এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • বিস্মৃত নটসম্রাট শান্তিগোপাল (অন্তিম পর্ব)

    রজত দাস লেখকের গ্রাহক হোন
    ০৯ নভেম্বর ২০২২ | ৪৬৪ বার পঠিত
  • ১ম পর্বের পর... 
     
     
    ১৯৮৪ সালে শিব ভট্টাচার্য মারা যাওয়ার পর তরুণ অপেরা প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। শান্তিগোপাল বাবুর কথায়, “তিনি আমার বাবার মতো ছিলেন। শিবুবাবুই আমার দল পরিচালনা করেছিলেন। তাঁকে ছাড়া, আমি দল চালিয়ে যেতে পারতাম না… এখন, আমার বন্ধুরা এবং পাড়ার ছেলেরা আমাকে মঞ্চে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে চায়।” কথাগুলো বলেছিলেন ৬৫ বছর বয়সী শান্তিগোপাল। হিটলারের মতো মেকআপে নিজের একটি ছবির দিকে তাকিয়ে।

    সেই সময়টিতে আবার হিটলার হওয়ার জন্য শান্তিগোপাল, ফুয়েরারের আত্মজীবনী, মেইন ক্যাম্প এবং বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী বই, উইলিয়াম শিরার্স এর লেখা রাইজ অ্যান্ড ফল অফ দ্য থার্ড রাইখ-এর মতো বইগুলোর সৌজন্যে স্বৈরশাসকের মানসিকতার মধ্যে তলিয়ে যেতেন।

    নিউ ব্যারাকপুরে একটি ছোট জনতা গত সপ্তাহে শান্তিগোপালকে হিটলারের মতো এক ঝলক দেখেছিল।  কিন্তু ৫ জানুয়ারী হল ডি-ডে, সার্কাস ময়দান, সিঁথি মোরে একটি মেগা শো সহ, যেখানে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু দর্শকদের মধ্যে থাকবেন বলে আশা করা হচ্ছে।

    এটি কেবল শুরু — শান্তিগোপাল আগামী মাস এবং বছরগুলিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং ফিদেল কাস্ত্রোর চরিত্রে অভিনয় করার পরিকল্পনা করেছেন।

    একদা মোহনবাগান মাঠে যখন ফুটবল কিংবদন্তি কসমস কালারে হতাশা প্রকাশ করেছিলেন তখন শান্তিগোপাল স্নেহের সাথে সেই সময়টি বর্ণনা করেছিলেন। বাগান ভক্তদের মন্তব্য করতে প্ররোচিত করেছিলেন যে, "এটি নিশ্চয়ই 'শান্তিগোপাল'। পেলে মাঠে খেলছেন"।

    শান্তিগোপাল পাল। এক বাঙালি যাত্রা শিল্পী। যিনি বাংলার লোকশিল্পের অংশ। ২০১২ সালের এক সোমবার সকালে কলকাতায় তাঁর বরানগরের বাসভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর। শান্তিগোপাল, প্রায় ছয় দশকের কর্মজীবনে ভ্লাদিমির লেনিন, কার্ল মার্কস, মাও সে তুং, সালভাদর আলেন্দে, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু, রাজা রামমোহন রায়, স্বামী বিবেকানন্দের মতো ব্যক্তিত্বের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন।

    যাত্রাপালা বাংলার প্রতিটি গ্রাম, ও শহরতলিতে মঞ্চস্থ করা উচ্চস্বরে অভিনীত এক লাউড নাট্যরূপ। যা মূলত রামায়ণ ও মহাভারতের মতো মহাকাব্য এবং দেব-দেবীদের পৌরাণিক কাহিনীকে কেন্দ্র করে তৈরি করা হতো।

    শান্তিগোপাল হিটলার এবং অমি সুভাষের মতো তার যুগান্তকারী যাত্রাপালার সাথে সবকিছু বদলে দিয়েছিলেন।  তাঁর সমস্ত যাত্রাপালায় একটি শক্তিশালী বামপন্থী প্রভাব ছিল এবং তাঁর অভিনয় গ্রামীণ জনগণের উপর শিক্ষামূলক প্রভাব ফেলেছিল।

    শান্তিগোপাল, গ্রামেগঞ্জে একটি ঘরোয়া নাম হয়ে ওঠে। এবং বলা যেতেই পারে, তার চেয়েও বেশি কিছু।  কেউ যদি রাজনীতিবিদ বা ক্রীড়াবিদই হোক না কেন, কোথাও ভালো পারফর্ম করতে ব্যর্থ হলে লোকে বলবে, "ওহ, এটা নিশ্চয়ই শান্তিগোপাল।" তারমানে অত্যন্ত উঁচুমানের নকলানবিশ। যাঁর আসলটি আসেনি। আমরা নকলকে দেখছি। শান্তিগোপাল গত হয়েছেন কিন্তু তিনি বাংলা ভাষায় নিজের জন্য পরম্পরাগত একটি স্থায়ী জায়গা তৈরি করে গেছেন।

    টুকরো টুকরো কিছু স্মৃতি... পুরনো সংবাদপত্র থেকে এনে মেলে ধরলাম। যাত্রা জগতে "শান্তিগোপাল" ছিলেন এক বিরল প্রতিভা। সময়টা ষাটের দশক। যে সময়ে দর্শককুল পৌরাণিক কাহিনীর যাত্রাপালায় মজে। অল্পস্বল্প সামাজিক পালা কয়েকটি অপেরায় সবে মঞ্চস্থ হতে শুরু করেছে। ঠিক সেই সময়ে পৌরাণিক সামাজিক পালার বন্ধন থেকে বেরিয়ে দর্শকরা পেলেন এক নতুনত্বের স্বাদ। যাত্রার অভিনয়ে আঙ্গিকে নিয়ে এসেছিলেন আমূল পরিবর্তন। দর্শকদের উপহার দিতে শুরু করলেন, জীবনীমূলক যাত্রাপালা। সেই সব পালায় হিটলার থেকে নেতাজি। বিবেকানন্দ থেকে রামমোহন। লেনিন থেকে কার্ল মার্ক্স। মাও সে তুং থেকে টারজান, সব চরিত্রেই অভিনয় করেছেন একমেবাদ্বিতিয়ম শান্তিগোপাল। প্রত্যেকটি চরিত্রে নিজেকে অদ্ভুত ভাবে মিশিয়ে দিতে পারতেন। দর্শকদের কাছে প্রতিটি চরিত্রকে উপস্থাপন করার জন্য আশ্রয় নিতেন অগাধ পড়াশোনায়।

    যাত্রার জীবন ভ্রাম্যমাণ। এক তাঁবু থেকে আর এক তাঁবুতে বয়ে চলা। শান্তিগোপালের আনুষঙ্গিক সমস্ত উপকরণের সাথে চলত একটি মস্ত বড় মাপের লোহার ট্রাংক। সেটি ভর্তি থাকত অজস্র দেশি বিদেশি বই। ভ্রাম্যমাণ সেই অস্থায়ী জীবনেও তিনি কখনও বইকে কাছছাড়া করেননি। নিষ্ঠা, অধ্যাবসায় আর আত্মোৎসর্গের নাম ছিল শান্তিগোপাল। শেষ বয়সে তাঁর ভালোবাসার যাত্রাপালার জগতের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেননি।

    যুগ বদলের সাথে সাথে যাত্রাজগৎ ও দর্শকদের চাহিদা দুটোই বদলে গিয়েছিল। এক চরম হতাশা তাঁকে ক্রমশ গ্রাস করতে শুরু করেছিল। যা শেষাবধি আর তাঁকে তাঁর স্বমহিমায় উজ্জ্বল হতে ভালোবাসার নিজস্ব জগতে ফিরতে দেয়নি। অন্য আরো প্রতিভাধর তারকাদের মতই অন্ধকার অতলে তলিয়ে গিয়েছিলেন। পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়ার আগে একবার শেষ চেষ্টা করেছিলেন। ২০১২ সালের ৭ই মার্চ শিল্পীর বয়স তখন ৮৬ বছর। শেষবারের মত মঞ্চস্থ করেছিলেন "হিটলার" পালাটি। সেই বছরেই তার কয়েকমাস পর বুকে অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে ৫ই নভেম্বর চলে গেলেন না ফেরার দেশে। যাত্রার একটি অধ্যায়, একটি যুগের অবসান ঘটে গিয়েছিল নিঃশব্দে।
    ______________
    ©রজত দাস
    (ঋণ স্বীকার:- বর্তমান, প্রতিদিন, টেলিগ্রাফ, স্টেটসম্যান, যুগান্তর ও আনন্দবাজার পত্রিকার পুরনো সংখ্যা)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঠিক অথবা ভুল মতামত দিন