এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • অষ্টক গান 

    Manab Mondal লেখকের গ্রাহক হোন
    ২৮ জুলাই ২০২৩ | ৫৮৮ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • অষ্টক গান সম্পর্ক জানেন কি? লোক সংস্কৃতি এই ধারা কি সত্যি লুপ্তপ্রায়?



    নীলষষ্ঠী বা নীলপুজো বাংলার হিন্দুসমাজের এক লৌকিক উৎসব, যেখানে শিবের বিয়ে দেওয়া হয়। চৈত্রসংক্রান্তির চড়ক উৎসবের আগের দিন অনুষ্ঠিত হয় নীলষষ্ঠী পুজো। মহাদেব শিবের এক নাম নীলকণ্ঠ । সেই নীল বা শিবের সঙ্গে চণ্ডিকার বিয়ে উপলক্ষে লৌকিক আচার-অনুষ্ঠান পালিত হয় এই পূজায়। পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে দক্ষযজ্ঞে সতীর দেহত্যাগের পর সতী পুনরায় নীলধ্বজ রাজার বিল্ববনে সুন্দরী কন্যারূপে আবির্ভূত হন। রাজা তাঁকে নিজ কন্যারূপে লালন-পালন করে শিবের সঙ্গে বিয়ে দেন। নীলপূজা শিব ও নীলাবতীর বিবাহ-অনুষ্ঠানের স্মারক। নীল পুজোতে শিবকে নিয়ে নীলসন্ন্যাসীরা ও শিব-দুর্গার সঙেরা গান করতে করতে বাড়ি বাড়ি ঘোরেন এবং ভিক্ষা সংগ্রহ করেন। এ সময় তাদের মুখে শােনা যায় যে বিশেষ ধরনের গান তা ‘নীলের গান' বলেই লোক মুখে পরিচিত। তবে এই নীলের গান হল - অষ্টক গান।



    চৈত্র সংক্রান্তির আগের দিন সারাদিন উপােস করে সন্তানবতী হিন্দু মেয়েরা। বিকেলে তারা শিবের মাথায় জল ঢালেন। নীলের ব্রত শুনে সন্তানের কল্যাণার্থে প্রদীপ জ্বালিয়ে শিবপুজো করে উপবাস ভাঙ্গেন তারা। নিম বা বেল কাঠ দিয় শিবের মূর্তি তৈরি হয়। চৈত্র সংক্রান্তির বেশ আগেই নীল বা শিবকে মণ্ডপ থেকে নীচে নামানাে হয়। নীলপূজার আগের দিন অধিবাস; গভীর রাতে হয় হাজরা পূজা। হাজরা পূজায় শিবের চেলা বা ভূত-প্রেতের দেবতাকে পােড়া শােল মাছের ভােগ দেওয়া হয়। বিয়ে উপলক্ষে সকল দেবতাকে আমন্ত্রণ করা হয়। পরের দিন নীলপূজার সময় শিবকে গঙ্গাজলে স্নান করিয়ে নতুন লালশালু কাপড় পরিয়ে অন্ততপক্ষে সাতটি বাড়িতে ঘােরাতে হয়। নীলসন্ন্যাসীরাও লাল কাপড় পরে পাগড়ি মাথায়, গলায় রুদ্রাক্ষমালা ও হাতে ত্রিশূল নিয়ে শিবের সঙ্গে মিছিল করেন। এই মিছিলের দলপতিকে "নীল পাগোল" বা "বালা" বলা হয়। এদের সাথে থাকে ঢাক-ঢোল, বাঁশী বাজনদারের দল। সঙেরা শিব-দুর্গা সাজে। মহিলারা ঘরের উঠানে আলপনা দিয়ে নীলকে আহ্বান করে বরাসনে বসিয়ে তার মাথায় তেলসিঁদুর পরিয়ে দেন। এরপর নীলের গান শুরু হয়:



    যেমন

    শুন সবে মন দিয়ে হইবে শিবের বিয়ে
    কৈলাসেতে হবে অধিবাস।
    (ও) তাতে নারদ করে আনাগোনা কৈলাসে বিয়ার ঘটনা
    বাজে কাঁসী বাঁশী, মোহন বাঁশরী।

    (ও) নারদ চলল গিরি রাজের গৃহেতে।
    আর একদিনেতে শূলপাণি, নারদকে বলেন বাণী
    শুনো নারদ শুনো আমার সাধ,
    আমি দুই পাশে দুই বালিশ দিয়ে, মধ্যিখানে থাকি শুয়ে
    উশিপুসি করে কাটাই রাত।।

    (ও) নারদ চললো গিরি রাজের গৃহেতে।।
    আর ওই শিব কয় কৈলাসে যেয়ে, দেখে এসেছি মেয়ে
    শীঘ্র করো বিয়ের আয়োজন

    (ও) নারদ চললো গিরি রাজের গৃহেতে।।
    চলিলেন নারদ মুনি, চলিলেন নারদ ধনি
    উপনীত গিরি পুরে যেয়ে।
    কইলেন মেনকা রানী, আইলেন নারদ মুনি
    দেখা পেয়ে এল মুনির ঠাঁই।।

    (ও) নারদ চললো গিরি রাজের গৃহেতে।।
    শোনো ওগো গিরি রাজা, হইবা আমার আজা
    জামাই তোমার হবে দিগম্বর।।

    বিয়ের ঘটক ভাগিনেয় নারদ মুনির কাছে শিব আর্তি জানান,

    "ভাইগনা যদি উপকারী হও।
    তবে বিয়া দিয়া আমার প্রাণ বাঁচাও।।"

    বিয়ের পর নীলের গানে থাকে সংসারী হর-পার্বতীর কথা, শিবের কৃষিকাজ, গৌরীর শাঁখা পরা প্রভৃতি এবং ভিখারি শিবের সঙ্গে অন্নপূর্ণা শিবানীর দ্বান্দ্বিক সহাবস্থানের কাহিনি। গানের প্রথম অংশ দলপতি বালারা এবং পরবর্তী অংশ অন্য নীলসন্ন্যাসীরা গেয়ে থাকেন। গানের শেষে সন্ন্যাসীদের চাল-পয়সা, ফল প্রভৃতি ভিক্ষা দিয়ে থাকেন বাড়ির মেয়েরা।



    বাংলার লোকসংস্কৃতির জনপ্রিয় এই অষ্টক গান হারিয়ে যাচ্ছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের ব্রতগুলোর সাথে এই সংস্কৃতি হয়ত এখন গুরুত্ব হারিয়েছে, কিন্তু এখনও সম্পূর্ণ হারিয়ে যায় নি। একে সঠিক লালন পালন করার প্রয়োজন।



    অষ্টক গান মূলত গ্রাম বাংলাতে চৈত্র সংক্রান্তি ও গাজনের সময় অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। মূলত নৃত্য ও গীত এর মাধ্যমে রচিত হয় অষ্টক গানে অনেক সময় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও রাধারাণীর লীলা তুলে ধরা হয়। শিল্পীরা কেউ শ্রীকৃষ্ণ, রাধারানী, নিমাই, অষ্টসখী, মাতা যশোদা সেজে তাদের নৃত্য ও গীতের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেন অষ্টক গান। এই অষ্টক গানে নৌকাবিলাস, নিমাই সন্ন্যাস, কৃষ্ণ বেহুলা লখিন্দর ইত্যাদি পালাগুলি দেখানো হয় নৃত গীত সহকারে। অষ্টকগীত শব্দটা এসেছে বোধহয় শ্রীকৃষ্ণের অষ্টপ্রহর এর লীলা থেকে। আবার হতে পারে প্রতি দলে আট জন মিলে নৃত্যগীত করে বলে একে অষ্টক বলে। কিংবা এও হতে পারে শ্রীকৃষ্ণ অষ্টসখী নিয়ে লীলা করতেন সেই অনুযায়ী এই নৃত্যগীত পালাকে অষ্টক গান বলা হয়।

    অষ্টক গান লোকসংস্কৃতি অঙ্গ তাই নৃত খুব সাদামাটা জৌলুস বিহীন। কিন্তু খুব আবেগপ্রবণ, মন মুগ্ধকর যা হৃদয় স্পর্শ করে যায়। অষ্টক গীত নৃত্যে ঢোল, করতাল, ঘুঙুর, হারমোনিয়াম, বাঁশি, ইত্যাদি ব্যাবহৃত হয়। শিল্পীদের আয় হয় খুব সামান্য তাই এ অষ্টক গানের প্রতি শিল্পীদের আগ্রহ কমে যাচ্ছে। তাই সঠিক প্রচারের প্রয়োজন এই লৌকিক গানটির।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। দ্বিধা না করে মতামত দিন