পরজীবী সাম্রাজ্যবাদ যত'ই তার মৃত্যুর দিকে এগিয়েছে তত তার নোংরা রুপগুলি ফুটে ফুটে বেরিয়ে এসেছে। এমন'ই এক তার ভয়ংকর নোংরা রূপ আজকের দিনে ভোগবাদ; যা আমাদের আত্মকেন্দ্রিক থেকে আর আত্মকেন্দ্রিকতর করে তুলছে। আজ আমাদের দেশে সাম্রাজ্যবাদীদের নয়াউদারবাদী অর্থনীতি -“গ্যাট” চুক্তি ও বিশ্বব্যাংক আইএমএফ সহ আরো বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী সংস্থার ঋণের জাল, যেমন ভাবে পুরোপুরি স্তব্ধ করেছে দেশীয় পুঁজির বিকাশ। তেমনি বাড়িয়েছে সাম্রাজ্যবাদী শোষণ। আমাদের মন থেকে শরীরের সারা জায়গা জুড়ে সাম্রাজ্যবাদ তার জাল বিস্তার করেছে। আর আমাদের কে একই চক্করে ক্রমাগত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নাজেহাল করে দিচ্ছে। মস্তিস্ক থেকে শারীরিক শ্রম সব শুষে নিয়ে বারেবারে ফুলেফেঁপে উঠছে।
আমরা সাম্রাজ্যবাদের খপ্পরে তিনটি লোহার শক্ত জালে জড়িয়ে আছি আষ্টেপৃষ্টে। এক, ফাটকা পুঁজির লোভ। দুই, আধা সামন্তবাদ ও পিতৃতন্ত্র। তিন, ভোগবাদ ও ভোগবাদী সংস্কৃতি। উদারীকরণ-বেসরকারিকরণ –এর ফাঁদে পড়ে ফাটকা পুঁজি অবিরাম ঘুরছে আমাদের মাথার মধ্যে। আমাদের পেছনে চাবুক মেরে দিন থেকে রাত ছুটিয়ে নিয়ে চলছে চরম সুখ খোঁজার পথে। এরফলে যেমন শ্রম ও পুঁজির দ্বন্দ্ব আজ বাড়তে বাড়তে একহাত জায়গা নিয়েছে তেমনি আমাদের মস্তিষ্ক থেকে প্রয়োজনীয়তাগুলি ভুলিয়ে চাহিদা’কেই প্রধান স্থানে জায়গা দিয়েছে। সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের অধিক মুনাফার স্বার্থে আমাদের শিখিয়েছে- “আমি আমার মতন” ও “আরো চাই আরও চাই” নীতিকথা – ফলত, আত্মকেন্দ্রিকতার চাওয়া চাহিদাগুলি বেড়ে চলায় ও এই চাওয়ার ঘাটতি মেটানোর তাগিদায় ছুটতে ছুটতে, আমাদের মস্তিষ্কে দেখা দিচ্ছে কম বয়স থেকেই একাকীত্ব, উদ্বেগ, অবসেশন, কম্পালসন জনিত নানান সমস্যা। যা পরবর্তী কালে তার শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে বাইপোলার, বর্ডারলাইন, ওসিডি -মতন আকার নিয়েছে। শেষে আমরা ক্লান্ত হয়ে সবাই মুক্তি চাইছি এই চক্কর থেকে। কিন্তু মুক্তির সঠিক পথ না পেয়ে হতাশা-অবসাদগ্রস্ত হয়ে মুক্তি হিসেবে আত্মহত্যাকে বেছে নিতে হচ্ছে।
পুঁজিবাদী বিশ্বের চোখে থাকা ‘অন্যায়’। চাহিদা মেটানোর খেলায় বিলাসিতা ক্রয়ের এই প্রতিযোগিতায় আমরা প্রতিনিয়ত অনেক বহুজাতিক সংস্থার ফাঁদেও আটকা পড়ছি। দামী ফোন-গাড়ি মতন বিলাসী পণ্য কেনার জন্য তাই চীনের হুয়াং এর মত অনেকেই নিজের কিডনি বিক্রি করে দেয়, ঝাং ও তেং দম্পতিদের মত অনেকেরই নিজেদের সন্তানকে বিক্রি করে দিতে হচ্ছে। কিংবা নিজ নিজ শরীর কে মুচমুচে পণ্য বানিয়ে বাজার দর কষাকষির খেলায় নামিয়ে আনতেও বাধ্য হচ্ছে। নইলে কী বড়লোকি সমাজ কখনোই মেনে নেবে? এরফলে বাড়ছে সমাজে নোংরা লুম্পেন সংস্কৃতির আনাগোনাও। যন্ত্রের পরিবর্তনের যান্ত্রিক সভ্যতায় দাড়িয়ে কাজের সময় অধিক বেড়ে যাওয়ায় -কম সময়ে বেশি সুখ পেতে গিয়ে বাড়ছে মানুষের মধ্যে নেশা, বিকৃত সেক্স কিংবা সেক্সুয়াল ক্রেভিং এর মতন, ক্ষনিকের মস্তি দায়ক প্রবণতাগুলিও। যারফলে মানুষগুলি আপনা-আপনি ভেতর থেকে ক্ষয় করে দেওয়া যায়। সহজ হয়, নিজের মস্তিষ্কে থেকে ভাববার প্রয়োজনীয়তা বোধ নষ্ট করে দেওয়া এবং মস্তিষ্কে প্রাকৃতিক-মানসিক চেতনা বিকাশে এর পরবর্তীতে ঢুকিয়ে দেওয়া যায়, “পেহেলে ইস্তেমাল কারে ফির বিশ্বাস কারে”- পণ্য বিক্রির প্রোপাগান্ডা'ময় গল্পকথা গুলিও। এসময় আর -একটি মানুষ একটি কণ্ঠ নয় বরং ধরা হয়, একটি টাকা একটি কণ্ঠ। ফলত, চরম সুখের দৌড়ে ক্ষনিকের উন্মাদনায় মাতিয়ে এমন করে ফেলে বৃহৎ স্বার্থে ক্ষতি হয়ে যায়; সর্বোপরি ভবিষ্যত নষ্ট হয়ে যায় একটা গোটা প্রজন্ম ও সমাজের। যারফলে, সেই প্রজন্মের মধ্যে দেখা দেয় ভালোবাসার বদলে হিংস্রতা। সাধারণ মানুষের সাথে মন খুলে মেশার বদলে নিজেকে আড়াল করে রাখা। এবং কম সময়ে বিনা শ্রমে বাড়তি সুখের আশায় অসৎ কিংবা নোংরা কাজে লিপ্ত হওয়ার ঝোঁক।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, চরম সুখের এই স্বপ্ন পূরণের জন্য মানুষ অবিরাম ছুটে চলেছে। প্রতিনিয়ত ক্রেডিট কার্ড, ইএমআই বা ব্যাংক লোনের হাতছানি আমাদের এই অজানার পথে ছুটে চলার গতিকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। বর্তমান সময়ে মানুষ বিয়েতে একদিনের ফটোগ্রাফি বিলাসিতা বা বালি দ্বীপের কয়েক দিনের ভ্রমণের জন্য বছর জুড়ে ইএমআইয়ের বোঝা টানতে এক পায়ে খাড়া। তবুও যতখানি পারা যায় অপ্রয়োজনীয় ভোগ্য পণ্য কিনতে হবে! ভোগবাদ মানুষকে দিয়েছে ক্লান্তিহীন ছুটে চলা আর অবিরাম হতাশা। এই হতাশার কারণে গড়ে প্রতি ৪০ সেকেন্ডে পৃথিবীতে একজন মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়, বছরে প্রায় ৪০ লাখ। যার বেশিরভাগই তথাকথিত উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে। গত বছর বিশ্বজুড়ে বিলাসী পণ্যের বাজার ছিল প্রায় ৩২৩,১৯০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার! যার বড় অংশ জুড়ে ছিল কসমেটিক্স-পারফিউম, আধুনিক ফ্যাশনের পোশাক, চামড়াজাত পণ্য, ঘড়ি ও জুয়েলারি। অথচ এর সাথে বিশ্ব জুড়ে ভুখা পেটের সংখ্যা আরো বেড়েছে। কাজ হারিয়ে পথে বসেছে। ভারতে প্রায় একশো কোটি মানুষ আজ পুষ্টিজাত খাদ্যের অভাবে নানান রোগে ভুগছে। বিশ্বায়নের প্রভাবে বছরে আত্মহত্যা করছে ১২০০০-এর বেশি কৃষক। আসলে এই ভোগবাদী সংস্কৃতি আমাদের কে ভুলিয়ে দিচ্ছে, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান এর মতন আমাদের মৌলিক অধিকার গুলি। একদম গোড়া থেকে ক্ষয় করে দিচ্ছে সুস্থ স্বাভাবিক সম্পর্ক থেকে বিভিন্ন যৌথ উদ্যোগের কাজ গুলি। এবং চরম সুখের ললিপপ দেখিয়ে হতাশাগ্রস্ত-একাকীত্বে পাঠিয়ে আত্মকেন্দ্রিক বানিয়ে লুটে নিচ্ছে আমাদের দেশজ সম্পদ থেকে বৌদ্ধিক ও কায়িক শ্রম।
আমার লক্ষ্যের মধ্যে, ভোগবাদ বিভিন্ন ভাবে আমাদের মধ্যে নিজেকে প্রকাশ করছে;
১) যখন স্পষ্ট ভাবে বোঝা যায় কোন লোক ভুল পথে যাচ্ছে, তখন নীতিগত ভাবে যুক্তি তর্ক মাধ্যমে বিরোধিতা না করে তাকে আরো প্রশ্রয় দেওয়া। অথবা দরকারের খাতিরে সদ্ভাব বজায় রাখার জন্য হালকা ভাবে কিছু বলা, চূড়ান্তভাবে মীমাংসার চেষ্টা না করা। - যারফলে সংগঠন থেকে সম্পর্ক ও সার্বিক ভাবে ব্যক্তি থেকে সমাজ উভয় ক্ষেত্রেই সমান ক্ষতি হতে হয়।
২) নিজের মতামত সবার সামনে পরিষ্কার ভাবে না বলে, পেছনে কুটকাচালি করা। আত্মকেন্দ্রিকতার মোহে দায়িত্বজ্ঞান-হীন হয়ে সুযোগের সন্ধানে থাকা ও সমাজমাধ্যমে নানান ভাবে কুৎসা রটিয়ে দেওয়া।
৩) মিলেমিশে চলার প্রতি কোন শ্রদ্ধা না দেখিয়ে, অ্যাটেনশন পাওয়ার লোভে ব্যক্তিবাদী ঝোঁকে চলা; ঝোঁপ বুঝে কোপ মারবার আশায় থাকা।
৪) সবার মতামত অগ্রাহ্য করে, সামাজিক শৃঙ্খলতা দায়বদ্ধতা অস্বীকার করে শুধু বিশেষ বিশেষ সময়ে সুবিধা নেওয়ার ধান্দা খোঁজা।
৫) তথ্য-যুক্তি-প্রমাণ এর ধার না ধরে ‘রোমান্টিক’ তত্ত্ব দিয়ে নিজেকে আক্রান্তকারী হিসেবে দাঁড় করিয়ে অন্যের সিমপ্যাথি নেওয়া ও তার মধ্যে দিয়ে আরেকজন কে দোষী বানিয়ে হ্যারাস করা।
৬) নিজের নিজের করতে করতে অন্যের সুখ দুঃখের প্রতি উদাসীন থাকা।
৭) সমস্যা জিইয়ে জিইয়ে চলা, সুযোগে সুযোগে সেই সমস্যা ধরে কেবলি অশান্তি বাড়িয়ে, ভুলের বিরুদ্ধে নীতিগত ভাবে ঠিকের সংগ্রাম না করে ব্যক্তিগত আক্রমনের দ্বারা রাগ প্রকাশ করা, প্রতি হিংসা নেওয়ার চেষ্টা করা।
৮) সমস্ত বিষয় কে জগাখিচুড়ী পাকিয়ে, একই গোলকধাঁধায় বেঁধে -মঠের সন্ন্যাসীর মতন গেরুয়া বসন গায়ে জড়িয়ে ঘণ্টা বাজিয়ে যাওয়া।
৯) নিজের ভুলগুলো ধরতে পেরেও তা অস্বীকার করা এবং আরো বড় ভুলের দিকে এগিয়ে যাওয়া।
১০) তত্ত্বের খিচুড়ি বানিয়ে সামনে না বলে পেছনে গিয়ে পরনিন্দা পরচর্চা করা।
ভোগবাদ আরো একাধিক ভাবে নিজেকে প্রকাশ করে কিন্তু আমার দেখা এগুলোই প্রধান। এই ভোগবাদী অনুশীলনে লিপ্ত হওয়ার মধ্যে থাকে দীর্ঘদিনের উদারবাদী অনুশীলন। তাই লক্ষ্য করলে, এদের মিলও পাওয়া যায় বহু জায়গাতে।
ভোগবাদ একদিনে যেমন আমাদের পাকড়াও করেনি তেমনই মন্ত্র-পাঠ এর দ্বারা "ছু" করে যাবে না এটি একদিনে আমাদের ভেতর থেকে। এই ভোগবাদের বিরুদ্ধে আমাদের দৈনন্দিন সংগ্রাম চালাতে হবে, নিজস্ব জীবনে। নিজের ভেতর কে পরিস্কার রাখার জন্যে। ও তার সাথে সাথে বাইরেও এগুলির বিরোধতা করতে হবে, নীতিগত ভাবে, যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে। নইলে নিজের ভেতর পরিষ্কার হবে না কোন মতে ও সমাজের ক্ষতি হবে সার্বিক ভাবে। যেমনটা ঠিক আমরা নিজেদের কে পরিস্কার রাখতে প্রতিদিন দাঁত মাজি, স্নান করি ও নিজের বাইরে পরিষ্কার রাখতে -থাকবার জায়গা প্রতিদিন ঝাঁট দি, মুছি – তেমন ভাবেই এগুলি আমাদের ভেতর ও বাইরে থেকে পরিষ্কার করতে হবে। দুটোই সমানভাবে চালাতে হবে। আর এ কাজ করতে গিয়ে লক্ষ্যে স্থির থেকে মাথায় রাখার প্রয়োজন রয়েছে –আমরা পারবো করতে কিন্তু একা নয়, পারবো সবাই মিলে, যৌথ প্রয়াসের দ্বারাই সব করতে। যার থেকে আমাদের মনের ভেতরে আত্মবিশ্বাস বাড়বে, মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও কাজের প্রতি দায়বদ্ধতা জাগবে। আর মাথায় রাখতে হবে – ভুল হলো ঠিকের আগের পথ। এই ভুল ভাঙলে আমরা দুটো জিনিস পাবো, এক, আরো বড় ভুল করার ঝোঁক কিংবা অন্যায়; দুই, ঠিকের রাস্তার খোঁজ। প্রথমের টায় এগোলে আরো বড় গর্ত থাকবে আগামীতে, যার ভেতরে পড়লেই অঘোরে মারা পড়তে হবে আমাদের। আর দ্বিতীয় রাস্তায় যাওয়ার চেষ্টা করলে, আরো বহু মানুষের হাত পেয়ে আমাদের ভবিষ্যত- লক্ষ্য সুনিশ্চিত হয়ে ভাঙা গড়ার মধ্য দিয়ে এগোতে থাকবে। আজকের দিনে আমাদের সমাজে বিদেশী সাম্রাজ্যবাদী শোষণ চলছে মূলত আধাসামন্তবাদী-চক্র ও দালাল পুঁজির মাখোমাখো প্রেমের ভোগবাদী মোড়কের জালে। এই দুটোকে’ই সাম্রাজ্যবাদ সমানে ইচ্ছে মতন পরিচালনা করে আসছে। আমাদের ধর্ম ও চরম সুখের নেশায় মাতাল করে ফাটকা-দালাল পুঁজির বড় বড় ব্যবসায়ীদের ব্যবসা বাড়িয়ে নিজেদের ক্ষয়ে যাওয়া ভান্ডার পূরণ করছে। এদের হাত করে শোষণের চাকা এগিয়ে চলছে, বুলেট ট্রেনের গতিতে।
এ দেশের প্রধান শত্রু; সাম্রাজ্যবাদের বিশ্বস্ত দালাল হিন্দুত্ব ফ্যাসিবাদী আরএসএস-বিজেপি কে নিশ্চিহ্ন করতে আজ এই ভোগবাদ ও নানান ভোগবাদী সংস্কৃতির বিরোধিতা করবারও প্রয়োজন রয়েছে। নইলে এগুলো কে ধরেই –ফ্যাসিবাদী গণআন্দোলন আরো শক্তিশালী হবে; আমাদের দেশের খেটেখাওয়া মানুষের বিপুল সমর্থন নিয়ে।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।