এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • শৈশবের স্মৃতিমালা এবং তাহাদের কথা - পর্ব ১২

    Supriya Debroy লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৭ ডিসেম্বর ২০২২ | ৪২৭ বার পঠিত
  • কিন্তু ইন্দ্রাণীদের বাগানটি বিশাল, সুন্দর ঘাসের লনে আচ্ছাদিত। রাস্তার পাশে সারি দিয়ে গোলাপ, চন্দ্রমল্লিকা, গাঁদা ফুল গাছের টব বসানো এবং সুন্দর করে পরিচর্যিত। পরে শুনেছিলাম একজন মালি বাগানটির পরিচর্যা করতো। আমরা বাইরের বসার ঘরে বসেছিলাম। একটু পরে আমরা যাই ভিতরে একটি আলাদা ডাইনিং রুমে, যেখানে পাতা আছে একটি কাঠের ডাইনিং টেবিল, ঢাকা দেওয়া একটি সুন্দর কাপড় দিয়ে। আমার চোখে প্রথম দেখা ডাইনিং টেবিল। এই পর্যন্ত্য মেঝেতে বসে খেয়ে এসেছি, বারাসাতে পিঁড়ির উপর বসে আর এখন কাপড়ের আসনের উপর বসে। টেবিলের উপরে রাখা আছে সাদা সুন্দর প্লেট, বাটি। মনে হয় কাঁচের। সাজানো নানারকম খাবার বিভিন্ন বড় বড় বাটি এবং থালাতে। পরে জেনেছিলাম, এইগুলোকে সারভিং বাউল এবং ট্রে বলে। খাবারগুলো দেখেই মনে হচ্ছিল, কোনোদিন খাওয়া তো দূরের কথা - চোখেই দেখিনি। ইন্দ্রাণীর বাবা তখন অফিসে। ওর মা সবাইকে চেয়ার'এর উপর বসিয়ে খাবার পরিবেশন করেন। ইন্দ্রাণী তখন আমার পরিচয় করিয়ে দেয় ওর মায়ের সাথে। ইন্দ্রাণীর মা কথাবার্তায় বেশ মিষ্টি ছিলেন। খাবার পরিবেশন করতে করতে আমাকে বলেন, 'তোমার কথা ইন্দ্রাণীর কাছে অনেক শুনেছি। তুমি নাকি পড়াশুনায় খুব ভালো। আমার মেয়েটা একদম পড়তে চায় না, তুমি ওকে একটু সাহায্য কোরো।' আমার মুখ লজ্জায় অবনত, কোনো কথাই মুখ দিয়ে বেরোচ্ছিল না। ইন্দ্রাণীর বাকি মেয়ে বন্ধুগুলো এই সুযোগে আমার পিছনে লাগে, 'মাসিমা আপনি একদম চিন্তা করবেন না। সুপ্রিয় ইন্দ্রাণী ছাড়া আর কারুর সাথে মেশেই না। ও সবসময় সাহায্য করে ইন্দ্রাণীর ক্লাসওয়ার্ক করে দিতে।' হয়ত এর পর আমি ইন্দ্রাণীর সাথে আরও ফ্রি হতে শুরু করি, তার পড়াশোনা এবং ক্লাসের কাজে সাহায্য করতে শুরু করি।
    পঞ্চম শ্রেণীতে ফাইনাল পরীক্ষার ঠিক আগে, ইন্দ্রাণী তার ইংরেজি সাহিত্যের বইটি কোনোভাবে হারিয়ে ফেলে। সেই সময় ইংরেজি এবং বাংলা সাহিত্যের বই শুধুমাত্র স্কুল থেকে বিতরণ করা হত এবং কোনো বইয়ের দোকানে পাওয়া যেত না। স্কুলেও যতগুলি বই দরকার ততোগুলোই আনা হত, বোধহয় টিচারদের কপিগুলি ছাড়া আর কোনো এক্সট্রা কপি আনা হত না। আর প্রত্যেক বছর বই চেঞ্জ হয়ে যেত। কারণটা আমার জানা নেই। ইন্দ্রাণীর বই হারানোর অভিযোগ শুনে, ক্লাস টিচার জিজ্ঞাসা করেন কারুর কাছে অতিরিক্ত বই আছে কীনা, অথবা নিজের বই ইন্দ্রাণীর সাথে ভাগাভাগি করে পড়তে চায় কীনা ? যখন পুরো ক্লাস নীরব, ধীরে ধীরে আমি আমার হাত তুলে জানিয়েছিলাম যে আমার কাছে ইন্দ্রাণীকে দেওয়ার জন্য একটি অতিরিক্ত বই আছে। যদিও আমার কেবল একটিই ছিল। ক্লাস টিচার অবাক চোখে আমার দিকে তাকালেন। ইন্দ্রাণী তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বলে, ‘না, ম্যাডাম – সুপ্রিয়'র কাছে কোনো অতিরিক্ত বই নেই। সে আমার বেস্ট ফ্রেন্ড - তাই আমাকে সাহায্য করার জন্য হাত তুলল।'  ক্লাস টিচার হেসে বললেন, 'তাহলে ইন্দ্রাণী, যেহেতু সুপ্রিয় তোমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু এবং সাহায্য করতে ইচ্ছুক, তোমরা দুজনেই একই বই শেয়ার করে পড়ো। যতক্ষণ না তোমার বইটি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে।'  ক্লাস শেষ হওয়ার পরে, ইন্দ্রাণী আমার দিকে তাকিয়ে বলে, 'তুই কী হাঁদা রে ! এত বোকা কেউ হতে পারে ! তুই শুধু পড়াশুনাটাই ভালোভাবে করতে পারিস, ঘটে একফোঁটা বুদ্ধি নেই। ম্যাডাম চেষ্টা করছিলেন বের করতে, কে আমার বই চুরি করেছে। আর তুই ওনার ফাঁদে প্রায় পড়ে গিয়েছিলি।' আমি বোকা বোকা ভাবে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকি। আর ক্লাসের বাকি সবাই আমাদের দিকে হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে দেখছিল। 
    ****
    খুব সম্ভবত আমি যখন চতুর্থ শ্রেণীতে এবং দিদি অষ্টম শ্রেণীতে পড়ে, মা পল্লব'কে নিয়ে জলঢাকাতে  গিয়েছিলেন, যেখানে ওনার পিসতুতো ভাই থাকতেন। সেই সময় বাঁকুড়া থেকে একজন রান্না করার লোক বাবা জোগাড় করেন। রান্না ছাড়াও ঘরের বাকি সমস্ত কাজই করত এবং আমাদের বাড়িতেই থাকত। ও আবার বাংলায় কথা বলত না, বাঁকুড়া ভাষায় বলত - 'উইখান খাবার রাইখ্যা আছে, ভাইল্যা দেখ, একটুকুন পর খাইয়া লবি।'  আমার এখনও মনে আছে, সেই সময় দিদি প্রায় প্রতিদিন সকালে স্কুলে যাওয়ার আগে একটা গান গাইত, ‘ও তোতা পাখি রে, শিকল খুলে উড়িয়ে দেব, মা কে যদি এনে দাও------’। আমারও মনটা খুব খারাপ হয়ে যেত মায়ের জন্য ঐসময়। কতদিন হয়ে গেল, এখনও কেন ফিরছে না !
    'অপরাজিত' উপন্যাসে বিভূতিভূষণ কোথাও উল্লেখ করেছেন যে অপু মাঝে মাঝে দুর্গা (তার বড় বোন), রানু-দি (তাঁর ছোটবেলার খেলার সাথী), লীলা (তাঁর বান্ধবী), অপর্ণা (তার স্ত্রী)-এর মাধ্যমে তার মা সর্বজয়ার ভালবাসা ও স্নেহ অনুভব করত। বইটি পড়ার সময় আমার সেই একই অনুভূতির কথা মনে করিয়ে দেয়, তখন যেভাবে দিদি মায়ের অনুপস্থিতির শূণ্যতা পূরণ করে দিত।
    সেই দিনগুলিতে, দাদুভাই আমাদের দুর্গাপুরের বাড়িতে ঘন ঘন আসতেন এবং আমার একটা সুন্দর আনন্দঘন সময় কাটত ওনার সাহচর্যে। ফিরে যাওয়ার সময় ঘনিয়ে আসলেই মনটা খারাপ হয়ে যেত  এবং কখনও কখনও চলে যাওয়ার একদিন আগে ওনার জুতো লুকিয়ে রাখতাম।
    সেই দিনগুলিতে, দাদুভাইয়ের ঘন ঘন আসা ছাড়াও, আমাদের প্রায় সকল আত্মীয়-স্বজন দুর্গাপুরে আসতেন। কাকুমণি এবং তার বন্ধু কমলেশ-কাকু (মধুপুর থেকে বেড়িয়ে ফেরার সময়), কুট্টিপিসি, পিসিমণি ও  তার ছোট ছেলে সজল, বড়মামি ও বড় মেয়ে শ্বেতা, ছোটদাদু, ফুলমাসি, মেজোমামা, বাবুলমামা, অবনী মেসো ও মাসিভাই এবং আরও অনেকে।
    পরে ছোটকাকুও দুর্গাপুরে একই আইবি ডিপার্টমেন্টে চাকরিতে যোগ দেন যেখানে আমার বাবা কাজ করতেন।
    আমি যখন পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ি, তখন রাঙাপিসো দুর্গাপুরে বিডিও হিসাবে বদলি হয়ে আসেন এবং সাগরভাঙ্গাতে রাঙাপিসি এবং ওনাদের সন্তান রুপম ও মিষ্টু'দের নিয়ে থাকতে আসেন। আমাদেরও বেড়ানোর আরেকটা জায়গা হয়ে যায়।     ( ক্রমশ )

     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা মনে চায় মতামত দিন