১
অ বিমু, বিমু ... বিম্মু রাআআনী....
চট করে ভেঙে গেল ঘুমটা। স্বরটা কেমন চেনা চেনা ঠেকল। এ নামে বিমলাকে শুধু দু জন ডাকত। ঘাড় ঘুরিয়ে জানালার দিকে তাকালো বিমলা। পর্দাটা তখনও এলোপাথারি উড়ছে।
আবারও ঘুমের ঘোরে ভুলভাল বকছে ভেবে চোখ বন্ধ করল। এবার মনে হলো ফ্যানের ওপর কেউ পা ঝুলিয়ে বসে। ঘচাং করে বিছানায় উঠে বসল। মোবাইলের আলো ফেলল ওপরে। দেখল, ব্লেড তিনটে ঘটঘট আওয়াজ করতে করতে বন্ধ হয়ে গেল। সেই সময় যত রাগ গেল আগরওয়ালের ওপর। নির্ঘাত লোকটা লাইট ফ্যানের একটা কাজও করেনি। পই পই করে বলেছিলাম, সব সার্ভিসিং করিয়ে তবে বাড়িটা দেবেন।
টেবিলে রাখা গ্লাস থেকে কিছুটা জল খেয়ে বাইরে এসে দাঁড়ালো বিমলা। শহর তখনও ঘুমোচ্ছে। দূরে কয়েকটা নিভু নিভু আলো। বড় রাস্তার একপাশে কয়েকজন নিশ্চিন্তে শুয়ে আছে। কিন্তু বিমলার ঘুম আসছে না। কার গলা ছিল ওটা?
সকালে রুবি এসে বেল বাজালো। বিমলা দরজা খুলেই বলল,
- এক কাপ কড়া করে চা দে। মাথাটা ভীষণ ধরেছে।
রুবি কোমড়ে আঁচল গুঁজতে গুঁজতে জিজ্ঞাসা করল,
- কেন গো, রাতে বুঝি ঘুম হয়নি?
বিমলা চোখ কচলে এগিয়ে গেল বারান্দায়। স্কুল বাস ধরতে মেয়েটা আজও লেট।
নতুন এই অ্যাপার্টমেন্টে তিন মাস হলো বিমলা এসেছে। আগে সেক্টর চারের বাড়িটা সেটের খুব কাছে হলেও বড্ড ছোট ছিল, তাই এবার টুবিএচকে নিয়েছে। সন্তু ওর বন্ধুবান্ধব নিয়ে এলে থাকতে পারবে। সন্তু বিমলার একমাত্র ভাই। কখনও লম্বা ছুটি হলে আসে।
এই শহর বিমলার খুব প্রিয়। আর যাই হোক এ শহর বাকি সবার মত না। ওকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে গত দশ বারো বছর। পাড়ার ডাব্বুদা একবার হাত দেখে বলেছিল,
- তোর অনেক নাম হবে দেখিস। চকচক করছে ভাগ্যরেখা...
কিন্তু কী আর ভাগ্য...! ওই তো হাতে পাওয়া কটা ছোটখাটো রোল...এক একটা এপিসোডে গুনে বলা ডায়লগ শুধু। এসব ভাবতে ভাবতেই ফোনে চোখ রাখে বিমলা।
বাপ্পাদার মেসেজ...
- আজ একটুও লেট করবি না। রিচ অন টাইম। শার্প অ্যাট টেন।
২
আজ এই সিরিয়ালের শেষ দিন। একটা বড়সড় কেক এসেছে সেটে। শটের পর সবাই মিলে কাটা হবে। সাথে সিঙারা আর চা।
ইন্ডাস্ট্রিতে বাপ্পাদার সাথে কাজ করতে পারাকে বেশ ভাগ্যবান বলে মনে করে সবাই। আর বিমলার এটা চতুর্থ কাজ। কিন্তু একটাই রাগ ওকে কখনও লিড রোল দেওয়া হয় না। বাচ্চা মেয়েগুলো এসেই কেমন নায়িকা হয়ে তরতর করে এগোচ্ছে।
বিমলা অনেকবার ভেবেছে এ কাজ ছেড়ে দেবে। কিন্তু কীই বা করবে তারপর! অফিসের আটটা পাঁচটা এখন পাওয়াও মুশকিল।
সমস্ত দুঃখ বুকে চেপে বিমলা সাজঘরে ঢুকে ক্রিম পাউডার লাগায়। মেকআপ দাদা গাঢ় করে চোখে লাইনার টেনে দেয় রোজকার মত। এক বদরাগী মায়ের রোল। ওর চেহারায় নাকি এরকমই মানায়।
পর্দায় বিমলার অভিনয় খুব যে জনপ্রিয় তা নয়, তবু কিছু চরিত্রকে লোকে মনে রেখেছে। এই যেমন গত সিরিয়ালের টনি দি। ওখানে নার্সের রোলে সকলের চোখের মণি হয়ে গেছিল কদিনেই।
এক রোববারে বাজারে গেছিল বিমলা। ভেবেছিল আজ নিজেই রান্না করে খাবে। বাজারে মাছওয়ালা দেখে সে এক গালভরা হাসি।
- ও টনিদি, টাটকা রুই বেছে দেব নিয়ে যাও।
বিমলা কত করে বোঝালো, একা মানুষ রে ভাই। অত বড় মাছ নিয়ে কি করব?
সে শুনল না। জোর করে ব্যাগে পুরে দিল।
এভাবেই গল্পরা বদলায় আর বিমলা কখনও টনিদি, কখনও মনুমাসি, আবার কখনও পটার মা সেজে টিভির পর্দায় বিনোদন দেয়। যদিও সেদিন বাপ্পাদার সাথে একচোট হয়ে গেল। বাপ্পাদা ঢুকেই জানালো,
- পরের শো তে তোর জন্য একটা জব্বর রোল রেখেছি। না করিস না।
বিমলার রাগ সেদিন চরমে। এমনিতেই গত কদিন ঘুমের ব্যাঘাত চলছে।
বাপ্পাদা তাও বলল,
সময় দিলাম ভেবে দেখ। চরিত্র তো বদল হবে না, বাধ্য হয়ে নতুন কাস্টিং করতে হবে।
বিমলা বেসিনে গিয়ে ঝপাঝপ জল ছিটিয়ে আইলাইনার তুলল। তারপর তোয়ালে দিয়ে মুছতে মুছতে বলল,
- মানু সরকার সারা জীবন ওই সব রোল করে গেল। কটা লোক মনে রেখেছে শুনি? আমাকেও তোমরা ভুলে যাবে।
প্রিয় সহকর্মী ছিল মানুদি। সেও অনেক উচ্চাশা নিয়ে এ শহরতলিতে এসে পাড়ি জমাতে চেয়েছিল।
৩
বিমু...মাই সুইট বিমু...
আজ আবারও ঘুমের মধ্যে সেই ডাক। বিমলা চোখ চেপে শুয়ে থাকল। কিন্তু ডাকটা যেন এবার খুব কাছ থেকে এলো। বিমলা চোখ খুলতেই দেখে ডাব্বুদার মত চেহারার একটা ছায়া দেওয়াল জুড়ে নড়াচড়া করছে।
বিমলার রাগ উঠল চরমে। ও প্রায় চেঁচিয়ে বলল,
- ডাব্বুদা, ভালো হবে না বলছি। আবারও ভয় দেখাচ্ছ!
এবারে উত্তর এলো,
- না রে, ভয় দেখাব কেন? তোর সাথে কথা বলতে এলাম। কতদিন হলো আমরা একসাথে খাইনি, ঘুরতে বেরোয়নি। যাবি আজ..?
বিমলা আবারও বিরবির করতে থাকল,
- এত রাতে এসে আবার আমায় বেরাতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সেদিন কোথায় ছিলে শুনি? আঠেরোই মার্চ, মনে আছে?
খুব কাছ ঘেষে ডাব্বুদার আওয়াজ পেল বিমলা...
- সুইট বিমু, অত রাগ করে না। আমি কী করব বল। ডেস্টিনি। হয়তো এটাই লেখা ছিল কপালে, তাই ওরা আমায় চ্যাঙদোলা করে সেফ হোমে নিয়ে গেল। আর ঠিক তার দুদিন পরেই... তবে বেঁচে থাকলে আজ তুই মিসেস লাহিড়ী হতিস...
ডাব্বুদাআআআআ...বলে ফোঁস ফোঁস করে আবারও কেঁদে উঠল বিমলা।
৪
ঘুমেতে প্রায়ই এখন ডাব্বুদা আসে ... সেই আগের মত সাহস দেয় এগিয়ে যাবার।
আজ সেটে ঢুকে কারো সাথে কথা বলল না বিমলা। পল্টু চা দিতে এসে জানালো বাপ্পাদা ডেকেছে। নির্ঘাত জানতে চাইছে ফাইনাল ডিসিশন...
ঘরের দরজাটা ভেজানো ছিল। বিমলা ভেতরে ঢুকল।
বাপ্পাদার ঘোলা চশমার কাঁচ দিয়ে সরাসরি প্রশ্ন এলো...
- তাহলে করছিস তো রোলটা?
সিরিয়ালের নামটাও অদ্ভুত। ‘ওরা এগারো জন’। পুরানো কুঠির ভূত আর এগারোটা ছেলে মেয়ে নিয়ে এ গল্প। বিমলা না করতে পারল না। লকডাউনের পর এটাই প্রথম বড় কাজ, বেশ কটা এপিসোড ধরে চলবে। আর হাতেও এখন তেমন কিছু নেই।
সম্মতি দিতেই বাপ্পাদা খুব খুশি।
চরিত্রটা কদিনেই খুব জনপ্রিয় হয়ে গেল। টিআরপি হু হু করে ওপরে উঠল চ্যানেলের। আর বিমলাও সাদা থান, সাদা চুলের পেত্নী হয়ে ফেমাস হতে সময় নিল না...
আজ আইটিভিতে ‘সোনার সংসার’এর টেলিকাস্ট। সারা বছরের সেরা পার্ফরমেন্সকে দর্শক বেছে নিয়েছে। আর সেখানেই বেস্ট ইন সাপোর্টিং রোলের সিলেকশনে বিমলার নাম। খবরটা শুনেই চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। বিমলা সামলে নিল নিজেকে।
মঞ্চের গোল আলো ওকে ঘিরে ধরতেই মনে হলো অদৃশ্য একটা শক্ত হাত ওকে টেনে নিয়ে আসছে ওপরে...আর চারপাশ থেকে কানে আসছে অজস্র করতালি...
– ঝর্না বিশ্বাস
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।