কলকাতায় প্রেম হেঁটে বেড়ায় মাইলের পর মাইল, মনের আনন্দে। কত অজানা মন্দিরের অলিগলি, গুরুদ্বারের শান্ত পাঁচিল অথবা গির্জার নিরালা সেমেট্রি কিংবা জুম্মা পীরের দরগা সাক্ষী থেকে যায় প্রেমের কলকাতার ভালবাসার-মন্দবাসার কলকাতার। শহুরে হাওয়ায়, নীরব প্রেমের পথচলায় সঙ্গী হয় দূর থেকে ভেসে আসা আজানের সুর, কালীমন্দিরের আরতির ঘণ্টাধ্বনি যুগপত ভাবে। উত্তর কলকাতার হেদুয়ার পাড় ধরে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে যায় রোজ কত কত প্রেম-অপ্রেম।
জীবনের চেয়ে বড় নেশা আর নেই। সে নেশায় পা টলোমলো করে, দৃষ্টি ঘনিয়ে আসে, আমরা তবু মুখ তুলে আকণ্ঠ পানের জন্য এই আকাশ থেকে মাটি, জল থেকে বাতাস, সবুজ থেকে ধূসর - সকলকে ডেকে বলি - আরো দাও, আরো, আমার তৃষ্ণা যে মেটে নি। আমরা যুদ্ধ করে যাই মরণের সাথে, বলি - আরো জীবন দাও। আজ সকালে ওই পর্দার ফাঁক দিয়ে চুঁইয়ে পড়া আলো আমার বিছানার পাশে এসে পড়ল, তখন বুঝলাম বিগত চার দিনে জীবনের নেশা গাঢ়তর হয়েছে। যাত্রা থেমে গেছে কাল রাতেই, তবু দিনের আলোয় তার খোয়ারি ভাঙে নি মোটে – ধীরে, অতি ধীরে নিঃশব্দ পদসঞ্চারে আমার মধ্যে সে আরো গভীরে ঢুকে পড়ছে, আমায় আচ্ছন্ন করছে – যেন নেশাতুর আমি এখনো সেইসব ঘাসে, জলে, পদ্মের বনে, হলদে পাখির ডানায় রয়ে গেছি। আছি – আছি – আছি – সেখানেই আছি আজও -।
নেহাৎ কিছুই নেই এখন, না তাতে আক্ষেপ করছি না। বরং জানি এই না-থাকাটা অনেক জরুরী। একটা কাদার তাল, একটা সাদা পাতা, বেশ একটা মিনিট চল্লিশের নির্ঝঞ্ঝাট অবকাশের তুলনা কমই আছে। কিছু না থাকলেই সব থাকে, মানে যা খুশি তাই। মানে একটা শব্দ, যাকে কারও পাশে বসাই, যে কোনও চিন্তা ভাবনা ঘটকালি, কাঠপুতুল যেই হোক ভালো লাগে। তার আগে অবশ্য জানলা খুলতে হয়, হাওয়া আসতে দিতে হয়, ফুটতে দিতে হয় ভাবনার সম্পৃক্ত দ্রবণ, খুব ধীরে ধীরে রাতের বারান্দায়। ঝুল কালি তেল জমে চিমনিতে, দু-একটা শব্দদানা ফেলে দিলে তার আঙুল ধরে বুনে বুনে ওঠে বাকি শব্দরা। নিজেরাই গড়ে ওঠে। পাশাপাশি থেকে পরিচিত হয়, কেউ তেমন পরিচিত নন, হয়ত মফস্বলের, একটু দুরে চুপ করে রয়েছেন আনাড়ি পোশাকে – হয়ত বিয়েবাড়িতে কালো মাফলার। কেউ ঠাট বাট নিয়ে আসরে মধ্যমণিটি। তাকে ঘিরে অনেকের চটুল ফোয়ারা।
বরং কিছু থাকলে এসব কিছুই হয় না। সেইই সব আলো মনোযোগ টেনে নেবে। যা দেখাতে চাইবে তাই দেখতেই হবে। বেড়াতে টেড়াতে গেলে যা হয়। সবাই এক জায়গায় গোল হয়ে বসে কথা ছুড়ে ছুড়ে লোফালুফি খেলা চলছে। একটা সময় “ধুত্তোর” বলে উঠে পড়ি। বাইরে অনেক তারা, কয়েকটি যেন জোনাকির ছদ্মবেশে রাত ফুলের গন্ধ শুঁকতে নেমে আসে।
পাতা উলটে যাই, বুঝতে চাই শব্দের রহস্যগুলি, কেন কীভাবে শব্দ আসা যাওয়া করত, এখনও করে দেখি কিছু কিছু লেখায়, কারও কারও লেখায়। জাদুমন্ত্র টন্ত্র বিশ্বাস করতে পারলে এতটা অন্তত অস্থির লাগত না, সেটা বলতে পারি। একলা খুঁজতে যাই, বারান্দায়, আকাশ দেখি রাতের শহরতলির। যদিও বারান্দা থেকে নক্ষত্র দেখি না আমি প্রায় কখনই আজকাল। হয়ত নক্ষত্র নেই। সব মরে গেছে বহুদিন আগে কোনও দেওয়ালিতে। বহুদিন সমুদ্রে যাই নি, মাঝে মাঝে আবোলতাবোল শিশু যদিও আজও চোখে পড়ে, চোখে পড়ে হেমন্তের ঝরা পাতা। দেখার কিছুই নেই, না থাকলে জানি শব্দরা আসে দল বেঁধে কখনও বা একা, চেনাশোনা তেমন হয়ে ওঠেনি বলে সেই ছন্দ শিখি নি যদিও। এতে দিব্য চলে যায় তবু, যদি থাকে একতাল মাটি, মিনিট চল্লিশের অফুরান অবকাশ আর সেলফোনের এক সাদা পাতা।
“Love is a smoke and is made with the fume of sighs” রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট’-এর একেবারে গোড়ায় এ কথা বলেছিলেন স্বয়ং শেক্সপিয়র। প্রেমকে ব্যাখ্যা করছেন দীর্ঘশ্বাস দিয়ে তৈরি ধোঁয়া হিসেবে। শুধু প্রেম বললে ভুল হবে, প্রথম প্রেমকে। কারণ কে না জানে, রোমিও আর জুলিয়েটের মতো প্রথম প্রেমের নজির বিশ্বসাহিত্যে খুব কমই আছে। আর এও সকলেই জানে, শেক্সপিয়র খুব একটা ভুল বলেন না।
এমন সন্ধে আমরা কেইবা কাটায়নি? সেই মেয়েটির বা সেই ছেলেটির নাম এখন বলতে চাইব না কেউই, কিন্তু তার পর্দা টানা জানলার দিকে ঝাপসা চোখে তাকিয়ে সন্ধেবেলার কত পথ, বাসে-ট্রেনে পাশের সিটে বসে অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছি আমরা। আজও কি তাই হয়?
টিভির বিজ্ঞাপন বলে, প্রেম ভেঙেছে তো কী হয়েছে, মুভ অন। সময়টাকে কব্জিতে বেঁধে রাখো। আর ‘চন্দ্রবিন্দু’ বলে, “যদি বলো আড়ি, তোমাকেও ছেড়ে যেতে পারি”।
আমাদের সবার বাতিল শার্টের পকেটে আজও এই রকম কোনও না কোনও বাসের-ট্রেনের আবছা টিকিট সন্তর্পণে জমানো আছে।
কিন্তু আমি জানি মুখোশের কথা। যে মুখোশ প্রতিটি মানুষ পরে থাকে। যার কথা রিলকে বলেন –
No one lives his life.
Disguised since childhood,
haphazardly assembled
from voices and fears and little pleasures,
We come of age as masks.
Our true face never speaks.
বিজ্ঞানের ভাষায় বলা যায়, মনস্তাত্ত্বিক ব্যূহ। দেহের আবরণ সরানো অনেক সহজ, শরীরী ক্ষত দ্রুত সেরে যায় আর বেশির ভাগ সময়েই, চিহ্ন রয়ে যায় শুধু অগভীর ক্ষতের। কিন্তু মূলত যে মন, সমস্ত চেতনা নিয়ে আমার যে আত্মা, তাকে কেন অনাবৃত করব সবার কাছে?
কিন্তু প্রেম? উচ্চতম সম্পর্ক? সেখানেও কি অবিশ্বাসের ছায়া থেকে যাবে? এও সেই সাংস্কৃতিক রূপকথার খেলা, প্রেম শুরু তো বিশ্বাসও শুরু, প্রকৃতপক্ষে যা মেলে না। বিশ্বাস অর্জন করতে হয়, যার জন্য লাগে সময়।
টিনএজ চেতনায় গড়ে ওঠা যে প্রেম নামক সম্পর্কের ধারণা, তা বাস্তব জীবনের সব অভিঘাত, অভিজ্ঞতা, চেতনার বয়সোচিত অভিযানকে অস্বীকার করে, দূরে ঠেলে রাখে। ভালবাসা আর বিশ্বাস যে প্রথমেই অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত থাকে না, তা মেনে নেওয়া যায় না কিছুতেই।
যে মুহূর্তে আমি দাবি করব আমার প্রেমিকার নগ্ন মুখ ও আত্মা, সেই মুহূর্তেই হয় আমি নিজের মুখোশ যথাযথ রেখে দেব নয়তো নিজের ক্ষেত্রে কোন মুখোশের অস্তিত্বই অস্বীকার করব।
খলিল জিব্রান বলে গিয়েছেন সত্যি কথাটি –
Give your hearts, but not into each other’s keeping.
For only the hand of Life can contain your hearts.
And stand together, yet not too near together:
For the pillars of the temple stand apart,
And the oak tree and the cypress grow not in each other’s shadow.
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।