এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • স্বাধীণতা  ও  দেশভাগ 

    Sayanti Mandal লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৫ আগস্ট ২০২২ | ৪৭২ বার পঠিত
  • “দ্যাশের মাথারা দ্যাশটাকে ফালা কইর‍্যা দিলো। ভিটা মাটি জমি জিরেত সব বেবাক নায় হয়ে গেল। অহন পোলাপান নিয়ে আমারা যায় কুনখানে’’।
    তবু ছেলেমেয়েরর হাত ধরে তারা বেড়িয়ে পড়েছিল। সবকিছু ফেলে সামান্য কিছু সম্বল মাথায় নিয়ে। যারা কোনোদিন নিজের ভিটের গণ্ডিটুকু ছেড়ে কোথাও যায় নি তারাও চলেছে। কত পথ যে হাঁটতে হবে তার ঠিক নেই। পৌঁছোতে হবে ভারতে। এখন থেকে ওটাই নাকি  “আমাগো দ্যাশ……’’।

    স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছরের উৎসবে মেতে উঠেছে সারা দেশ। তার উত্তাপ অনুভব করছি কমবেশি সকলেই। কার দেশপ্রেম কত বেশি তার একটা প্রতিযোগিতা। অনেকটা ভাব এরকম স্বাধীনতার মর্ম আমার থেকে বেশি কেউ বোঝে না। বীর সব স্বাধীনতা সংগ্রামীরা আমারই আত্মার আত্মীয়। নেহাত ঐ সময় ভাগ্য দোষে জন্মাইনি তাই, নইলে ওরকম আত্মবলিদান দেওয়াটা আমার বাঁয়ে হাতের খেল।  আবেগে থরোথরো ভাষণে সকলকে বূঝিয়ে দেওয়া দেশপ্রেম কাকে বলে।

    লঞ্চঘাটে গিজগিজে ভিড়। সকলেরই অপেক্ষা ষ্টীমারের একটু জায়গা পাবার। নদীর ধারেই গড়ে ওঠে অস্থায়ী ঠিকানা। “নদীর দ্যাশ আমাগো। কত যে নদী। কত বাহারি তার নাম। ভেসে ভেসেই জীবন পার হয়। আর কত রকম মাছ সে নদীতে’’।  দিন দুই অপেক্ষার পর সুযোগ আসে। ভিড়ে গাদাগাদি করে পশুর থেকেও অধম অবস্থায় যাত্রা শুরু হয়।  গোয়া লন্দ থেকে ট্রেন।একবার চাপতে পারলে নিশ্চিন্ত। এই কদিনের মধ্যেই পরিস্থিতি খারাপ হতে শুরু করেছে। খবর আসছে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে দাঙ্গা লেগেছে। ভিটা মাটির থেকে এখন প্রাণের মায়া বেশি।

    ব্রিটিশরা প্রায় তিনশ বছর এদেশে শাসন করেছে। প্রথমে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, পরে ব্রিটিশ রাজ। এসেছিল ব্যবসা করতে। নিজেদের লাভটুকু বুঝে নেবে স্বাভাবিক। গোল বাঁধল শাসক হয়েই। এদেশ তখন তাদের উপনিবেশ।  দেশটার খোলনলচে সব বদলে দিল। গ্রাম শহরে পরিণত হল। আইন আদালত হল। পথঘাট রেল হল।  আইনসভা গঠন হল।  শিল্প হল। বিদ্যালয় কলেজ প্রতিষ্ঠা হল। আধুনিক শিক্ষার প্রসার হল। মোটকথা তাদের বসবাসের উপযুক্ত তারা করে নিল। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী প্রভুত্বটা ছাড়তে পারল না। গোলমালটা হল আধুনিক শিক্ষায় দেশের তখন নবজাগরণ হয়েছে। জাতীয়তাবাদ দেশাত্মবোধ জেগেছে দেশবাসীর হৃদয়ে। কোনটা ন্যায় কোনটা অন্যায় সেটা এদেশের মানুষ বুঝতে শিখেছে। অন্যায় অবিচার অত্যাচারের প্রতিবাদ করতে তারা আন্দোলনেও ভয় পায় না তখন। শুধু নিরস্ত্র নয় সশস্ত্র আন্দোলন। মোটকথা পরাধীনতার জ্বালাটা তীব্র থেকে তীব্র হচ্ছিল।

    শিয়ালদহ স্টেশনে  ট্রেন ঢোকার পর বোঝা গেল “আধখান দ্যাশটাই ভিটাছাড়া’’। স্টেশনের ধারেই তারা ছাউনি বেঁধে অস্থায়ী ভিটা করেছে। গাদাগাদি করে পশুর মতো সেখানে দিন কাটাচ্ছে। না আছে আব্রু, না আছে মান। ক্ষুধার্ত মানুষের দল অস্বাস্থ্যকর সেই পরিবেশে বেঁচে থাকার সংগ্রাম করছে। একবেলা খাবার পাওয়ার জন্য পশুর মতো কামড়াকামড়ি করছে। যারা ওপার থেকে আসছে তাদের অনেকের কাছেই তখন কলকাতা নতুন শহর। দেশভাগের আগে যাদের আত্মীয় পরিজন ছিল এখানে তারা অনেকে সেখানে আশ্রয় নিল। যাদের অবস্থা একটু স্বচ্ছল তারা বাড়িভাড়া করে ছড়িয়ে গেল শহরের নানা প্রান্তে।  “আমার বাপ ঠাকুরদার ভিটে যেমন ছিল বরিশাল, মা দাদুর ভিটে তেমনি খুলনায়। গ্রামের বাড়ি জমি পুকুর, শহরের বাড়ি জমি সবকিছু ফেলে আমরা কলকাতায় এসে পৌঁছলাম। তারপর আমরা কখনো বড়বাগান, টালিগঞ্জ, মেটিয়াবুরুজ হয়ে শেষে বেহালাতে ঠাই পেলাম, তেমনি দিদিমা ভবানিপুর, পাইকপাড়া হয়ে শেষে ট্যাংরাতে থিতু হয়’’।  কলকাতায় বাড়িভাড়াও ধীরে ধীরে অপ্রতুল হয়ে গেল। কলকাতার যেসব এলাকা তখনও ভদ্রলোকের বসবাসের যোগ্য বিবেচিত হত না, সে সব জলা জায়গায় গড়ে উঠল নতুন  নতুন কলোনি। যারা একেবারেই অসচ্ছল তাদের গতি হয় শিয়ালদা প্ল্যাটফর্ম থেকে মধ্যপ্রদেশের দণ্ডকারণ্য, আন্দামান। জীবন সেখানে বড়ই কঠিন।

    ক্রিপস মিশন ব্যর্থ হবার পরথেকেই ভারতবাসী বুঝে গেছিল ব্রিটিশ কোনোদিন তাদের স্বাধীনতা হাতে তুলে দেবে না। ভারতবাসীকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিতে হবে। ব্রিটিশ শাসকের এক শ্রেণীর ভারতবাসীর ওপর অত্যাচার বাড়ছিল, সাধারন ভারতবাসীকে তারা মানুষ হিসেবেই মনে করত না। অপরদিকে যুদ্ধের ফলে দ্রব্যমুল্য বৃদ্ধি, কালোবাজারি  ব্রিটিশ শাসকের প্রতি ভারতবাসীর অনাস্থাকে বাড়িয়ে দিয়েছিল। একদিকে গান্ধীজীর ভারত ছাড় আন্দোলন, অন্যদিকে নেতাজির ব্রিটিশের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ যুদ্ধ। তার সাথে দেশের ভিতরে বিপ্লবী আন্দোলন  ও নানান বিদ্রোহ। ব্রিটিশ ১৯৪৭ সালের জুন মাসের মধ্যেই ভারত ছাড়ার পরিকল্পনা করে নিয়েছিল। তবু শেষ মুহূর্তেও তারা “ডিভাইড অ্যান্ড রুলস’’ছাড়তে পারল না। ওদিকে ভারতের প্রথম সারির নেতারা ভারতের স্বাধীনতার বাস্তবায়নে মেনে নিল দেশভাগ।

    পনেরই আগস্ট ভারতবাসীর স্বাধীনতা উদযাপনের দিন। অনেকের কাছে এটা যেমন আনন্দের তেমনি লক্ষ লক্ষ বাঙালি আর পাঞ্জাবীদের কাছে নিজের ভিটে মাটি হারানোর দিন। ১৯৪৭ সালে প্রায় এক কোটির বেশি মানুষ উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়। পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম এতো মানুষ একসাথে শরণার্থীতে পরিণত হয়। পাঁচ লক্ষেরও বেশি মানুষ মারা যায় দেশভাগজনিত দাঙ্গায়। নোয়াখালি কলকাতার সেই দাঙ্গার ভয়াবহতা আজও শিরার মধ্যে ঠাণ্ডা স্রোত বইয়ে দেয়। দীর্ঘ পঁচাত্তর বছর পরও সেই স্মৃতি বাস্তুচ্যুত মানুষদের তাড়া করে। স্বাধীনাতা বীর শহিদের জয়গান শুধু নয়, একটা প্রজন্মের দেশ হারানোর ইতিহাস। স্বাধীনতার উৎযাপনে আড়ম্বরের মধ্যে যেন তার মূল্যটা হারিয়ে না যায়।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঝপাঝপ মতামত দিন