এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • ময়েন স্যার

    Kulada Roy লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৪ জুলাই ২০২২ | ৬৮৫ বার পঠিত | রেটিং ৪ (২ জন)
  • আমার শহরের শেষ দেবদূত মানুষটি চলে গেলেন। শহরটি একেবারে নি:শ্ব হয়ে গেল। মনে রাখার মতো আর কেউ থাকল না। 

    তিনি ময়েনউদ্দিন স্যার। আমার হাই স্কুলের বিজ্ঞান শিক্ষক। ক্লাশে ঢুকেই বলতেন, এক চাইতে ১০ নম্বর অংকগুলো করো। অথবা চোখের সঙ্গে ক্যামেরার ছবিসহযোগে তুলনা করো। 

    তারপর তিনি বসতেন চেয়ারে। সামনে টেবিল। বসে বসে নিমিশে তিনি ডুব দিতেন অন্য কোনো জগতে। কখনো তিনি মিটি মিটি হাসছেন। কখনো গম্ভীর হচ্ছেন। কখনোবা গভীর বিষাদ তার মুখে ছড়িয়ে পড়ছে। আমরা ১ চাইতে ১০ নম্বর অঙ্ক করতে করতে, চোখের সঙ্গে ক্যামেরার তুলনা আঁকতে আঁকতে সেই মুখের নানা ভঙ্গিমায় এসে থেমে যেতাম। 

    আমার পাশ থেকে আলী কদর খান কনক বলে উঠত, স্যার এখন রাজশেখর বসু পড়ছেন। পড়তে পড়তে হাসছেন। পথের পাঁচালী পড়ছেন বলে মুখটি গম্ভীর। স্যার এখন অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে পড়তে পড়তে দেখছেন, সোনা অর্জুন গাছে লিখে রেখে যাচ্ছে--আমরা চলিয়া গেলাম।

    জ্যাঠামশাইয়ের খোঁজ নেই। স্যারের মুখটা বিষাদে ভরে গেছে। কান্না লুকোতে স্যার ক্লাশ রুম থেকে বাইরে বেরিয়ে গেছেন। সেখানে অলখে রুমাল দিয়ে চোখ মুছবেন।
    স্যার সব সময়ই পড়ার মধ্যেই আছেন। হাঁটতে হাঁটতে পড়ছেন। বাজার করতে করতে পড়ছেন। প্রাত:কালে নদীতে স্নান করতে করতেও পড়ছেন। এ সময়কালে হাতে কোনো বই নেই। মনের মধ্যে বই আছে। সেগুলোকে মন থেকে বের করে পড়ে চলেছেন। পড়া ছাড়া জগতে আর কোনো অমৃত নেই। অমৃতই জীবন। 

    ভোর হলে আমরা বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ি । ঘুম ভরা চোখ নিয়ে পথের উপরে চলে আসি। দেখতে পাই --দেখতে চাই, স্যার নদী থেকে স্নান সেরে ফিরছেন। পরনে পাঞ্জাবি। সাদা লুঙ্গি। পায়ে সাদা স্যান্ডেল। একজন সফেদ মানুষ হেঁটে চলেছেন। সূর্য উঠছে। গাছে ভেতরে ছায়া ফুঁড়ে আলো ঝিকমিকিয়ে আসছে। তখন তাকে আর কোনো মানুষ মানুষ মানুষ লাগে না। দেবদূতের মতো লাগে। আমার পাগল ঠাকুরমা তাকে দেখিয়ে বলে উঠতেন, সরস্বতী ঠাকুরুনের পুত্রঠাকুর যাচ্ছেন। 

    তাঁর কাছেই আমার ঠাকুরদা আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন। তখন আমি ক্লাশ টু। রোগা। মাঠে খেলতে দিতে ঠাকুরদার ভয়। তার ভয়, ফুটবলের সঙ্গে আমি উড়ে যেতে পারি। 
    তিনি আমাকে দেখলেন। তারপর আমার জন্য একটি আলমারি খুলে দিলেন। সেখানে সন্দেশ, শুকতারা-- বাঁধানো পত্রিকাগুলো আছে। তিনি পড়তে দিলেন অবন ঠাকুরের বুড়ো আংলা। 

    'রিদয় বলে ছেলেটা নামেই হৃদয়, দয়ামায়া একটুও ছিল না। পাখির বাসায় ইঁদুর, গরুর গোয়ালে বোলতা, ইঁদুরের গর্তে জল, বোলতার বাসায় ছুঁচোবাজি, কাকের ছানা ধরে তার নাকে তার দিয়ে নথ পরিয়ে দেওয়া, কুকুর-ছানা বেরাল-ছানার ল্যাজে কাঁকড়া ধরিয়ে দেওয়া, ঘুমন্ত গুরুমহাশয়ের টিকিতে বিচুটি লাগিয়ে আসা, বাবার চাদরে চোরকাঁটা বিঁধিয়ে রাখা, মায়ের ভাঁড়ার-ঘরে আমসির হাঁড়িতে আরশোলা ভরে দেওয়া— এমনি নানা উৎপাতে সে মানুষ, পশুপাখি, কীটপতঙ্গ, সবাইকে এমন জ্বালাতন করেছিল যে কেউ তাকে দু’চক্ষে দেখতে পারত না।'

    আমি প্রতিদিনই স্কুল থেকে সোজা লাইব্রেরিতে যাই। এর মধ্যে স্যারও চলে এসেছেন। নজরুল পাবলিক লাইব্রেরীর দরোজাগুলো খুলছেন। আমিও গুটি গুটি পায়ে ঢুকে পড়ি। ব্যাগ রেখে আলমারি থেকে বই বের করি। পড়তে শুরু করি। তিনিও চেয়ারে হেলান দিয়ে পড়তে শুরু করেছেন। বাইরে ফুরফুরে হাওয়া বইছে। কয়েকটি সেগুনগাছের বড়ো বড়ো পাতা সড়সড় করছে। স্টেডিয়ামে খেলা হচ্ছে। আমরা দুজনে শুধু অন্য জগতে চলে গেছি। 

    এই লাইব্রেরিটি ময়েনউদ্দিন স্যার পেয়েছিলেন এক হিন্দু বাবুর কাছ থেকে। তখন অনেক হিন্দু ছিল শহরটতে। লাইব্রেরিটির নাম ছিল দি করোনেশন লাইব্রেরি। সাত চল্লিশে হিন্দু লাইব্রেরয়ান বাবুটি চলে গেলেন ঐপারে। লাইব্রেরিটির চাবি দিয়ে গেলেন সেদিনকার এক তরুন পাঠক ময়েনউদ্দিনকে। অনুরোধ করেছিলেন, তুমি দেইখা রাইখো। 

    তিনি সত্তর বছর ধরে দেখে রেখেছেন লাইব্রেরিটি। দেশভাগের আগেকার অনেক স্থাপনাই তো ধীরে ধীরে মুছে ফেলা হয়েছে। কিন্তু ময়েন স্যারের হাতে লাইব্রেরিটি আরো উজ্জ্বল হয়েছে। একতলা বিল্ডিং হয়েছে। দেয়ালঘেরা। একটি ফুলবাগানও হয়েছে।বইপত্র বেড়েছে। স্যারও তরুণ থেকে বুড়ো হয়েছেন। তিনিই আমার ভেতরে বইয়ের তেষ্টা ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, পড়ো, জীবনপড়ো। 
    আমি জীবনকে পড়ছি। বুঝতে চেষ্টা করছি বহুজীবনকে। পড়তে পড়তে লিখছি। আমার অনেক লেখার  মধ্যেই স্যার চলে এসেছেন। 

    'মার্কেজের পুতুল' নামের গল্পের বইটি স্যারকে উৎসর্গ করেছি। বইটি নিয়ে গেল-জানুয়ারিতে ষোল বছর পরে স্যারের বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছি। শুনতে পেলাম স্যার ঘুমুচ্ছেন। গ্রিল দিয়ে ঘেরা স্যারের বারান্দা। ভেতরে যেতে পারিনি। স্যারকে দেখার সুযোগ পাইনি। বইটি তাঁর হাতে দিতে পারিনি।বাড়ির লোককে দিয়ে বলেছিলাম, স্যার জেগে উঠলে বইটি তাঁর হাতে দেবেন। 

    কাল স্যার চলে গেলেন। যেতে যেতে হয়তো কোনো বই পড়ছেন। পড়তে পড়তে হাসছেন। গম্ভীর হচ্ছেন। ম্লান হচ্ছেন। 

    আর আমি দূর দেশে বসে কাঁদছি। তাঁর মতো তো আর কেউ নেই আমার শহরটিতে। কেউ রইলও না। কেউ আসবেও না। 

    তিনি আমাকে নির্মাণ করেছিলেন। পড়তে শিখিয়েছিলেন। লিখতে উস্কে দিয়েছিলেন। 
     
    প্রিয় ময়েনউদ্দিন স্যার, প্রিয় দেবদূত--আপনাকে প্রণাম।
    ০৭/১২/২০২২

     

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • aranya | 2601:84:4600:5410:25e0:85fd:2fd:***:*** | ১৪ জুলাই ২০২২ ২২:২৯509858
  • অপূর্ব 
  • Katha Haldar | ১৬ জুলাই ২০২২ ০৪:১৬509916
  • স্যারের উদ্দেশ্যে আমার প্রণাম রইল।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। না ঘাবড়ে প্রতিক্রিয়া দিন