এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • রাষ্ট্র-বিভাজন থেকে দেশভাগ

    Somnath লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৯ জানুয়ারি ২০২৩ | ১৩৭১ বার পঠিত | রেটিং ৪.৫ (২ জন)
  • (খড়গপুর বইমেলা স্মারকসংখ্যা ২০২৩)-এ প্রকাশিত

    ১৯৪৮ সালের ২৬শে জানুয়ারি, গান্ধীজি তাঁর বক্তৃতায় বলেন স্বাধীনতা সংগ্রামের দিশারী হিসেবে জাতীয় কংগ্রেসের যে সাংগঠনিক প্রাসঙ্গিকতা ছিল, তা ফুরিয়েছে। জাতীয় কংগ্রেসকে ভেঙে দেওয়ার সময় এসেছে। কংগ্রেসকর্মীদের উদ্দেশ্যে বলেন যা তাঁরা সারা দেশের সাতলক্ষ গ্রামে ছড়িয়ে মানুষের জীবনযাত্রা উন্নয়নের কাজে নামুক। অধ্যাপক নির্মল কুমার বসুর ‘মাই ডেজ উইথ গান্ধী’ বইয়ে এই বক্তৃতার চুম্বকসার পাওয়া যায়। এইখানে অধ্যাপক বসু একটা আশ্চর্য বিষয়ের প্রতি নজরটান দেন- তা হল, এই সাতলক্ষ গ্রাম তো স্বাধীন ভারতে নেই। তা ছিল পরাধীন ব্রিটিশ ভারতে, অর্থাৎ, ভারত ও পূর্ব-পশ্চিম পাকিস্তান ব্যাপী সমস্ত গ্রামের উন্নয়নে কংগ্রেসকর্মীদের অংশগ্রহণের কথা গান্ধীজি বলেছিলেন, স্বাধীনতার পরের প্রথম ২৬শে জানুয়ারিতে। কিছু সূত্রের মতে এইসময়ে তিনি পাকিস্তানে পদযাত্রার কথাও ভেবেছিলেন। দুর্ভাগ্য, ইতিহাস তাঁকে সেই সুযোগ দেয় না। এই বক্তৃতার কয়েকদিনের মধ্যেই গান্ধীহত্যা হয়।
    ১৯৪৭-এর ১৫ই আগস্টের পর থেকে এই ভূখণ্ডের বাস্তব পরিস্থিতি হয় যে এখানে দুটি সার্বভৌম রাষ্ট্র পাশাপাশি অবস্থান করে- ভারত ও পাকিস্তান। ঘটনা হচ্ছে, এর আগে ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে এই ভূখণ্ডে বহু রাষ্ট্র পাশাপাশি অবস্থান করেছে। যেমন ধরুন, গৌতম বুদ্ধ বৈশালী থেকে মগধ দুটি পৃথক রাষ্ট্রে সদ্ধর্ম প্রচার করেছেন। কিম্বা ব্রিটিশরা আসার সময়েও মুঘল আর আসাম রাষ্ট্রদুটি পাশাপাশি থেকেছে। তাদের মধ্যে সবসময় সদ্ভাবও ছিল না, যুদ্ধবিগ্রহও ঢের চলত। কিন্তু মানুষের যাতায়াত, আদানপ্রদান, আত্মীয় কুটুম্বিতার কমতি পড়ত না তাতে। এইদেশের সহস্র সমাজনেতা একাধিক রাষ্ট্র, একাধিক রাজার সার্বভৌম কর্তৃত্বে থাকা এলাকা জুড়ে নিজেদের সম্প্রদায় গড়ে তুলেছেন। ফলে, গান্ধীজির ভারত পাকিস্তান জুড়ে সামাজিক কাজের যে পরিকল্পনা তা ইতিহাসের বিচ্যুতি বলে মনে হয় না। কারণ, রাষ্ট্রগত পরিচয় বাদ দিলে, দেশ শব্দটা আমরা যে ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করি, সেই অর্থে দেশের ধারণা, ভারত বা হিন্দ-এর ধারণা, এই ভূখণ্ডের মানুষকে একসূত্রে বাঁধত। অথচ, আজকের পরিস্থিতির কথা আমরা যদি ভাবি, ভারত-পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ কখনওই নিজেদেরকে এক দেশের বাসিন্দা ভাবে না। ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে না হয় বিভিন্ন যুদ্ধের মধ্য দিয়ে যথেষ্ট বৈরিতা গড়ে উঠেছে। কিন্তু, ভারত-বাংলাদেশের মানুষও কি নিজেদের একই দেশের ভাবেন? ধর্ম বা ভাষার অন্তরায় বাদ দিয়ে, ভারতের বাঙালি হিন্দু (বা মুসলমান) আর বাংলাদেশের বাঙালি হিন্দু(বা মুসলমান)-এর মধ্যে পারিবারিক আত্মীয়তা, বিবাহসূত্রের মতন সহজ সম্পর্কও কি আজ সম্ভব? আমরা জানি, সাধারণভাবে উত্তরটা না। এমনকি, সংস্কৃতি বা ক্রীড়ার ক্ষেত্রেও এই দুই ভূখণ্ডের মধ্যে আদানপ্রদান সীমিত। বিভিন্ন মেলা, মৈত্রী অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়েও এই সম্পর্কের সহজতা আসেনি। তাহলে সম্ভবতঃ, দেশভাগ বিষয়ে আজকের দিনের সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, রাষ্ট্রিক ভাগাভাগি, আইনপ্রণেতা সভার বিভাজন কীভাবে ইতিহাসজুড়ে অবিচ্ছিন্ন দেশকে আলাদা করে দিতে পারল?
    এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে সম্ভবতঃ আমাদেরকে দ্বিজাতিতত্ত্ব এবং পাকিস্তান-আন্দোলনের দিকে তাকাতে হবে। আর, তার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিকেও মাথায় রাখতে হবে। এই কথা স্মর্তব্য, যে ভারতের প্রাক-ব্রিটিশ ইতিহাসে সাধারণ হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে গোষ্ঠীসংঘর্ষের একটিও নজির নেই। ধর্মীয় সংঘর্ষ বলে যা চিহ্নিত হয়, তা সবই রাজা বা তার সৈন্যবাহিনীদের দ্বারা সংঘটিত- রাজা-রাজার দ্বন্দ্ব বা রাজা-প্রজার সংঘাতের ফল। আসলে ব্রিটিশ যুগের আগে, এই দেশে রাজার ক্ষমতা সীমায়িত ছিল, আইন-কানুনের ক্ষেত্রেও বড় ফৌজদারি অপরাধ বা কর-ফাঁকে সংক্রান্ত মামলা বাদ দিলে বাকি সব বিচারের ভারই সমাজপতিদের হাতে ছিল। আমরা দেখব, এই  দেশের যুগনায়ক যাঁরা, যেমন শ্রীচৈতন্য, নানক, তুকারাম প্রমুখ, রাজনৈতিক ক্ষমতা হাতে নেওয়ার বদলে সমাজসংস্কারের কাজকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। কিন্তু, ব্রিটিশরা সামাজিক ক্ষমতার পরিসরকে ক্রমশঃ সংকুচিত করে পেশাদার আইনজীবী পরিচালিত আদালতকে শক্তিশালী করে তোলে। তারা মূলতঃ ধর্মীয় অনুশাসন মেনে এইদেশের হিন্দু ও মুসলমানকে শাসনের জন্য কোড (দেওয়ানি বিধি) তৈরি করে, যার মধ্যে স্থানিক বা জাতি-গোষ্ঠীগত নমনীয়তা কম থাকে। গান্ধীজি হিন্দ-স্বরাজ গ্রন্থে মন্তব্য করেন যে উকিলরা কেস জেতার জন্য সম্পত্তির মামলা-কে সাম্প্রদায়িক রঙ দিচ্ছে, এবং তাঁর মতে এই দেশে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের সূত্রপাত সেইখান থেকেই। দ্রষ্টব্য, নিজের পেশাদারি জীবনে তিনিও আইনজীবীই ছিলেন এবং মূলতঃ সম্পত্তির মামলা লড়তেন। এই পরিস্থিতিতে, ক্রমশঃ হিন্দু ও মুসলমান নিজেদের ব্যবহারিক ক্ষেত্রেও দুটি জাতি হিসেবে গণ্য করতে শুরু করে। সামাজিকভাবে হিন্দু-মুসলমানের যে মিলমিশ ছিল, আইনের পরিসরে এসে তা ভেঙে যেতে শুরু করে। রাজা-প্রজার দ্বন্দ্বও প্রতিফলিত হয় হিন্দু-মুসলমানের সংঘর্ষ হিসেবে। এর পাশাপাশি, ব্রিটিশদের বিভিন্ন বিভেদমূলক প্রকল্প তো ছিলই। শিক্ষা ও চাকরির সুযোগ দুই সম্প্রদায়ের জন্যে পৃথকভাবে তৈরি হচ্ছিল। ক্রমশঃ হিন্দু ও মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের নেতৃস্থানীয়দের মধ্যে থেকে এই দাবি উঠতে শুরু করে যে এরা দুটি পৃথক জাতি এবং এদের পৃথক রাজনৈতিক প্রতিনিধত্ব চাই। ১৯৪০ সালে যখন মুসলিম লিগ লাহোর প্রস্তাব করে, তার মধ্যে এই দ্বিজাতিতত্ত্বের একটা সামগ্রিক চেহারা প্রকাশ পায়। লাহোর প্রস্তাবে ভারতের পূর্ব ও উত্তরপশ্চিম অঞ্চলে স্বশাসিত রাজ্যসমূহ তৈরির কথা বলা হয়, যেখানে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের নির্ধারক হবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান। এই রাজ্যগুলিতে সংখ্যালঘুর নিরাপত্তা ও প্রতিনিধিত্বের সার্বিক সুরক্ষা থাকবে। এই প্রস্তাবে এও বলা হয়, বাকি ভারত হিন্দুপ্রধান হওয়ায়, সেখানকার সংখ্যালঘু মুসলমানের নিরাপত্তা মুসলিমপ্রধান রাজ্যগুলির সংখ্যালঘুর নিরাপত্তা সমরূপে নিশ্চিত হবে। এই ‘ and in other parts of India where the Mussalmans are in a minority’বাক্যবন্ধটি নিশ্চিতরূপেই বোঝায় যে লাহোর প্রস্তাব ভারত বা ইন্ডিয়া থেকে আলাদা হয়ে কোনও রাষ্ট্রনির্মাণের কথা বলেনি। এতদ্ব্যতীত লাহোর প্রস্তাবে মুসলিমপ্রধান একাধিক স্বায়ত্তশাসিত  রাজ্য (states) নির্মাণের কথা ছিল, পূর্বপাকিস্তানের (অধুনা বাংলাদেশ) নেতারা তাই পাকিস্তান রাষ্ট্রগঠনকে লাহোর প্রস্তাবের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা বলে অভিহিত করতেন। আমরা দেখব তাঁদের একটা বড় অংশ স্বাধীনতার প্রাক্‌মুহূর্ত অবধি পৃথক বাংলা গঠনের কথা বলতেন। যাই হোক, লাহোর প্রস্তাবের পরের বছরগুলিতেও, ১৯৪০-১৯৪৭, এই পুরো পর্যায়টাতেই মুসলিম লিগের বিভিন্ন নেতা (এমনকি জিন্না নিজেও স্বয়ং) এই আশ্বাস দিয়ে গেছেন যে পাকিস্তান মানে সম্পূর্ণ আলাদা রাষ্ট্র নয়। ক্যাবিনেট মিশনের রাজ্যগ্রুপিং এবং ভারতের পূর্ব-মধ্য-উত্তরপশ্চিম মিলিয়ে তিনটে গ্রুপের এক ফেডারেশনে মুসলিম লিগ সায় দিয়েছিল।
    ১৯৪৬-৪৭ সাল থেকে এই দেশে একাধিক হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা হয়, তার সূচনা পূর্বভারতে (কলকাতা, নোয়াখালি, বিহার) হলেও ১৯৪৭ সালে পাঞ্জাবের দাঙ্গা পরিস্থিতি বীভৎসতম হয়ে ওঠে। খেয়াল করবার যে ১৯৪৭-এর শুরুতেও, যখন প্রায় সমস্ত মুসলিমপ্রধান রাজ্যে অন্তর্বর্তী সরকার মুসলিম লিগের, পাঞ্জাবে তখনও একটি নন-মুসলিম লিগ সরকার ছিল। কিন্ত ১৯৪৭-এর দাঙ্গায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটলে এই সরকারকে সরে যেতে হয়, ব্রিটিশ ভারতের ইতিহাসে যা সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী ঘটনা। ১৫ই আগস্টের দেশভাগের আগেই পাঞ্জাবের বিধানসভাকে পূর্ব ও পশ্চিমে ভেঙে দিতে হয়। অর্থাৎ, একবছরের সময়ক্রমে নজিরবিহীন দাঙ্গা পরিস্থিতি এই দেশে তৈরি হয়, যা বিভাজনকে অবশ্যম্ভাবী করে তোলে। এইবার, আমাদের একটু আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির দিকে দৃষ্টি ঘোরাতে হবে। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে। যুদ্ধের সময় আমাদের দেশ এক বিশাল মন্বন্তর দেখেছিল। যুদ্ধের অব্যবহিত পরে শুরু হল বেকারি ও দারিদ্র্য। পাঞ্জাব থেকে বিশাল সংখ্যক সৈন্য যুদ্ধে গিয়েছিলেন, দেশে ফিরে তাঁদের কাজ বা রোজগার থাকল না। এবং মিলিটারি ট্রেনিং থাকায় তাঁদেরকে সহিংস কর্মকাণ্ডে এগিয়ে দেওয়া সহজ হল। এইসবের পাশাপাশি, আন্তর্জাতিক মহলে একটা বড় ঘটনা ঘটে গেছিল, তা হল পোস্টড্যাম সম্মেলন। ১৯৪৫-এ যুদ্ধজয়ের পরে ব্রিটিশ আমেরিকান এবং সোভিয়েত রাষ্ট্রপ্রধানরা জার্মানির পোস্টড্যাম শহরে মিলিত হন। সেখানে তারা বিজিত অঞ্চলগুলির ভাগবাঁটোয়ারা করেন। জার্মানি, ভিয়েতনাম (তৎকালীন ইন্দোচীন), কোরিয়া প্রভৃতি দেশকে একাধিক রাষ্ট্রে ভেঙে ফেলবার সিদ্ধান্ত নিলেন। যেহেতু এই নেতারা আলাদাধরণের সমাজব্যবস্থায় বিশ্বাস করতেন, এই রাষ্ট্রের জনগণকেও সেই ছাঁচে ফেলবার পরিকল্পনা তারা করলেন। আমরা দেখব দুই কোরিয়া বা দুই জার্মানির মধ্যে সমস্তধরণের সংযোগ ক্রমশঃ বন্ধ হয়ে আসবে, তারা সামাজিকভাবেও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। আন্তর্জাতিক মহলে এই ধারণাও থাকল যে দেশগুলিকে পুনর্গঠন করতে হলে এই বিভাজন আবশ্যিক। লক্ষ্যণীয় যে, ক্যাবিনেট মিশন এবং তার পরবর্তী পর্যায়ে, আমাদের দেশের কংগ্রেসের তথাকথিত বাম-প্রগতিশীল অংশও ক্রমশঃ এরকম বিভাজিত দেশের ধারণার প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকেন। আমরা খেয়াল করতে পারি, এই পর্যায়ে, দেশভাগের বিরুদ্ধে বাংলার কংগ্রেস কিম্বা বিপ্লবী দলগুলি বা কমিউনিস্টরাও কোনো দৃশ্যমান আন্দোলন গড়ে তোলেনি। ভারতের একটি রাজ্য কিন্তু ক্যাবিনেট মিশনের গ্রুপিং-এর বিরুদ্ধে সত্যাগ্রহ করে গ্রুপ থেকে বেরিয়ে আসে, তা হল আসাম। পাঞ্জাবে ইউনিয়নিস্ট পার্টির নেতারা কিম্বা বালুচিস্তানের পাঠান নেতারা দেশভাগের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেন। কিন্তু বাংলায় কংগ্রেসের হাতেগোনা দু-চার জন নেতা ভিন্ন এই আন্দোলন দেখা যায় না, সেই আন্দোলনও মুসলিম লিগের একাংশের সঙ্গে হাত মিলিয়ে পৃথক বাংলা রাষ্ট্রের দাবিতে  ছিল। কিন্তু, ব্যাপক সংগঠিত গণ-আন্দোলন গড়ে তোলার কোনও প্রয়াস তথাকথিত প্রগতিশীল ও ধর্মনিরপেক্ষ শিবিরের মধ্যে দেখা যায় না। বরং আমরা দেখতে পাই ঢাকার নবাব সই সংগ্রহ করছেন দেশভাগের বিরুদ্ধে।
    দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে এলাকা ভাগাভাগির ছায়া ভারতের স্বাধীনতায় পড়ছে বলে বোধ হয়। পরবর্তীকালেও ভারত-পাকিস্তান দুই দেশকে দেখি বিশ্বব্যবস্থার দুটি পৃথক অক্ষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠতে। বাংলাদেশ যুদ্ধের সময় আমেরিকা ও সোভিয়েতের অবস্থান এই চেহারা আরও স্পষ্ট করে। উক্ত দুই বিশ্বব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় শক্তি সমাজে মতাদর্শবিকাশের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কোরিয়া বা জার্মানিতেও সামাজিক সম্পর্ক ভেঙে যায় রাষ্ট্রীয় পরিচিতির সামনে। জার্মানির ক্ষেত্রে সোভিয়েতপতনের পরে যে বিভাজন ঘুচলেও কোরিয়া আজও সেই অবস্থার থেকে বেরোয়নি। ভারত ভূখণ্ডের ক্ষেত্রেও স্বাধীনতার পরের সমস্ত সময়টাই রাষ্ট্রশক্তিগুলি সামাজিক মিলনের ঊর্ধ্বে রাষ্ট্রীয় বিভেদকে তুলে ধরতে চেয়েছে। ভারত-বাংলাদেশ-পাকিস্তানেও আমরা দেখতে পাই, বিভিন্ন অসাম্প্রদায়িক দল, কমিউনিস্ট পার্টিও, এই বিভাজন ঘুচিয়ে তিনদেশের সামাজিক সমন্বয়ের কাজে কখনোই হাত দেয় নি। বরং ইউরোপ আমেরিকার নির্ধারিত রাষ্ট্রপরিচিতির পথেই হেঁটেছে। আর, দেশের সমাজের এই বিভাজনের ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশগুলির সংখ্যালঘুরা। লাহোর প্রস্তাব আমরা যদি দেখি, সেখানে সবচেয়ে জোর দিয়ে বলা ছিল তৎকালীন ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে সংখ্যালঘুদের সুরক্ষার কথা। অথচ রাষ্ট্রবিভাজন ও তার পরের ঘটনাক্রমে ধনে মানে সবচেয়ে বিপন্ন হয়েছে সংখ্যালঘুরাই।

    লাহোর প্রস্তাব যিনি পাঠ করেছিলেন, শেরে বাংলা ফজলুল হক ১৯৫৪ সালে পূর্বপাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে কলকাতায় এসে বলেন- “বাঙালি এক অখণ্ড জাতি। তাঁহারা একই ভাষায় কথা বলেন এবং একই সুসংহত দেশে বাস করে। তাঁহাদের আদর্শ এক এবং জীবন ধারণের প্রণালীও এক। বাংলা অনেক বিষয়ে সারা ভারতকে পথপ্রদর্শক করিয়াছে এবং দেশ বিভাগ সত্ত্বেও জনসাধারণ তথাকথিত নেতৃবৃন্দের ঊর্ধ্বে থাকিয়া কাজ করিতে পারে। আজ আমাকে ভারতের ভবিষ্যৎ ইতিহাস গঠনে অংশগ্রহণ করিতে হইতেছে। আশা করি ‘ভারত’ কথাটির ব্যবহার করায় আপনারা আমাকে ক্ষমা করিবেন। আমি উহার দ্বারা পাকিস্তান ও ভারত উভয়কেই বুঝাইয়াছি। এই বিভাগকে কৃত্রিম বিভাগ বলিয়াই আমি মনে করিব। আমি ভারতের সেবা করিব।” দুর্ভাগ্য, এই সমন্বয়ী উদ্যোগ এইদেশে অধুনা নেওয়া হয়নি বললেই চলে!
     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • | ১৯ জানুয়ারি ২০২৩ ১৩:০৩515526
  • পড়লাম। 
    রেফারেন্স বইগুলোর নাম থাকলে ভাল হত। 
  • Somnath | ১৯ জানুয়ারি ২০২৩ ১৫:৩০515529
  • ধন্যবাদ।
     
    গান্ধিজির বক্তব্য নিয়ে বইয়ের রেফারেন্স দিয়েছি। ফজলুল হকের  বক্তব্যটি https://nobojagaran.com/sher-e-bangla-ak-fazlul-haque-holder-and-bearer-of-non-communal-bengaliness/ পোর্টাল থেকে নেওয়া। উক্ত পোর্টালে লেখক সূত্র দিয়েছেন।
    লাহোর প্রস্তাব ও পরবর্তী ঘটনাক্রম ইতিহাসের বিভিন্ন মান্য বইয়ে পাওয়া যাবে।
    ঢাকার নবাবের পার্টিশন বিরোধী উদ্যোগের কথা স্মিতা জসসালের The partition motif in contemporary conflicts বইয়ে আছে।
  • সালেকীন | 103.109.***.*** | ২৩ জানুয়ারি ২০২৩ ১১:২৭515644
  • ভালো লেখা। গৎবাঁধা দেশভাগের ফিরিস্তির বাইরে নতুন চিন্তাভাবনা।  ধন্যবাদ। 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যুদ্ধ চেয়ে মতামত দিন