এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • মিডিয়া ট্রায়াল

    Sudeep Chatterjee লেখকের গ্রাহক হোন
    ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২২ | ৪৩৭ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • মিডিয়া। বর্তমানে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে অসীম শক্তিশালী এনটিটি এই তিন অক্ষরের গুরুঘণ্টাল। স্পেস টাইমে এমন কোনো বিন্দু নেই, যেখানে মিডিয়া সিঁদ কাটতে পারে না। ব্যক্তি থেকে সংগঠন, অতীত থেকে ভবিষ্যত, শিল্প থেকে বিজ্ঞান... কার আস্পর্ধা তাদের বিরুদ্ধে কথা বলে! এই ফেক নিউজ পরিবেশন করে সবাইকে উত্তেজিত করে তুলল, এই প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে পাবলিক পারসেপশন বদলে দিল, প্রয়োজন পড়লে মিডিয়া ট্রায়াল আর রিভিউ বম্বিং করিয়ে করে কোনো আর্ট ফর্মকে বয়কট করানোতেও তাদের জুড়ি নেই। পাশাপাশি তলায় তলায় আখের গুছিয়ে নিতে তারা ওস্তাদও বটে। 

    তবে কিনা খবরদার...মিডিয়ার সঙ্গে আবার সাংবাদিকতাকে গুলিয়ে ফেলবেন না। সাংবাদিক ও সাংবাদিকতা...ও জিনিস এ যুগে বিরল। ও নামে যারা আছে, তারা মহানন্দে লেমন, ক্রম, ক্যানারি বা বাম্বলবি ইয়েলো(জার্নালিজম) রঙের রথ ছোটাচ্ছে। আমার তো ধারণা, পাঁচশো হাজার বছর পর লুপ্ত প্রাণীদের লিস্টে ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টদের নামও থাকবে। স্কুলে পড়ানো হবে, এই বোকা প্রাণীগুলো কীভাবে জীবন বিপন্ন করে খবর জোগাড় করত, সরকার বা কর্পোরেটকে ভয় পেত না; শুধু তাই নয়, খবর পরিবেশনায় ভুল হলে জনসমক্ষে ক্ষমাও চাইত। পাবলিক অ্যাপোলজি! 

    ক্ষমা! ও আবার কী জিনিস! এই তো দিন কয়েক আগে এক অভিনেত্রীর প্রয়াণ সংবাদ দেখলাম। ছবি সহ ব্রেকিং নিউজের হেডলাইন! ভদ্রমহিলা মারা যেতে না যেতেই উইথ পিকচার খবর পোস্ট হয়ে গেছে। সবসে তেজ! তারপর জানা গেল, ভুল করে সমনামী অভিনেত্রীর ছবি দিয়ে ফেলেছেন। কী ভাবছেন, এই ভুলের জন্য দুঃখপ্রকাশ করেছে? ও হরি! পাগল নাকি? মানুষমাত্রেই ভুল হয়, বুঝলেন! অ্যাপোলজি জিনিসটা আধুনিক মিডিয়া এথিক্সে ইররিলেভেন্ট। তবে কিনা এখন না হলেও এককালে এই এথিক্স সাংবাদিকতার অভিন্ন অঙ্গ ছিল। কাল এই নিয়ে কথা হচ্ছিল, আর তারপর যা হয়! বরাবরের মতো অপ্রত্যাশিত ভাবে একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল। জার্নালিজম এথিক্সের ইতিহাসে সে এক অভূতপূর্ব ঘটনা। কিন্তু সে ঘটনার সঙ্গে যে মানুষটার নাম জড়িয়ে আছে, মূল গল্পটা তাঁকে নিয়েই। 

    রবার্ট এইচ গডার্ড। হ্যাঁ, আজ নাসার একাধিক স্পেস সেন্টার আর রিসার্চ স্টেশনের নামের সঙ্গে তাঁর নাম জড়িয়ে আছে ঠিকই, কিন্তু তাঁর জীবন ও কাজের গুরুত্ব যে ঠিক কতটা, সেটা অনেকের কাছেই ধোঁয়াশা। অথচ, দেখতে গেলে গডার্ড যে যুগান্তকারী গবেষণা করে গিয়েছেন, সেটা না হলে আধুনিক মহাকাশ বিজ্ঞানের ভিত মজবুত হত না। পরবর্তী কালে অনেকেই তাঁকে আমেরিকার 'রকেট ম্যান' বলেছেন, বলেছেন স্পেস এরার সর্বশ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক, এমনকি আধুনিক মহাকাশ বিজ্ঞানের ফাদার ফিগার বলেও সম্বোধন করা হয়েছে তাঁকে। তাও, কোথাও না কোথাও, গডার্ড আমজনতার কাছে সেভাবে পরিচিত হতে পারেননি।

    কিন্তু কেন?

    কারণ একটাই... মিডিয়া! মিডিয়া একজন মানুষের জীবন কীভাবে বদলাতে পারে সেটা বুঝতে গেলে গডার্ডের জীবন নিয়ে রিসার্চ করা যেতে পারে। দ্য ওয়ার্স্ট অ্যান্ড বেস্ট ওয়ার্ক অফ মিডিয়া...দুইই পাবেন।

    গডার্ড জন্মেছিলেন ১৮৮২ সালে। ম্যাসাচুসেটস এর ওয়ার্ক্সেস্টার আর বস্টন, এই দুই জায়গাতে ভাগাভাগি করে শৈশব কেটেছে তাঁর। বাবা নাহুম গডার্ড প্রযুক্তি নিয়ে পড়াশুনা না করলেও শখের যন্ত্রবিদ ছিলেন, ফ্যাক্টরিতে কাজ করার পর বাড়ি এসে এটা সেটা জুড়ে কিছু না কিছু তৈরি করার শখ ছিল প্রথম থেকেই। এই করেই ছেলের জন্য টেলিস্কোপটা তৈরি হয়েছিল বোধহয়। রবার্ট ছিলেন যাকে বলে কান্ট্রি বয়। উইকেন্ডে বাবার সঙ্গে হাইকিংয়ে যেতেন, সঙ্গে থাকত রাইফেল আর টেলিস্কোপ। সেই হাইকিং-এর দিনগুলোই প্রকৃতির প্রতি তাঁর আগ্রহকে উসকে দেওয়ার জন্য দায়ী। রাতে বাবা ঘুমিয়ে পড়ার পরেও রবার্ট তাঁবুর দরজা ফাঁক করে টেলিস্কোপ চোখে লাগিয়ে অসীম আকাশের দিকে চেয়ে থাকতেন, তাঁর ঘুম আসত না। যত দিন যেতে লাগল, তিনি বিজ্ঞানের প্রতি আকৃষ্ট হতে লাগলেন। নাহুম গডার্ড ছেলেকে স্ট্যাটিক ইলেক্ট্রিসিটি আর প্লেনের কন্সেপ্ট বুঝিয়েছিলেন, তাছাড়া এইচ জি ওয়েলসের কল্পবিজ্ঞান পড়ার নেশাও বড় কম ছিল না ছেলের। ফলে যা হওয়ার তাই হল। সেই পুঁচকে বয়স থেকেই যে হাতে কলমে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষানীরিক্ষা শুরু হল, সে চলল গোটা কৈশোর ও যৌবন জুড়ে। বিজ্ঞানের প্রতি এই সার্বিক আগ্রহ ধীরে ধীরে স্ট্রেট এয়ারোডায়নামিক্সে গিয়ে ঠেকল, তারপর মহাকাশে রকেট পাঠানোর সম্ভাবনা মাথাচাড়া দিল কিশোর রবার্টের মনে। পলিটেকনিক পাস করে, ফিজিক্সে এম এ আর পিএইচডি করে যখন প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটিতে ইন্সট্রাক্টর হিসেবে যোগ দেন, তাঁর শয়নে স্বপনে একটাই চিন্তা... মহাকাশে রকেট পাঠাতে হবে।

    ভুলে গেলে চলবে না, সময়টা বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিক। প্রথম বিশ্ব যুদ্ধ শুরু হয়েছে, রাষ্ট্রনায়ক ও সরকারি বৈজ্ঞানিকদের ফোকাস ছিল আধুনিক প্রয়ুক্তিকে ব্যবহার করে অস্ত্র বানানোর ওপর। ওদিকে ট্যাঙ্ক, জাহাজ, রাইফেল, সাবমেরিন তৈরি হচ্ছে, এদিকে ক্লার্ক ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে রবার্ট গডার্ড পাউডার জ্বালানি দিয়ে রকেট ওড়ানোর এক্সপেরিমেন্ট করছেন। খুব একটা সাফল্য পেয়েছিলেন বলা যায় না, পাউডার্ড রকেটে কাইনেটিক এনার্জি বিশেষ তৈরি হয় না, রকেটও বেশিদূর ওঠে না। রবার্ট কিন্তু হাল ছাড়লেন না, তিনি রকেটের বিভিন্ন কম্পোনেন্ট আর জ্বালানির গুণমান নিয়ে পরীক্ষা শুরু করলেন দ্বিগুণ উৎসাহে। মহাকাশে রকেট তিনি পাঠাবেনই। এমন সময় তাঁর টিউবারকুলোসিস ধরা পড়ল। কয়েক মাসের মধ্যে গডার্ড হাড্ডিসার কঙ্কালে পরিণত হলেন। ডাক্টাররা পুরোপুরি হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন, সবাই জানত গডার্ড বাঁচবেন না। এমনিতেও ছোটবেলা থেকে রোগাভোগা ছিলেন, রোগভোগ লেগেই থাকত। ফলে তিনি যে মনের জোর দিয়ে লড়াই চালাবেন, সে বিশ্বাস কারোরই ছিল না। কিন্তু দেখা গেল, গডার্ডের মধ্যে অদ্ভুত এক পরিবর্তন এসেছে। কিছুতেই তিনি ভেঙে পড়েন না, হত্যদম হন না ডাক্টারদের বিষন্ন মুখ দেখেও। স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, শেষ নিশ্বাস অবধি লড়াই চালাবেন। শরীর সারাতে গডার্ড ওয়ার্ক্সেস্টারে চলে এলেন, ওসুধপত্র চলতে লাগল। মনের জোরেই হোক বা ভাগ্যের জোরে, গডার্ড সে যাত্রা বেঁচে গেলেন। ডাক্টাররা অবাক। গডার্ড অবশ্য নিরুত্তাপ। কাজে ফিরে এসে সহকর্মীদের জানালেন, "মরার চান্সই ছিল না। মহাকাশে রকেট পাঠানোর ব্যবস্থা না করে আমি মরছি না।"

    আবার কাজ শুরু হল নতুন উদ্যোগে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে তাঁকে (বলা উচিত রকেট সাইন্সকে) প্রশ্রয় দেওয়ার জন্য বিশেষ কেউই ছিল না, ইঞ্জিন ফিউল বা শাটল স্পিড নিয়ে গবেষণা করে আর্থিক ভাবে লাভবান হওয়ার সম্ভাবনাও শুন্য। সেকালে মহাকাশ বিজ্ঞান নিয়ে কেউ অত মাথাও ঘামাত না। রবার্ট গডার্ড খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারলেন সুইডিশ বিজ্ঞানী গুস্তাব দে লাভাল স্টিম ইঞ্জিনের জন্য একটা টারবাইন ডিজাইন করেছেন। তাতে বিশেষ ধরনের একটা নোজল ব্যবহার করা হয় বাষ্পকে ব্লো জেটের মাধ্যমে চাকা চালনা করার জন্য। এই নোজল প্রথমে সংকুচিত হয়, তারপর প্রসারিত হয়, ফলে বাষ্পের গতি বেড়ে যায়, হিট টু এনার্জি কনভার্সনের কার্যকারিতাও বেড়ে যায় উল্লেখযোগ্য ভাবে। গডার্ড দেরি না করে গুস্তাবের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করলেন। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এই প্রয়ুক্তির সুবাদে গডার্ডের রকেট এক্সপেরিমেন্ট অন্য উচ্চতায় গিয়ে পৌঁছল। ততদিনে তাঁর আত্মবিশাসও বেড়েছে, পাশাপাশি বেড়েছে দক্ষতাও। পরপর ব্যাপক সব এক্সপেরিমেন্ট করছেন, থিওরি দিচ্ছেন, রিসার্চ পেপার সাবমিট করে তাক লাগিয়ে দিচ্ছেন বৈজ্ঞানিকদের। গডার্ড ততদিনে লিকুইড ফিয়ুল প্রজেকশন নিয়ে সিরিয়াসলি চিন্তাভাবনা করছেন, পাউডার জ্বালানি নিয়ে যে দূরপাল্লার রকেট পাঠানো সম্ভব নয়, সেটা নিয়ে প্রায় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছেন তিনি। আপার অ্যাটমস্ফিয়ারে রকেট পৌঁছতে হলে কীভাবে এগোনো উচিত, সে নিয়ে রাতদিন কাজ করে চলেছেন তিনি।

    ১৯১৭ সালে তাঁর কাজকে প্রথম বড়সড় স্বীকৃতি দেওয়া হয়। গবেষণা চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ওয়াশিংটনের স্মিথসোনিয়ান ইন্সটিটিউট তাঁকে পাঁচ হাজার ডলারের গ্রান্ট দেয়। গডার্ড এই গ্রান্টের সদ্ব্যবহার করেছিলেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। জটিল অঙ্ক করে যখন গডার্ড একের পর এক পেটেন্ট নিচ্ছেন, মিলিটারি রকেট, মাল্টি স্টেজ রকেটারি আর ফিউল প্রোপালশন নিয়ে যুগান্তকারী আবিষ্কার করছেন, তখনই একটা ছোট্ট ঘটনা ঘটে গেল যা এই অসম প্রতিভাশালী বৈজ্ঞানিকের জীবন বদলে দিয়ে গেল চিরকালের জন্য। 

    ১৯১৯ সাল। গডার্ডের অসামান্য গবেষণা A Method of Reaching Extreme Altitudes প্রকাশ করা হল স্মিথসোনিয়ান ইন্সটিটিউটের তরফ থেকে। প্রকাশ পাওয়া মাত্র সাড়া পড়ে গেল সারা দুনিয়ায় বৈজ্ঞানিক মহলে। গডার্ড যে ধরনের ম্যাথেমেটিকাল ক্যালকুলেশন সহ তাঁর বক্তব্য রেখেছেন, তা নিয়ে অনেকেই উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করল তাঁর। কিন্তু গডার্ডের ভবিতব্য ছিল অন্য। এই পেপারে এস্কেপ ভেলোসিটি নিয়ে গডার্ড বেশ কিছু কথা লিখেছিলেন, প্রয়োজনে নিউটনের থার্ড ল ব্যবহার করে আর মাল্টি স্টেজ রকেট যে চাঁদেও পৌঁছে যেতে পারে, সে নিয়েও আশাবাদী ছিলেন গডার্ড। ব্যস! ওইটুকু মন্তব্য নিয়েই মিডিয়া গডার্ডকে খিল্লির পাত্র বানিয়ে ছাড়ল। কী? এই বৈজ্ঞানিক চাঁদে যাওয়ার কথা বলছে? ও বাবা গো! তাঁর গবেষণা, তাঁর অভিজ্ঞতা, তাঁর কষা হাজার হাজার জটিল অঙ্ক গুরুত্ব পেল না, কিন্তু নব্বই শতাংশ মার্কিন কাগজ গডার্ডকে হাসি তামাশার পাত্র বানিয়ে ছাড়ল। জানুয়ারি ১২, ১৯২০ সালে নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রথম পাতায় বড় বড় করে ছাপা হল,  "Believes Rocket Can Reach Moon."

    এডিটোরিয়ালে লেখা হল--

    “That professor Goddard, with his ‘chair’ in Clark College and the countenancing of the Smithsonian Institution [from which Goddard held a grant to research rocket flight], does not know the relation of action to reaction, and of the need to have something better than a vacuum against which to react — to say that would be absurd. Of course he only seems to lack the knowledge ladled out daily in high schools.”

    বলাবাহুল্য, গডার্ডের রিসার্চ বা নিউটনের নিয়ম সম্পর্কে ভুল ধারণা করেছিলেন সাংবাদিকরা। রকেটের ইঞ্জিনের 'push against' কন্সেপ্টের জন্য বাতাসের প্রয়োজন যে নেই, মহাকাশেও সেই নিয়ম কাজ করতে পারে, সে সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না তাঁদের। গডার্ড অবশ্য প্রথম দিকে এই অবৈজ্ঞানিক সমালোচনার জবাব দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন যথাসাধ্য, কিন্তু ততদিনে মিডিয়া তাঁকে জোকারে রূপান্তরিত করেছে। তিনি যাই বলেন, সে নিয়ে একদল সাংবাদিক হাসিঠাট্টা শুরু করে দেয়। 'দ্য লন্ডন গ্রাফিক' তো সব সীমানা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। আমজনতার মনে তখন গডার্ড 'মুন রকেট ম্যান' ওরফে 'ম্যাড রকেট ম্যান' এর ছবি তৈরি করে দেওয়া হয়েছে।

    এই ঘটনা গডার্ডকে পুরোপুরি বদলে দিল। তাঁর সমস্ত উচ্ছ্বাস বিদায় নিল, একেবারে ভেঙে পড়লেন তিনি। দুরারোগ্য অসুখের সঙ্গে লড়াই চালানোর সময়েও তিনি এত মনমরা হয়ে যাননি। গডার্ড ঠিক করলেন, আর নয়! পাবলিক লাইফে এইরকম হেনস্থা হলে তিনি সইতে পারবেন না, মিডিয়া ট্রায়াল থেকে বরং ব্যর্থতা ভালো। নাম না হয় না হোক, গ্রান্ট না পেলে তাই সই। কিন্তু 
    তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, জীবনে আর কোনও লেখা প্রকাশিত করবেন না, কারো সঙ্গে যোগাযোগ রাখবেন না, কাজ করবেন যথাসম্ভব গোপনে। 

    পরবর্তী পঁঁচিশ বছর ধরে গডার্ড একা কাজ চালিয়েছেন। ১৯২৬ সালে প্রথম লিকুইড ফিউল রকেটেকে মহাকাশে প্রেক্ষণ করেছেন, জনপ্রিয় এভিয়েটর আর আবিষ্কর্তা চার্লস লিন্ডবার্গের সাহায্য নিয়ে স্পেস ফ্লাইট আর অত্যাধুনিক রকেটকে স্ট্যাবলাইজ করার কাজ চালিয়ে গিয়েছেন, ইলেকট্রনিক্স আর মিলিটারি ডিফেন্স সিস্টেমে উপকারী একের পর এক আবিষ্কার করেছেন, কিন্তু সামনে আসেননি কোনোদিন। মিডিয়ার ওপর তাঁর এতটাই বিতৃষ্ণা ধরে গিয়েছিল যে সারা জীবনে একবারও ক্যামেরার সামনে আসেননি। সেকালে 'রকেটেরি' সমবেত চেষ্টায় হত, পরস্পরের সঙ্গে রিসার্চ ফাইন্ডিং ভাগ করে নেওয়াই চলন ছিল। কিন্তু গডার্ড কাজ করতেন বিলকুল একা। দু' একজন সহকারী ছিল, ওইটুকুই। অনেকে তাঁকে অহংকারী বলত, আর মিডিয়া তো তাঁকে ভুলেই গিয়েছিল। সরকারও তাঁর প্রতি সদয় ছিল না। পাবলিক ইমেজ ভালো নয় বলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে গঠিত মাল্টি স্টেজ ফ্লাইট রিসার্চ কমিটিতে গডার্ড এর কথা ভাবাই হয়নি, অথচ সারা দুনিয়ায় তাঁর চেয়ে বেশি অভিজ্ঞতা কারো ছিল না। এমনকি জার্মান ভি২ এয়ারক্রাফটেও তাঁর প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছিল বলে শোনা যায়। তাও গডার্ড কলকে পাননি, বরং তাঁকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল জার্মানদের সাহায্যকারী হিসেবে। এমনকি অনেকে বলেছিল, তাঁর জন্যই নাজিরা যুদ্ধ জিতে যাচ্ছে। গডার্ড প্রচন্ড আঘাত পেয়েছিলেন কিন্তু বলেননি কিছুই, উল্টে ইউ এস মিলিটারিকে সাহায্য করে গিয়েছেন শেষ দিন অবধি। 

    'ইকোনমিক কন্সেন্ট্রশন-- হিয়ারিং বিফোর দ্য ইউ এস সেনেট' এর রিপোর্ট পড়লে জানা যায়, দু' একজন বাদে গডার্ডের কাজ বা জীবন সম্পর্কে কারো কোনো ধারণাই ছিল না, তাঁর নিজের দেশের লোকেরাই তাঁকে পাগলা বৈজ্ঞানিক ভাবত। কেন? সেই পুরোনো নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন। পাবলিক পারসেপশন! গডার্ডের ক্যান্সার হয়েছিল, শরীরও ভালো ছিল না। তিনি চিঠিতে এইচ জি ওয়ালসকে লিখেছিলেন, "How many more years I shall be able to work on the problem, I do not know; I hope, as long as I live. There can be no thought of finishing, for "aiming at the stars", both literally and figuratively, is a problem to occupy generations, so that no matter how much progress one makes, there is always the thrill of just beginning."

    যুদ্ধ আর মিসাইলে তাঁর প্রযুক্তি ব্যবহার হচ্ছে, কিন্তু কিছু করার নেই... এই কথাটা শেষ দিন অবধি স্বীকার করতে পারেননি গডার্ড। তিনি চেয়েছিলেন মহাকাশে রকেট পাঠাতে, কিন্তু সেই প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে পরমাণু বোমা বহন করে নিয়ে যাওয়া মিসাইলে, এই আক্ষেপ তাঁর যায়নি। ১৯৪৫ সালের ৯ই আগস্ট নাগাসাকিতে বোমা পরমাণু বোমা ফেলা হয়, ১০ই আগস্ট গডার্ড মারা যান। তাঁর ২০০ টারও বেশি পেটেন্টের অধিকাংশই রেজিস্টার হয়েছে তাঁর মৃত্যুর পর, সে জন্য গডার্ডে পরিবার ও উকিলকে দীর্ঘ মামলা লড়তে হয়েছে মার্কিন সরকারের সঙ্গে।

    একটা মানুষ, যার সারাটা জীবন বদলে গেল শুধু একটা মিডিয়া আর্টিকেলের জন্য। সেই ভুল খবর যদি না ছাপা হত, তাহলে গডার্ডের জীবন ও গবেষণা অন্য স্তরে চলে যেতে পারত! সে হওয়ার ছিল না। কিন্তু এই গল্পে আর একটা কথাই শুধু বাকি আছে। 

    ১৯৬৯ সালের অ্যাপোলো মিশন। মানবজাতি সত্যিই যে দিন চাঁদে পা দিল, দলের সবাই মনে মনে একজন মানুষকে স্মরণ করেছিল। যার সারা জীবনের গবেষণা ও কল্পনাশক্তি ছাড়া এই অভিযান কোনোদিনই বাস্তবের আলো দেখত না। তিনি রবার্ট গডার্ড। 

    বছর পঞ্চাশ আগের কথা। তখনও সাংবাদিকতা পুরোপুরি মারা পড়েনি। নিউ ইয়র্ক টাইমসসের সম্পাদকদের বিবেকে ধাক্কা লেগেছিল। হয়তো কারো মনে ছিল না, কোনো প্রয়োজন ছিল না, কিন্তু দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর পর নিউ ইয়র্ক টাইমসের পাতায় পাবলিক অ্যাপোলজি প্রকাশ করা হয়। চিঠি পাঠিয়ে ক্ষমা চাওয়া হয় গডার্ডের পরিবার্র কাছেও। 

    “Further investigation and experimentation have confirmed the findings of Isaac Newton in the 17th century, and it is now definitely established that a rocket can function in a vacuum as well as in an atmosphere. The Times regrets the error.”

    সে রামও নেই, রামায়ণও নেই। ক্ষমাপ্রকাশ করার দরকার আজকাল আর পড়ে না! শত শত মানুষের জীবন ছারখার হয়ে যাচ্ছে মিডিয়া ট্রায়ালে, আমরা মাথাও ঘামাচ্ছি না। জানি, কিছু করার নেই। তাও এই পোস্টটা দিয়ে রাখলাম। যদি একজনও পড়ে, যদি একজনও সচেতন হয়, যদি একজনেরও মনে দাগ কাটে...

    এইটুকুই।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঝপাঝপ মতামত দিন