নিতান্তই আবিষ্কারের সময়ানুগ সারিবদ্ধ ক্যাটালগ নয় বলেই বোধ হয় আমরা দেখি, বিজ্ঞানের ইতিহাস কখনও কখনও ভারি রসিক হয়ে ওঠে।
ঊনবিংশ শতাব্দের একেবারে শেষ দশকে এমন একটা সময় ঘনিয়ে এল যখন পর্যায় সারণির জ্ঞানোৎপাদক মূল্য আরও সুন্দরভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে, অথচ যিনি এর থেকে সবচাইতে বেশি সুনাম অর্জন করতে যাবেন, তিনিই পরবর্তী বিকাশের প্রশ্নে কেমন যেন সন্দিগ্ধ হয়ে উঠলেন। এবার সেই সব গল্প। প্রথমে ইংল্যান্ডের দুই উইলিয়ামের কীর্তিকলাপ!
একে একে।
১৮৯৪ সাল। পদার্থবিজ্ঞানে যিনি লর্ড র্যালে নামে পরিচিত, আদিতে তিনি ছিলেন জন উইলিয়াম স্ট্রাট, সেকালের একজন বিরাট মাপের বিজ্ঞানী। প্রথম দিকে গণিত নিয়ে গবেষণা চালালেও পরে পদার্থবিজ্ঞানের প্রায় সমস্ত শাখাতেই তিনি স্বচ্ছন্দে বিচরণ করেছেন এবং অসংখ্য মৌলিক অবদান রেখে গেছেন। সেই তিনি সেবার বিভিন্ন গ্যাসের ঘনত্ব নিয়ে নানা রকম পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে করতে এক অদ্ভুত সমস্যার সামনে পড়ে গেলেন।
নাইট্রোজেনকে নিয়ে।
নাইট্রোজেন এমনিতে বেশ নিরীহ গ্যাস। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে সে আছে প্রচুর পরিমাণে, প্রায় পাঁচ ভাগের চার ভাগ। অথচ এই বিপুল পরিমাণ নিয়ে সে যে আমাদের চারদিক ঘিরে আছে সেটা আমরা প্রতি দিনকার জীবনে ভালো করে টেরই পাই না। হাইড্রোজেনের মতো সে নিজে জ্বলে না, আবার অক্সিজেনের মতো অন্য কাউকেও জ্বালায় না, মানে, জ্বলতে সাহায্যও করে না। বিজ্ঞানীদের বক্তব্য, পরোক্ষভাবে সে আমাদের সাহায্য করে অক্সিজেনকে খানিক নিয়ন্ত্রণে রেখে। অক্সিজেনের যা সক্রিয় তিড়িংবিড়িং স্বভাব, সব কিছুকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাক (আসলে অক্সাইড) করে দেওয়া, সে যদি বাতাসে একাই একশ শতাংশ হয়ে থাকত, তাহলে আমাদের নাক দিয়ে ঢুকে শরীরের কোষটোষগুলোকে একেবারে ঝামা করে দিত। নাইট্রোজেন দিয়ে ঘেরা থাকায় সে এতটা বাড়াবাড়ি কখনও করতে পারে না। আর প্রত্যক্ষভাবে নাইট্রোজেন কিছু কিছু গাছের মধ্যে সহবাসকারী ব্যাকটিরিয়ার সঙ্গে খাতির জমিয়ে উদ্ভিদের জন্য পুষ্টিকর আমিষ জাতীয় খাদ্য তৈরি করে, যা আবার পশুপাখি বা মানুষেরও খাদ্য হিসাবে কাজে লাগে। পরিবেশ প্রিয় পাঠকদের জন্য সেও এক মনোরঞ্জক বিষয়।
সে যাক গে। বিজ্ঞানীরা তো নিরপেক্ষ থাকতে চান। র্যালে নাইট্রোজেনকে ভালো করে বুঝবার জন্য বিভিন্ন উৎস থেকে সংগ্রহ করে তার ঘনত্ব মাপতে গেলেন। খুব সাদামাটা ব্যাপার। নিছকই কৌতুহল আর কি!
লর্ড র্যালে
কিন্তু ও কী?
অন্য যৌগ থেকে নাইট্রোজেন ছাড়িয়ে এনে ঘনত্ব বের করলে তার যা মান পাচ্ছেন, বাতাসের নাইট্রোজেনকে শুদ্ধ করে ঘনত্ব দেখতে চাইলে তার থেকে এক ভিন্ন অঙ্ক পাচ্ছেন। এবং সেটা সর্বদাই সামান্য হলেও বেশি। দুই ক্ষেত্রেই নানা রকম পদ্ধতি প্রয়োগ করে দেখলেন, ফলাফলে কোনো ব্যত্যয় হচ্ছে না। যেমন, বাতাস থেকে প্রাপ্ত বিশুদ্ধ নাইট্রোজেনের ঘনত্ব পাওয়া যাচ্ছে ২.৩১০২ গ্রাম/ঘন সে-মি, আর রাসায়নিক পদ্ধতিতে পাওয়া নাইট্রোজেনের ঘনত্ব দাঁড়াচ্ছে ২.২৯৯২ গ্রাম/ঘন সে-মি। পার্থক্যটা এমনিতে হয়ত খুব বেশি নয়, এক শতাংশেরও কম; কিন্তু ওটুকু তফাৎ-ই বা হবে কেন? তফাৎটা প্রতিটি ক্ষেত্রেই এক রকম হবে কেন? অন্য ভাষায়, তফাতের মানের ক্ষেত্রে কেন অশৃঙ্খল প্রভেদন (random variation) হচ্ছে না? র্যালের গভীর সন্দেহ হল। বিজ্ঞানীদের যেমন স্বভাব আর কি। কোথাও কিছু একটা খুঁত পেলেই হল। সেই নিয়ে পড়ে থাকবেন যতক্ষণ তাকে অপনয়ন করা না যাচ্ছে।
অন্য বিজ্ঞানীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য র্যালে এই ফলাফলটা প্রসিদ্ধ নেচার পত্রিকায় প্রকাশ করে দিলেন। আর অমনি সেটা রসায়নবিদ উইলিয়াম র্যামজে-র চোখে পড়ে গেল। দুজনে মিলে—মিলে মানে এক সঙ্গে নয়, দুই উইলিয়াম স্বতন্ত্র ভাবে—তখন কোমর বেঁধে নামলেন সমস্যাটির সমাধানে। নিজের নিজের গবেষণাগারে। একশ বছরেরও বেশি আগেকার (১৭৮৫) বিজ্ঞানী হেনরি ক্যাভেন্ডিশের একটা পরীক্ষার সাহায্য নিলেন তাঁরা। র্যালে এবং র্যামজে দুজনেই সন্দেহ নিরসনের পথে এক সময় দেখলেন, বাতাসের নাইট্রোজেন বলে যাকে পাওয়া যাচ্ছে, তার মধ্যে আরও কোনো একটা ভারি গ্যাসীয় মৌল চুপচাপ লুকিয়ে বসে আছে। যে নাইট্রোজেনের চাইতেও গম্ভীর, কারও সঙ্গে চট করে মেলামেশা করে না। একটা বেশ রাজকীয় ভাব যেন! নানা ভাবে সাবধানে মৌলটাকে পৃথক করে বের করে এনে এবং সনাক্ত করে তাঁরা এর নাম দিলেন আর্গন। আসলে ঠিক তাঁরা নন, ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশন ফর দি অ্যাডভান্সমেন্ট অফ সায়েন্স-এর সভাপতি গ্যাসটির নিষ্ক্রিয়তার কথা শুনে এই নাম প্রস্তাব করলেন। গ্রিক ভাষায় যার অর্থ, “অলস গ্যাস”। কোনো কাজ যে করে না। অন্যান্য মৌলের সঙ্গে যে রাসায়নিক ক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে চায় না।
উইলিয়াম র্যামজে
১৯০৪ সালে দুই বিজ্ঞানী র্যালে আর র্যামজে আর্গন আবিষ্কারের জন্য এক সঙ্গে নোবেল পুরস্কার পেলেন।
একটা ছোট দুঃখের কথা এখানে বলে যাওয়া দরকার। ১৯০১ সাল থেকে নোবেল পুরস্কার চালু হয়। মেন্দেলিয়েভ ১৯০৭ সালে মারা যান। লোঠার মেয়ার অবশ্য অনেক আগেই চলে গেছেন। পর্যায় সারণির একটা আংশিক কাজের জন্য (যদিও কাজটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ) উপরোক্ত দুজন বিজ্ঞানীকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হল, কিন্তু গোটা পর্যায় সারণির মতো অত চমৎকার কাজটির জন্য মেন্দেলিয়েভ কোনো এক অজ্ঞাত কারণে নোবেল কমিটির কাছে স্বীকৃতি পেলেন না।
যাই হোক, পরের বছরই (১৮৯৫) র্যামজে আর একটা একই রকম অলস গ্যাসের সন্ধান পেলেন। হিলিয়াম (গ্রিক ভাষার লব্জে সৌরগ্যাস)। এই গ্যাসটিকে ১৮৬৮ সালেই অন্য দুজন বিজ্ঞানী সূর্যরশ্মির বর্ণালী বিশ্লেষণ করে দেখতে পেয়েছিলেন। র্যামজে সেটি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে খুঁজে পেলেন এবং এর রাসায়নিক আলস্যের নমুনাও সকলের কাছে তুলে ধরলেন। আর ১৮৯৮ সালে র্যামজে এবং মরিস ট্র্যাভার্স আবিষ্কার করলেন আরও তিনটি নিষ্ক্রিয় গ্যাস—নিওন (নতুন), ক্রিপটন (গুপ্ত) এবং জেনন (আগন্তুক)। শুধু তাই নয়, আরও পরে যে তেজস্ক্রিয় নিষ্ক্রিয় মৌলটি (র্যাডন) পাওয়া যায়, তাও আবিষ্কৃত হয় র্যামজেরই তৈরি এক মিশ্রণ থেকে। অর্থাৎ, সব কটি নিষ্ক্রিয় গ্যাসের আবিষ্কারের সঙ্গে উইলিয়াম র্যামজের নাম জড়িয়ে আছে। সেই রাজকীয়ভাবটা স্মরণে রেখে এদের আর একটা যূথবদ্ধ নাম হল আমির গ্যাস (noble gas)।
এদিকে যাঁর এই আবিষ্কারে অত্যন্ত খুশি হওয়ার কথা সেই মেন্দেলিয়েভ তখনও জীবিত। তিনি প্রথমে খুব বিস্মিত এবং বিরক্ত হলেন। যে টেবিল তিনি তৈরিই করেছেন মৌলগুলির রাসায়নিক সক্রিয়তার পর্যায়বৃত্ত দেখানোর জন্য, সেখানে এই সব রাসায়নিক ভাবে অলস বা নিষ্ক্রিয় গ্যাসগুলো ঢুকবে কী করে? কোথায় ঢুকবে? ফলে মেন্দেলিয়েভ আর্গনকে নাইট্রোজেনের এক বহুরূপ (allotrope) হিসাবে গণ্য করতে চেয়েছিলেন। ওজোন যেমন অক্সিজেনেরই আর এক বহুরূপ। তাহলে সে নাইট্রোজেনের ঘরেই শয্যা ভাগ করে থাকতে পারত। কিন্তু একে একে পাঁচ পাঁচটা নিষ্ক্রিয় গ্যাস আবিষ্কারের পর তো আর সেই কথা বলা যাচ্ছে না।
সমাধান বের করলেন সেই র্যামজে এবং ট্র্যাভার্স মিলে। একেবারে ধ্রুপদী মেন্দেলিয়েভিয়ান ঘরানায়। তাঁরা বললেন, কোই বাত নেহি, মেন্দেলিয়েভের পর্যায় সারণিতে আরও একটা গ্রুপ বা স্তম্ভ যোগ করা হোক—নাম তার দেওয়া হোক শূন্য-গ্রুপ অথবা অষ্টম গ্রুপ। সেখানে এই পাঁচ জন আগন্তুক উপর নীচে জমিয়ে বসবে। পর্যায় সারণিও টিকে থাকবে এবং আয়তনে বাড়বে, আর রাসায়নিক ভাবে শূন্য সক্রিয়তারও খানিক মূল্য ধরে দেওয়া যাবে।
সমাধানটা মেন্দেলিয়েভেরও পছন্দ হল। তাঁর তৈরি টেবিলের নমনীয়তা তথা ধারণ ক্ষমতা দেখে তিনিও চমকিত হলেন। এবং তাঁর লেখা পাঠ্য বইয়ের তৃতীয় সংস্করণে প্রকাশিত পর্যায় সারণিতে নিষ্ক্রিয় গ্যাসেরা উপযুক্ত সম্মানের সঙ্গেই সঠিক অবস্থানে জায়গা পেল।
বিস্ময়ের দরজায় এখনই তালাচাবি মারবেন না। আরও চমক ইতিহাসে তখনও বাকি। তবে তত দিনে মেন্দেলিয়েভ ইতিহাসের পাতাতেই স্থান পেয়েছেন। চিরস্থায়ী সেই আসন। কিন্তু পর্যায় সারণির বিবর্তন হয়েই চলেছে।
এর পরে যে সমস্যা উদ্ভূত হল, তা এক কথায় অভূতপূর্ব। এক কথায় প্রকাশ করলে বলতে হয় পর্যায় সারণিতে বিরল ধাতুসমুহ (rare earths)-এর আসন নির্ণয়।
কারা তারা?
রসায়নের তন্বিষ্ঠ ছাত্র ছাড়া এই সব ধাতুর নাম প্রতি দিনকার জীবনে বিশেষ কেউ শোনে না। কয়েকটা নাম বললেই বুঝতে পারবেন। এই যেমন ধরুন, প্রেসিওডিমিয়াম, নিওডিমিয়াম, সামারিয়াম, গ্যাডোলিনিয়াম, প্রমেথিয়াম, সিরিয়াম, ইট্রিয়াম, ইটারবিয়াম, ইত্যাদি। নামগুলো একেবারেই অচেনা অচেনা লাগছে না? আমার বিশ্বাস, এমনকি রসায়নের ছাত্ররাও ক্লাশে পর্যায় সারণি পড়ার সময় ছাড়া এই সমস্ত মৌলের নাম মনেই করতে পারে না। কিংবা, শিক্ষকরাও ক্লাশে পড়ানোর সময় বাদে কত জন এই চোদ্দটি মৌলের নাম মনে রাখেন হাতে গুনে বলা যায়। প্রকৃতিতে সহজে পাওয়া যায় না বলেই এদের নাম ওরকম নাম হয়েছিল। এখন ওদের সাধারণ নাম ল্যান্থানাইডস—যদিও ল্যান্থানাম মৌলটি নিজেই এখন আর এই দলে নেই।
এদের পারমাণবিক গুরুত্ব আলাদা আলাদা হলেও খুব কাছাকাছি এবং এমন যে এদের এক সারিতে এবং একই স্তম্ভে রাখা যাচ্ছে না। অন্য দিকে এদের রাসায়নিক ধর্মে পরস্পরের মধ্যে প্রায় কোনো পার্থক্যই দেখা যায় না। হয়ত একই অক্সাইডে তিনটি ধাতু মিলেমিশে একাকার হয়ে বসে থাকে। তার ফলে এদের বিভিন্ন স্তম্ভেও ভাগ করে দেওয়া যায় না। এমনকি এদের খুঁজে বের করতে গিয়েও রসায়নবিদদের হিমসিম খেতে হয়েছে। সেই রাগ এবং ক্ষোভের প্রকাশ বিজ্ঞানীরা চিরস্থায়ীভাবে এঁকে দিয়েছেন এদের কোনো কোনোটার নামে। যেমন ল্যান্থানাম = লুকিয়ে থাকে; ডিস্প্রোসিয়াম = খুঁজে পাওয়া কঠিন; থুলিয়াম = সভ্য জগতের বাইরে; ডেসিপিয়াম = ঠকায়; ইত্যাদি।
এদের খুঁজে পাওয়া কঠিন বলেই মাঝে মধ্যে বেশ কয়েকটি বিরল ধাতুর নাম ভুল ভাবে উঠে এসেছিল, যাদের পরে তালিকা ছেড়ে বেরিয়ে যেতে হয়। যেমন: কলম্বিয়াম, ডামারিয়াম, ডেমোনিয়াম, ইউক্সেনিয়াম, ইনকগনিটাম, মোসান্ড্রাম, ফিলিপ্পিয়াম, রোজারিয়াম, ভিক্টরিয়াম, প্রভৃতি। পরে এক এক করে জানা যায়, এইগুলি উপরের আবিষ্কৃত মৌলগুলিরই ছদ্মবেশী রূপ। বাঁচা গেছে বাবা! বিরল জিনিসের সংখ্যা যদি প্রতুল হয় সেও এক বিড়ম্বনা।
এদের সাদৃশ্যগুলি একটু দেখে নেওয়া যাক:
১। এরা সকলেই চকচকে দেখতে এবং রুপোর মতো উজ্জ্বল;
২। ধাতু হলেও এরা বেশ নরম; ছুড়ি দিয়ে কচ কচ করে কাটা যায়;
৩। সকলেই চৌম্বক ধর্ম বিশিষ্ট;
৪। সকলেই ত্রিযোজী, কোনো কোনোটা দ্বিযোজী বা চতুর্যোজী যৌগ গঠন করতে পারে; ইত্যাদি।
তো, এই যাদের অবস্থা, তাদের নিয়ে কী করা হবে? বিমূঢ় না হয়ে কিমকর্তব্যম্?
মেন্দেলিয়েভের পর্যায় সারণি প্রস্তাবনার সময়ে ছয়টি বিরল ধাতুর আবিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। তিনি বা অন্য সমসাময়িক কেউ এদের সঠিক ভাবে জায়গা দিতে পারেননি। কেন না, তাঁরা এদের যোজ্যতাও ভুল ভাবে নির্ধারণ করেছিলেন। কোনোটাকে দ্বিযোজী, কোনোটাকে ত্রিযোজী, আবার কোনো কোনোটাকে চতুর্যোজীও ধরে নিচ্ছিলেন। সেই কারণে তাঁরা সকলেই এদেরও অন্য মৌলদের কারও কারও সঙ্গে এক স্তম্ভভুক্ত করতে চাইছিলেন। কিন্তু পর্যায় সারণির মূল বার্তার সঙ্গে মিলিয়ে সেটা কোনোভাবেই সম্ভব হচ্ছিল না। পরে অবশ্য মেন্দেলিয়েভও মেনে নিয়েছিলেন, এদের ত্রিযোজী হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। জে. ভ্যান স্প্রনসেন মেন্দেলিয়েভের সারণির শতবর্ষ উপলক্ষে রচিত এক পর্যালোচনায় দেখিয়েছিলেন, তখনই যদি চোদ্দটা (বা কোনো কোনো মতে সতেরোটা) বিরল ধাতু আবিষ্কার হয়ে থাকত, মেন্দেলিয়েভের পক্ষে তাঁর মূল টেবিল বানানোটাই বেশ কঠিন হয়ে পড়ত। [Spronsen 1969]
সেই বইটির ভিত্তিতে আমাদের কালের দুজন লেখকের বক্তব্য: “One could also think that the accommodation of the rare earths in the periodic table was difficult because only a few rare earths were known at the time of Mendeleev’s seminal work of 1869. From a retrospective point of view however, the classification of the chemical elements would have been next to impossible if all the rare-earth elements had been known at that time.” [Thyssen and Binnemans 2011, 3]
মেন্দেলিয়েভের খুব ঘনিষ্ঠ হাঙ্গেরির একজন রসায়নবিদ, বহুশ্লাভ ব্রাউনার, বহু দিন ধরে চেষ্টা করে গেছেন, মেন্দেলিয়েভের সারণিতেই বিরল মৌলগুলিকে বসানোর। কিন্তু তাঁরও কোনো পরীক্ষাতেই এদের যোজ্যতা তিনের বেশি বা কম হচ্ছিল না।
বহুশ্লাভ ব্রাউনার
অবশেষে সমস্যার সমাধানের জন্য সমকালীন বিজ্ঞানীরা তাকালেন সৌর পরিবারের দিকে। সেখানে বিভিন্ন কক্ষপথের প্রত্যেকটাতে একটা করে গ্রহ পরিভ্রমণ করছে। কিন্তু মঙ্গল আর বৃহস্পতির মাঝখানে রয়েছে এক গ্রহাণুপুঞ্জের দল—যারা টুকরো টুকরো আকারে এক সঙ্গে দল বেঁধে একই কক্ষপথে সূর্যের চারদিকে ঘুরে ঘুরে চলেছে। জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের যুক্তিসম্মত অনুমান, এই টুকরোগুলি আসলে সম্ভবত একটা গ্রহেরই ভগ্নাংশ। বোডের নিয়ম অনুসারে মঙ্গল আর বৃহস্পতির মাঝে একটা গ্রহ থাকারই কথা। ছিলও নিশ্চয়ই। সেটাই কোনো কারণে (কেন, এখনও সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায়নি) অনেকগুলো অংশে ভেঙে যায়, আর সেই ভাঙা টুকরোগুলি তাদের জননী গ্রহের কক্ষপথেই বিরাজ ও আবর্তন করতে থাকে। বিরল ধাতুগুলিও হয়ত এরকমই। তাদের পারমাণবিক গুরুত্ব যাই হোক, তারাও একই জায়গায় একই যোজ্যতা নিয়ে পর্যায় সারণিতে গুটিসুটি মেরে এক সঙ্গে বসে আছে। তা ওরা ওভাবেই না হয় থাক না। সব্বাইকে একই রকম হতেই হবে, কে মাথার দিব্যি দিয়েছে?
সেই ব্যবস্থাই হল। সিরিয়াম থেকে শুরু করে লুটেশিয়াম পর্যন্ত চোদ্দটা বিরল ধাতুকে মূল সারণিতে প্রথমে একই কামরায় পুরে দেওয়া হল। পাশাপাশি তাদের জন্য আলাদা একটা সারি তৈরি করে এফ-ব্লক নাম দিয়ে সেখানে প্রত্যেককে স্বতন্ত্রভাবে দেখিয়ে রাখাও হল। যাতে কুমির ছানার গল্পের কথা অরসিক অরাসায়নিকরা কেউ বলতে না পারে। ব্রাউনার যেহেতু মেন্দেলিয়েভের একজন গুণগ্রাহী জুনিয়র বন্ধু, তাঁর এই প্রস্তাবে মেন্দেলিয়েভও আর জোরালোভাবে আপত্তি করতে পারলেন না। সাগ্রহেই মেনে নিলেন।
আমরা ধ্রুপদী রসায়ন শাস্ত্রের চূড়ান্ত বিকাশ পর্ব প্রায় অতিক্রম করে ফেলে বিংশ শতাব্দের সূচনায় আধুনিক রসায়নের প্রবেশ দ্বারে এসে পৌঁছেছি।
এবার সেদিকে দুএক পা বাড়াতে হবে।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।