দেশের সর্বোচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতি, ডিওয়াই চন্দ্রচূড় বলেছেন, দেশের কোনও আদালতের কোনও বিচারপতির, যে মামলার শুনানি এখনও চলছে, সেই মামলা নিয়ে কোথাও কোনও সাক্ষাৎকার দেওয়ার এক্তিয়ার নেই। এই পর্যবেক্ষণ রাখার পাশাপাশি, তিনি কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়, যিনি বাংলার শিক্ষা জগতের অন্যতম বৃহৎ, এসএসসি ও টেট পরীক্ষার দুর্নীতির মামলার শুনানি চলাকালীন একটি বেসরকারী সংবাদ মাধ্যমে তাঁর সাক্ষাৎকারে তিনি ঐ মামলা নিয়ে কী মন্তব্য করেছেন, তাও জানতে চাওয়ার পরে ঐ বিচারপতিকে এই দুর্নীতি সংক্রান্ত মামলার শুনানি থেকে সরিয়ে দেওয়ার রায় দিয়েছেন।
এবার ফিরে যাওয়া যাক, কী বিষয় নিয়ে এই বিতর্ক, সেই প্রসঙ্গে। যেদিন থেকে মাননীয় বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় বাংলার শিক্ষক নিয়োগ সংক্রান্ত দুর্নীতি নিয়ে মামলা শোনা শুরু করেছেন, তবে থেকেই তাঁর এক একটি মন্তব্য শাসকদলের সঙ্গে তাঁর বিরোধ বাড়িয়েছে। প্রথমেই তিনি এসে, এই বিষয়ে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেন, যার পরবর্তীতে রাজ্যের শাসকদলের গুরুত্বপূর্ণ নেতা মন্ত্রীদের জেরা করার জন্য গ্রেপ্তার করে সিবিআই। এখনও অবধি সেই বিষয়ে কেন চার্জশিট দেওয়া হচ্ছে না, তা নিয়েও তিনি উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন। স্পষ্টতই রাজ্যের শাসকদল এই পুরো দুর্নীতি সংক্রান্ত বিষয়ে পশ্চাদপদ অবস্থায় ছিল, কিন্তু যেদিন মাননীয় বিচারপতি এই মামলা এবং অন্যান্য বিষয় নিয়ে একটি বেসরকারী বৈদ্যুতিন মাধ্যমে সাক্ষাৎকার দেন, তবে থেকেই রাজ্যের শাসকদলের পক্ষ থেকে বলা শুরু হয়, এটা তিনি করতে পারেন না। যে মামলার শুনানি চলছে, সেই মামলা নিয়ে কোথাও কোনও মত প্রকাশ করার অধিকার নেই। এতে মামলা প্রভাবিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। স্বাভাবিকভাবেই বিরোধী দলের মানুষজন বলা শুরু করেন, যেহেতু বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং প্রভাবশালী নেতা মন্ত্রীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, তাই শাসকদল এই বিচারপতির বিরোধিতা করছে। আজকে যখন দেশের সর্বোচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতি অবধি বলছেন, যদি কোনও বিচারপতি এই ধরনের কোনও সাক্ষাৎকার দিয়ে থাকেন, তাহলে তিনি সেই মামলা শোনার অধিকার হারিয়েছেন, তাই আবারও এই বিষয় নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে।
অনেকে বলছেন, তবে কি একজন বিচারকের মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকতে নেই? অনেকে বলছেন, দেশের প্রধান বিচারপতিও তো কিছুদিন আগে একটি সংবাদ মাধ্যমের কনক্লেভে একটি সাক্ষাৎকার দেন, তাহলে তিনিও তো সমান দোষে দুষ্ট। বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়, সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময়ে, যে ২০০২ সালের ব্যাঙ্গালোর প্রিন্সিপালস অফ জুডিশিয়াল কন্ডাক্টের উদাহরণ দিয়ে বলেছিলেন যে তিনি কোনও অন্যায় করছেন না, তাহলে সেটাও কি ভুল ছিল? নাকি আমরা যেমন জানি, আইন থাকলে, আইনের ফাঁক থাকে, সেই সুবিধা নিয়েই সেদিন বিচারক অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় সেদিন ওই সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন? এই কথাটা ঠিক, যে একজন বিচারপতির নিজের মত প্রকাশের অধিকার হয়তো আছে, কিন্তু সেই রুল অফ কন্ডাক্টের মধ্যেও তিনটি ধারা আছে, যা অনেকের জানা নেই। সেই তিনটি ধারার ২.৪, ৭৬(ক) এবং ১৫২ নম্বর ধারাগুলো যদি একটু অধ্যয়ন করা যায়, তাহলে দেখা যাবে সেখানে স্পষ্টভাবে বলা আছে, যে মামলার শুনানি তাঁর এজলাসেই চলছে, সেই মামলার বিষয়ে, কোনও মন্তব্য সেই বিচারপতি জনমানসে করতে পারবেন না। আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো, মুনাফা করে এমন কোনও সংবাদমাধ্যমে, আইন সংক্রান্ত কোনও জ্ঞানচর্চার বাইরে কোনও আলোচনা করা যাবে না। ৭৬(ক) ধারায় একদম পরিষ্কার বলা আছে, নিজের ভাবমূর্তি গঠন বা নিজের দেওয়া রায় নিয়ে যদি জনমানসে বিতর্ক তৈরী হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তাহলে তা থেকে কর্মরত বিচারপতিদের বিরত থাকার কথাই বলা হয়েছে। তাহলে সেদিন মাননীয় বিচারক মহাশয় যে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন, তা এই ধারাগুলোকে লঙ্ঘন করেছে না করেনি? ঐ বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যমটি সেদিনের সাক্ষাৎকার সম্প্রসারণ করে মুনাফা করেছে না করেনি? সেদিন যাঁরা দেখেননি, আজকে যে এই সাক্ষাতকারটি আবার তাঁরা সামাজিক মাধ্যমের সূত্র ধরে দেখছেন, তখনও কি সেই সংবাদ সংস্থাটিই লাভবান হচ্ছে না? আবারও যে বিতর্ক তৈরী হচ্ছে, তার মধ্যে দিয়ে কি সেই বিচারপতিরই ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হচ্ছে বা অন্যদিকে বিচার প্রক্রিয়ার ওপর আবার অনাস্থা তৈরী হচ্ছে না?
ধরে নেওয়া যাক, মাননীয় বিচারপতি মহাশয়ের আমাদের রাজ্যের শিক্ষক নিয়োগ সংক্রান্ত দুর্নীতি দমনের সদিচ্ছা আছে, কিন্তু তিনি যদি আদালত কক্ষে বা এইরকম একটি মুনাফাভিত্তিক সংবাদমাধ্যমে এইরকম পর্যবেক্ষণ রাখেন, তাহলে মানুষের মনে তাঁকে নিয়ে যে আশা তৈরী হয়, তাঁকে যে বহু মানুষ ‘মসীহা’ মনে করবেন, তা কি খুব অস্বাভাবিক? ভারতীয় বিচারব্যবস্থার সেই ব্যাঙ্গালোর প্রোটকল কিন্তু কোনও বিচারপতিকে সেই ক্ষমতা দেয়নি। ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী, ভারতের আইনসভা, প্রশাসন এবং বিচারব্যবস্থা, প্রত্যেকের স্বতন্ত্র ভূমিকা আছে, সেখানে কোনও অন্যায় হলে, তার বিচার হবে এবং তা করবে আদালত, সেখানে কোনও একজন ব্যক্তি গুরুত্বপূর্ণ নন। সেই ব্যক্তি দুর্নীতির প্রশ্নে কতটা অসহিষ্ণু, তা কিন্তু বিচার্য নয়। দুর্নীতির বিরুদ্ধে যা আইন আছে, তাই একজন বিচারককে প্রয়োগ করতে হবে, তা তিনি দুর্নীতিকে ভালো মনে করুন বা খারাপ। কিন্তু একজন বিচারক যদি শুনানি চলাকালীন বলেন, এবার বড় মাথাদের বা ‘ধেড়ে ইঁদুর’ ধরতে হবে, তখন কি মনে হয়না কোনও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপূরণের লক্ষ্যে তিনি এই কথা বলছেন? একজন বিচারক মনে করতেই পারেন, ধর্ষণ একটি সামাজিক ব্যধি অতএব অত আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যাওয়ার দরকার নেই, সোজা গুলি করে মেরে দিলেই হয় ধর্ষণকারীদের, কিন্তু তা কি চলতে পারে, অন্তত আজকের আমাদের মতো একটি গণতান্ত্রিক দেশে? সেইখান থেকেই সমাজে বিচারব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা তৈরী হয় না? তখন যদি সেই বিচারপতি এসে জনসমক্ষে বলেন, ‘দেখলি কেমন দিলাম’, তখন তা বিচারব্যস্থাকেই ব্যঙ্গ করা হয় না কি? সেইখান থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই কি হায়দ্রাবাদে যখন ধর্ষণকারীদের পুলিশ যখন গুলি করে হত্যা করে, তখন সেই পুলিশকর্মীদের ওপর মানুষ পুষ্পবৃষ্টি করে, তখন কি শুধু মানুষদের দোষ দেওয়া যায়? কিংবা প্রয়াগরাজে যখন একজন বাহুবলীকে সংবাদমাধ্যমের ক্যামেরার সামনে গুলি করে হত্যা করা হয়, তখন যে আমাদের মধ্যে উদ্দীপনা তৈরী হয়, তাও কি এই বিচারব্যস্থার প্রতি অনাস্থাই দেখিয়ে দেয় না?
যেদিন নোটবন্দি হয়েছিল, ধন্য ধন্য পড়েছিল দেশ জুড়ে, সেদিন অনেকে বলেছিলেন এইটাই তো কালোটাকা ধরার পদ্ধতি, কিন্তু কিছু কিছু মানুষ বলেছিলেন এটা ভুল পদ্ধতি, এতে না কালো টাকা উদ্ধার হবে, না সন্ত্রাস কমবে। আদপে পরে সরকারীভাবে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছিল, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ছাপানো সমস্ত টাকাই ব্যাঙ্কে জমা হয়েছে। সেদিন যিনি ‘মসীহা’ হয়ে উঠেছিলেন অনেকের কাছে, সেই তিনি কিন্তু ভালোই জানতেন ঐ পদ্ধতিতে অর্থনীতি ধ্বংস হয়, কিন্তু কালো টাকা উদ্ধার হয় না। আজ তাঁরা জনান্তিকে কী বলছেন? আর আজ যখন বিচারপতিসুলভ আচরণের বাইরে বেরিয়ে পাড়ার দাদার ভাষায় কোনও ব্যক্তি কথা বলছেন এবং প্রবল সমর্থন পেয়েছেন তখনও বেশ কিছু মানুষ বলেছিলেন, এই পদ্ধতি গণতন্ত্রের পক্ষে ক্ষতিকর, কিন্তু সেই সংখ্যাটা যেহেতু ক্ষুদ্র, তাই তাঁদের কথা মান্যতা সেদিনও পায়নি আজও পাচ্ছে না। আজ দেশের সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতি বলার পরেও অনেকে বলছেন, এটা রাজনৈতিক সেটিং, তার মানে তাঁরা কি বলতে চাইছেন, দেশের সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতিকেও একটি বা দুটি রাজনৈতিক দল কিনে নিয়ে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করছেন? অনেকে বলছেন, এই বিচারপতির জন্যেই কিন্তু এই নিয়োগ সংক্রান্ত দুর্নীতিতে এই এতো বড় কেষ্ট- বিষ্টুদের আজ জেল খাটতে হচ্ছে। হয়তো কথাটা কিছুটা হলেও সত্যি, কিন্তু সেই জন্যেই তো মাননীয় বিচারপতির আরও সতর্ক হওয়া প্রয়োজন ছিল। তাঁর আচরণের সমালোচনা করা মানে তো দুর্নীতিকে সমর্থন করা নয়। আমাদের মতো ক্ষুদ্র অংশের মানুষ যাঁরা তাঁর ঐ সাক্ষাৎকারের সমালোচনা করেছি, সেদিনও তাঁদের শুনতে হয়েছিল, আজও শুনতে হচ্ছে, আমরা দুর্নীতির অংশীদার। প্রশ্ন শুধু ছিল যে, বিচারপতি হঠাৎ কাজের কাজ ফেলে, ‘ধেড়ে ইঁদুর’ বলে বা, বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়ে বিচারবিভাগীয় নিরপেক্ষতাকে প্রশ্নের মুখে ফেলবেন কেন? অনেকে হয়তো এখনও ঐ সমস্ত কথাবার্তাকে মহামান্য বিচারপতির আবেগের বহিঃপ্রকাশ ভেবে সহমর্মী হয়ে আছেন, কিন্তু প্রশ্নটা থেকেই যায়, এই পদ্ধতিতে কি বিচারব্যবস্থা চলতে পারে? হয়তো মানুষের মনে অনেক ক্ষোভ আছে, বিচারব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রতা নিয়ে নানান প্রশ্ন আছে, কিন্তু কোনও কিছুর কি সহজ সমাধান হয়? সংযম, আত্মপ্রচারহীনতা, আইনানুগ থাকা ভালো বিচারপতির বৈশিষ্ট। মহামান্য বিচারপতি এসবের ধারেকাছেও কি থেকেছেন? একজন সাধারণ নাগরিক বা একজন প্রজ্ঞাবান পন্ডিত হয়তো বা হিরোইজমের প্রতি সমর্থন বা ঝোঁক এড়াতে পারেন না কিন্তু একজন বিচারপতি কি তাতে গা ভাসাবেন? তিনি তো দুর্নীতির তদন্ত করতে গিয়ে তার বিচারকেই গৌণ করে দিচ্ছেন। অপরাধকে, আপরাধীকে অন্যমুখী হওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছেন। আর, সমাজ বা রাজনীতি বা দেশের পক্ষে আরও বেশি ক্ষতিকর বিষয়সমূহ থেকে মানুষের দৃষ্টি সরিয়ে দিচ্ছেন, একথাও পরিস্কার করে বলা যায়।
মাননীয় বিচারপতি কী করবেন, তা খুব দ্রুতই হয়তো জানা যাবে, কিন্তু যে তদন্ত প্রক্রিয়াকে ঘিরে উন্মাদনা তৈরী হয়েছিল, সেই তদন্তের কী হবে? আসল অপরাধী ধরা পড়ুক, শাস্তি পাক আমরা সবাই চাই, কিন্তু তা আইনী প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়েই হোক। আইনের বাইরে বেরিয়ে, হয়তো জনগণের চোখে সাময়িক ‘মসীহা’ হয়ে ওঠা যায়, হয়তো, হিন্দি ছবির হিরো হয়ে ওঠা যায়, কিন্তু তাতে বিচারব্যবস্থাই কি বাধাপ্রাপ্ত হয় না? এই বিচারপতিকে নিয়ে এমন বিতর্ক শুরু হয়েছে, যে অনেকে তো কলেজিয়াম পদ্ধতির বিরোধিতাও শুরু করে দিয়েছেন। বলছেন ঐ কলেজিয়াম পদ্ধতির বদলে, সরকারী সুপারিশে বিচারপতি নিয়োগ হওয়াই বাঞ্ছনীয়, তাহলে আজকে এই দুর্নীতির তদন্তের ক্ষেত্রে দেশের প্রধান বিচারপতি এই কথা বলতে পারতেন না। কিন্তু সেই পদ্ধতিতে কি সত্যিই বিচার পাওয়া যেত? অন্তত সাম্প্রতিক, গুজরাটের গণহত্যার অভিযুক্তরা, বা বিলকিস বানোর ধর্ষকদের মুক্তি, বা রাহুল গান্ধীকে লঘু পাপে গুরু দন্ড দেওয়ার রায়, কি সেই ইঙ্গিত দেয়? একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমাদের চাহিদা কি হওয়া উচিৎ? কিভাবে একজন দোষী ব্যক্তি শাস্তি পেতে পারেন, কিন্তু তা তো কোনও একজন ব্যক্তি থাকা বা না থাকার ওপর নির্ভর করতে পারে না, সমগ্র বিচারব্যবস্থার ওপর আস্থা ফিরিয়ে এনেই তা করা সম্ভব।
সুমন সেনগুপ্ত
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।