বন্দে মাতরম্
—শ্রীঅনির্বাণ
মাতৃ আরাধনার মন্ত্র দিয়ে গেছেন শ্রীঅরবিন্দ: 'ওঁ আনন্দময়ী চৈতন্যময়ী সত্যময়ী পরমে'—তুমি ওঙ্কার, তুমি আনন্দময়ী, তুমি চৈতন্যময়ী, তুমি সত্যময়ী হে পরমা (পরম ব্যোমে)।
এই মন্ত্রে মাকে স্পষ্টতই বলা হয়েছে ব্রহ্মময়ী। ব্রহ্ম পরম পুরুষ, আর ব্রহ্মময়ী মা পরমা প্রকৃতি। ব্রহ্মের পরিচয়—তিনি সৎ চিৎ ও আনন্দ। আর মায়ের পরিচয়—তিনি চৈতন্যময়ী ও সত্যময়ী। দুটি ভাবনার তাৎপর্যে কোনো তফাত নাই, আছে কেবল ক্রমের তফাত এবং মায়ের মন্ত্রে ময়-প্রত্যয় যোগের একটি নিগূঢ় ব্যঞ্জনা। ব্রহ্ম সচ্চিদানন্দ আর মা সচ্চিদানন্দময়ী। ব্রহ্ম পরম পুরুষ, আর মা ব্রহ্মময়ী রূপে তাঁর স্বরূপশক্তি, তাঁর পরমা প্রকৃতি। ব্রহ্ম শক্তিমান আর মা তাঁর শক্তি—শক্তিমান এবং শক্তিতে স্বরূপত কোনো ভেদ নাই, ভেদ আছে কেবল তাঁদের যুগনদ্ধতার ব্যাপ্রিয়ায়।
লক্ষণীয়, ব্রহ্মের সৎ চিৎ আনন্দ স্বরূপকে বিপরীত-ক্রমে বিন্যস্ত করেই শ্রীঅরবিন্দ ব্রহ্মশক্তিরূপিণী মায়ের পরিচয় দিচ্ছেন। এতে দুটি ব্যাপারের ইঙ্গিত আছে।
প্রথমত, ব্রহ্ম আর তাঁর শক্তি অভেদ; দ্বিতীয়ত, বিশ্বব্যাপারে তাঁদের ক্রিয়াকে ওতপ্রোত উর্দ্ধ-ত্রিকোণ আর অধস্ত্রিকোণ দিয়ে বোঝানো যেতে পারে। উর্দ্ধ-ত্রিকোণটি ব্রহ্মের আর অধস্ত্রিকোণটি শক্তির প্রতীক। দুটিকে মিলিয়ে পাই একটি ষট্কোণ-যন্ত্র, যা শ্রীঅরবিন্দ তার দর্শনের প্রতীকরূপে ব্যবহার করেছেন।
দ্বিতীয়ত, মাতৃমন্ত্রে আমরা প্রথম পাই আনন্দময়ীকে, তারপর চৈতন্যময়ীকে এবং সবার শেষে সত্যময়ীকে। এই ভাবনা আমাদের সাধন-জীবনের একান্ত অনুকূল।
প্রাকৃত জীবনেও আমরা মাকেই পাই সবার আগে আনন্দময়ী রূপে, প্রেম বা সৌন্দর্য্যের উৎসরূপে। মা-ই আমাদের চিনিয়ে দিলেন পিতাকে। মা আনন্দ, পিতা চৈতন্য বা প্রজ্ঞান, আর দুয়ের অন্যোন্য-সম্মেলনই আমাদের সত্তার সত্য।
মায়ের যে আনন্দ-স্বভাব, তার দুটি বিভাব আছে। একটিতে তিনি বিশ্বের জননী, অপরটিতে তিনি পরম পুরুষের প্রিয়া। তাঁর মহেশ্বরী বা পরমেশ্বরীরূপে এই দুটি বিভাবই সংশ্লিষ্ট। তিনি একাধারে দুর্গা এবং রাধা। এই প্রসঙ্গে স্মরণীয় শ্রীঅরবিন্দের দুর্গাস্তোত্র এবং শ্রীমায়ের Radha's Prayer। দুটি একই অখণ্ড ভাবনার দ্বিদল প্রকাশ।
মা বিশ্বরূপ জগন্মূর্তি। যুগে-যুগে, ঘরে-ঘরে, দেশে-দেশে তাঁর অবতরণ দেবকার্যের সিদ্ধির জন্য। ভারতবর্ষ আবহমানকাল এই মায়ের উপাসনা করে এসেছে। মাতৃ-সাধনা এদেশের—বিশেষ করে বাংলার—একটি বৈশিষ্ট্য। মাকে আমরা যেমন দেখি গর্ভধারিণীরূপে, তেমনি দেখি দেশমাতৃকারূপে, দেখি বিশ্বজননীরূপে। সর্বত্র একই মা। তাকেই বন্দনা করি 'বন্দে মাতরম্' এই অগ্নিমন্ত্রে, উচ্চারণ করি তাঁরই আরাধনার মন্ত্র:
'ওঁ আনন্দময়ী চৈতন্যময়ী সত্যময়ী পরমে'
—তুমি ওঙ্কার, তুমি আনন্দময়ী, তুমি চৈতন্যময়ী, তুমি সত্যময়ী হে পরমা।
শ্রীঅনির্বাণের দৃষ্টিতে শক্তিতত্ত্ব।