের স্বার্থে কিছু বাছাবাছি করতে হচ্ছে। আর বিজ্ঞানীদের ছেলেমানুষি দেখানোর জন্য পর্যায় সারণিকে কতভাবে তারা সাজিয়েছেন তার সামান্য কিছু নমুনা দিলাম। সৌজন্য:উইকিপিডিয়া। পাঠক খুঁজলে আরও অনেক মডেল দেখতে পাবেন।]
গ্রন্থসূত্র
E. H. Ackerknecht (trans. 1948), “Pasteur’s Report on the Usefulness of the Historical Method in Teaching Science”; American Journal of Physics, Vol. 16, 1948.
Jacob Bronowski (1974), The Ascent of Man; Little, Brown and Co., Boston.
Donald A. McQuarrie, Peter A. Rock, Ethan B. Gallogly (2011), General Chemistry: Atom First; University Science Books, New York. 4th Edition
J. R. Partington (1972), A History of Chemistry, Vol. IV; Macmillan, London.
J. van Spronsen (1969), The Periodic System of the Chemical Elements, the First One Hundred Years; Elsevier, Amsterdam.
Pieter Thyssen and Koen Binnemans (2011), “Accommodation of the Rare Earths in the Periodic Table: A Historical Analysis”; in Karl A. Gschneidner (ed. 2011), Handbook on
the Physics and Chemistry of Rare Earths; Academic Press, Burlington.
Spencer R. Weart (1986), “Aids for Teachers: From the AIP Centre for History of Physics”; Journal of College Science Teachers; (December 1985/January 1986).
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।