এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • শৈশবের স্মৃতিমালা এবং তাহাদের কথা - পর্ব ১৭ (শেষ পর্ব )

    Supriya Debroy লেখকের গ্রাহক হোন
    ২৩ ডিসেম্বর ২০২২ | ৩১৬ বার পঠিত | রেটিং ৪ (১ জন)
  • রূপম-ঝুমঝুম-বুলুদি-দুলু-পল্লব এবং আরো অনেকে মিলে দেখে এসেছিলাম বলরাজ সাহানির 'ঘর ঘর কী কাহানি' সিনেমা। হিন্দি কিছুই বুঝতাম না, কিন্তু ভাই-বোনেরা একসাথে সিনেমা দেখা - সেটাতেই আনন্দ লুকিয়ে ছিল।
    পরবর্তী জীবনে কাকিমণির স্নেহ এবং শাসন দুটোই পেয়েছি। পরবর্তী কালে মায়ের উপদেশে আমার স্ত্রী এবং ভাইবৌ কাকিমণিকে 'মেজোমা' বলেই সম্বোধন করে। 
    ****
    ১৯৭১ সালের শেষের দিকে বাবা নৈহাটিতে বদলি হওয়ার খবর পেয়েছিলেন। যেহেতু ডিসেম্বরের শেষের দিকে ছিল, তাই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল যে আমরা এখন বারাসাতে ফিরে যাব।  বাবা কোয়ার্টার ইত্যাদির ব্যবস্থা করে নৈহাটিতে স্থায়ী হতে কিছুটা সময় নেবেন। আমাকে এবং পল্লবকে বারাসতের স্কুলে ভর্তি করা হবে, সত্যভারতী স্কুলে। সুন্দরদাদু কথা বলে রেখেছিলেন আগে থেকে, যাতে আমাদের দুই ভাইকে স্কুলে ভর্তি করে নেওয়া হয়। দিদি এইচএস বোর্ড পরীক্ষায় অংশ নিতে মা-র সাথে মার্চ মাসে দুর্গাপুরে আসবে। কাকিমণির দিদি দুর্গাপুরে থাকেন। ওনাদের বাড়িতে থেকে  দিদি পরীক্ষা দেবে, সেইরকম ঠিক করা হয়। 
    যদিও দুর্গাপুর ছেড়ে যাওয়ার একটা কষ্ট হচ্ছিলো ভিতরে, কিন্তু আবার বারাসাতে ফিরে যাওয়া - আবার দাদুভাইয়ের সান্নিধ্য পাওয়া - দাদুভাইয়ের সাথে সকালে প্রাতঃভ্রমণ, বিকেলে শিবানন্দ ধাম - ঘুমানো একসাথে দাদুভাইয়ের সাথে - মনটা একটা অনাবিল আনন্দ আর উৎফুল্লতায় ভরিয়ে দিচ্ছিলো। আমার শৈশবকালের প্রথম কয়েকটি বছর এমনভাবে দাদুভাইয়ের সাথে জড়িয়ে গিয়েছিল, যার সুখস্মৃতি জগতের যে কোনো সুখের চেয়ে বেশি উপভোগ্য মনে হতো।
    সেই সময় দাদাভাই তার এক বন্ধুর সাথে দুর্গাপুরে এসেছিল বেড়াতে। আমার সপ্তম শ্রেণীর পরীক্ষা হয়ে গেছে, রেজাল্টও বেরিয়ে গেছে। আমি তখন বায়না করতে থাকি, দাদাভাইয়ের সাথে বারাসাতে চলে যাওয়ার জন্য। ঠিক হলো আমি দাদাভাইয়ের সাথে বারাসাত চলে যাব, পরে বাবা-মা দিদি ও পল্লবকে নিয়ে আসবেন। দিদির তখনও টেস্ট পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোয়নি।   
    সেই সময় দুর্গাপুর থেকে শিয়ালদহ যাওয়ার জন্য সবচেয়ে সুবিধাজনক ট্রেন ছিল পাঠানকোট মেল। আমাদের যাওয়ার দিন, ট্রেনটি বেশ কয়েক ঘন্টা দেরিতে রান করছিল। তখন দাদাভাইয়ের বন্ধু পরামর্শ দেয়  যে তার এক খুড়তুতো ভাই একটি গ্রামে থাকে, স্টেশনের খুব কাছে। আমরা তাদের সাথে দেখা করতে পারি। আমার এ কথা বলার কারণ, ওই আত্মীয়ের বাড়িতে যাওয়াটা ছিল স্মরণীয়। বাড়িটি ছিল একটি সাধারণ কাচ্চা মাটির বাড়ি যা আমরা গ্রামে দেখতে পাই। মাটি, কাঠ এবং খড় দিয়ে তৈরি। আমরা পৌঁছতেই বন্ধুটির ভাই এবং ওনার স্ত্রী ব্যস্ত হয়ে পড়েন আপ্যায়ন করতে। আমাদের হাতে যেহেতু বেশি সময় ছিল না, সাথে সাথে আমাদের জন্য আলু সেদ্ধ এবং ডিমের ঝোল রান্না করে দেন। কুঁড়েঘরটির বাইরে মাটির উঁচু বারান্দায় বসে আমরা খেতে বসি। এত তৃপ্তি করে সেদিন আমি খেয়েছিলাম, আজও মনে আছে। ডিমের ঝোলের অপূর্ব স্বাদ এখনও জিভে লেগে আছে। দুর্গাপুর ছাড়ি একটা সুখস্মৃতি নিয়ে।  
    আমরা যখন শিয়ালদহ স্টেশনে পৌঁছলাম, স্টেশনের দেওয়ালে কয়েক মাস আগে দুর্গাপুরে ঘটে যাওয়া অপ্রীতিকর ঘটনার বিষয়ে হাতে লেখা কিছু পোস্টার দেখতে পেলাম। এক রাজনৈতিক দল অন্য রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে দোষারোপ করছে। যার সাথে প্রকৃত ঘটে যাওয়া ঘটনাটির কোনো মিল নেই। ঐ বয়সেই আমি নিজেই বুঝতে শুরু করি যে, কোনও রাজনৈতিক দল কীভাবে প্রকৃত চিত্রকে বিকৃতি করে সাধারণ জনগণকে উস্কে দেওয়ার চেষ্টা করে। আমি শৈশবকাল কাটিয়ে তখন কৈশোরে প্রবেশের মুখে। পুরোপুরি সবকিছু বুঝতে না পারলেও - সংবাদপত্রে নকশাল আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলী পড়ে একটু একটু করে ছাপ ফেলতে শুরু করেছিল মনে। 
    আমরা বারাসাতে পিসিমণির বাড়িতে পৌঁছলাম খুব গভীর রাতে, যখন সবাই ঘুমাচ্ছিল। কোনোরকমে পিসিমণি আমার আর দাদাভাইয়ের জন্য কিছু খাবারের ব্যবস্থা করেন। আমি যখন বুলু-দি ও দুলু'র সাথে একই লেপের তলায় শুতে গেলাম, দেখি তারা দুজনেই জেগে আছে। আমার সাথে গল্প করার জন্য। আমাদের আসার আওয়াজে ওদের ঘুম ভেঙে যায় এবং তখন থেকে জেগে অপেক্ষা করছে। সারা রাত আমরা গল্প করে কাটাই, কত গল্প যে আমাদের জমে গিয়েছিল, সেই কাকুমণির বিয়ের পর থেকে ! দুর্গাপুরের গল্প, বারাসাতের গল্প। কিছুক্ষণ পরে দেখি বুলুদি, দুলু ঘুমে কাদা।
    আর আমি ভাবছি কখন সকাল হবে। সমস্ত শরীরে, মনে বিরাট উত্তেজনা। একছুটে মাঠ পেড়িয়ে পৌঁছে যাবো আমাদের গাছ-গাছালি ঘেরা বসতবাড়িটিতে। আবার সেই দুপুরে দাদুভাইয়ের সাথে নারকেল গাছের তলায় বসে ছিপ ফেলে মাছ ধরা, গাছের তলায় মাদুর পেতে পাখির কিচির-মিচির ডাকে বিভোর হয়ে গল্প শোনা, কাঠের পিঁড়িতে বসে একসাথে কাঁসার থালায় ভাত খাওয়া, কাকভোরে উঠে দুইচোখ যেদিকে যায় হেঁটে চলা, পুকুরের জলে ঘন্টার পর ঘন্টা দাপাদাপি করা। অবশ্য থাকবে এবার মায়ের শাসন, কিন্তু আছে আমার রক্ষাকর্তা দাদুভাই। আবার ফিরে পেতে চলেছি আমার সত্যিকারের রূপকথার দেশ। শেষরাতে ঘুম যে কখন দুইচোখকে আর মেলে থাকতে দেয় না, নিজেই জানি না। 
    তুমি যেখানেই থাকো, এ লেখাটি পড়বে কিন্তু দাদুভাই,
    লেখা আছে সেখানে,
    তোমার নাতি নাতনীদের কথা ----
    তোমার বসতবাড়িটির কথা, গাছ-গাছালি ঘেরা পুকুরটির কথা ---
    আরো কিছু টুকরো টুকরো স্মৃতির কথা  -----
    আজ আর তোমাকে না পেয়ে,
    কাজ চালাই লিখে, স্মরণে ----
    হয়তো আশা,
    অনেকটা চোখের জলের পর,
    খুশির জোয়ারে ভরবে মন -----     

    শেষটুকু : প্রত্যেকেরই একটি নিজস্ব শৈশবকালের গল্প থাকে। বেশ কিছু বাছাই করা সত্যি ঘটনার আঁধারে অথবা সমন্বয়ে তৈরি, যা আমরা বারবার নিজেদেরকে বলি অথবা অন্যদেরকে বলার চেষ্টা করি। এটা নির্ভর করে কিভাবে আমরা আমাদেরকে দেখতে অথবা দেখাতে চাই।
    একজনের সংমিশ্রিত ব্যক্তিগত গল্পে আমাদের নিজেদের ব্যক্তিগত ইতিহাসের কিছু ঘটনা বা দিক থাকে যা বাস্তবসম্মত হতে পারে। সেটা নির্ভর করে যেভাবে আমরা কিছু নির্বাচন করি এবং কিছুকে ত্যাগ করি, বিষয়গতভাবে সেগুলিকে ব্যাখ্যা করি এবং সেগুলিকে আমাদের প্রধান ব্যক্তিগত বিবরণে সুতো দিয়ে গাঁথি।   (সমাপ্ত)

     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঝপাঝপ মতামত দিন