ধর্মীয় আচার ব্যাবহার বা ধর্মের প্রতি আবেগ অনুভূতি এই উপমহাদেশে খুব বেশি। আমরা যারা এই উপমহাদেশের বাসিন্দা তাই অন্যান্য দেশের মানুষ যতই তাদের জীবন ধারণের মানদণ্ড উন্নত হোক না কেন তাতে কিছুই যায় আসে না। ধর্মের মোহ মানুষের চিন্তা জগতকে কতোটা নির্মমভাবে প্রভাবিত করতে পারে, তার দৃষ্টান্ত বিশ্ব ইতিহাসে বিরল নয়। মানুষের চিন্তায় ধর্মের মতো একটা কাল্পনিক এবং তাদের দৈনন্দিন জীবন জীবিকার সাথে প্রকৃতিগতভাবে সম্পর্কহীন বিষয়টা কিভাবে এতো বিপূলভাবে সম্পৃক্ত, সমৃদ্ধ ও বিকশিত হতে পারলো, সেই প্রশ্ন আমাদের অনেকেরই। অনুভূতিতে আঘাত লেগেছে এই অজুহাতে উগ্র ধর্মবাদিরা নিজ ধর্মের সমালোচকদের বাকস্বাধীনতা কেড়ে নিতে চাইছে, শুধু তাই নয়, তাদের অস্তিত্বও নিশ্চিহ্ন করতে চাইছে। ধর্মীয় আদর্শ অন্য সকল মতাদর্শকে পিছনে ফেলেছে শুধু নয়, জ্বালাও, পোড়াও, ভাঙচুর, ফতোয়া, ফাঁসির দাবি, গ্রেফতার, খুন, কিছুই থামছে না। প্রকৃতপক্ষে প্রতিনিয়ত তাদের হত্যা করে চলেছে।
বিজ্ঞানের এই বিপূল অগ্রগতির যুগে মানুষের চিন্তা যেখানে যুক্তিবাদের দ্বারা পরিচালিত হওয়ার কথা ছিল, সেটা না হয়ে বরং তার উল্টোটাই ঘটে চলেছে অহরহ। কয়েক হাজার বছরের এই ধর্মীয় মতাদর্শ তার মৌলিক নীতির কোনো পরিবর্তন না ঘটিয়েও কিভাবে কাল্পনিক সর্বশক্তিমানের অস্তিত্ব মানুষের মনে যুগ যুগ ধরে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে এবং বতর্মান সময়েও নিজের প্রাসঙ্গিকতার বিস্তার ঘটাচ্ছে, সে আলোচনা এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি অন্যান্য মতাদর্শ নিরলস চর্চা করেও সেই সাফল্য অর্জন করতে ব্যর্থ।
প্রথমে মুসলমানদের নবী বিতর্ককে সামনে রেখে কিছু কথা বলতে চাই। যেভাবে সারা ভারতবর্ষের মুসলিম সমাজ সহ তামাম মুসলিম বিশ্ব ঐক্যবদ্ধভাবে তাদের প্রিয় নবীজীর অসম্মানের প্রতিবাদ করছে এবং সেই অপরাধের প্রতিবিধান চাইছে তা দেখে আমার মনে হয়েছে যদি জীবন জীবিকার সাথে সম্পর্কযুক্ত বিষয়গুলো নিয়ে মানুষ এভাবে ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ সংগঠিত করতো, তবে দেশে হয়তো বিপ্লবের জমি তৈরি হয়ে যেতো। যে বিপ্লবের স্বপ্ন প্রতিটি সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ নিজেদের মনে লালন করে।
আরেক টা ঘটনা ঘটেছে। একটি ডকুমেন্টারি ফিল্ম কালীর পোস্টার যেটিতে হিন্দু দেবী কালীকে সিগারেট খাওয়ার চিত্র দেখানো হয়েছে । আবার এলজিবিটি ফ্ল্যাগ তার হাতে দেখা গেছে। এ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। ক্ষোভ এটাকে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের জন্য নিন্দিত আখ্যা দিচ্ছে। যে মহাকালীকে উপহাস করা হচ্ছে এবং হেয় করা হচ্ছে। তারা চিত্রনায়িকা লীনা মণিমেকলাইয়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক প্রবণতা যেটা বতর্মান ভারতবর্ষ তথা বিশ্বের কাছে চ্যালেঞ্জ, সেটা হোলো মানুষকে মানুষের বিরুদ্ধে ধর্ম নিয়ে লড়িয়ে দেওয়া। মানুষের পরিচয় ধর্ম দ্বারা নির্ধারিত হওয়া। আমি মানুষ, সেটার থেকেও বড় আমি কোন ধর্মের লোক।এই বিভাজন ধ্বংস করছে মানবিক ঐক্যকে। ধ্বংস করছে মানুষের সম্মিলিত ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদী শক্তিকে। যেটা রাষ্ট্রের মূল উদ্দেশ্য। রাষ্ট্র চায় তার সকল শ্রম শক্তির অনৈক্য। কারণ শ্রম শক্তির ঐক্যবদ্ধ রূপকে রাষ্ট্র ভয়ের চোখে দেখে। এই কারণেই পরিকল্পিতভাবে নবি বিতর্কের সৃষ্টি। নতুন একটা ইস্যু চাই। সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের সম্মিলিত ক্ষোভ বৃদ্ধি পাচ্ছিল। মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, সাস্থ্য, শিক্ষা, দুর্নীতি প্রভূতি বিষয় এবারের লোকসভা নির্বাচনের ইস্যু ছিল। সরকারের কাছে কোনো উত্তর ছিল না। তাই মানুষের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘোরাতে হবে। তারই ফল এই নবী বিতর্ক। সারা দেশ উত্তাল। সরকার তার উদ্দেশ্যে সফল। একদিকে হিন্দু সেন্টিমেন্টকে ভিত্তি করে বিজেপি হিন্দু ভোট ঐক্যবদ্ধ করতে চাইছে। অপরদিকে আমাদের রাজ্য মুসলিম সেন্টিমেন্ট কাজে লাগিয়ে মুসলমানদের পাশে দাঁড়াতে চাইছে। এই খেলা সাধারণ হিন্দু বা মুসলমানরা ধরতে পারছেন না। মেতে উঠেছে পৈশাচিকতায়। একটা চরম অব্যবস্থা। এভাবেই সব চলবে। চলছেও। মোহাম্মদ রিয়াজ আর গাউস মোহাম্মদ উদয়পুরের কানাইয়া লালের ঘটনাটি ধরে নিন।
আমরা সত্যি অবাক হই এটা ভেবে যে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের নানান ব্যাথা, যন্ত্রণা, হতাশা-যা আমরা প্রতিদিন প্রতি মুহুর্তে অনুভব করে চলেছি, তার জন্য কে দায়ী, কেন দায়ী কিভাবে তার সমাধান - এই সরল প্রশ্নগুলো আমাদের মনে স্থান পায়না। অথবা স্থান পেলেও তার সত্যিকারের অভিমুখ নির্বাচন করতে আমরা প্রায়শই ব্যর্থ হই। ফলে ভুল অভিমুখের কারণে আমরা দিকভ্রষ্ট হই। চক্রাকারে আবর্তিত হতে হতে পূর্বের জায়গায় ফিরে আসি। আমরা বিশ্বাস করি এইসকল যন্ত্রণার কোনো উপশম নেই। আমরা বিশ্বাস করি এ সবই আমাদের কর্মফল। আমরা বিশ্বাস করি এ সব পূর্ব নির্ধারিত। আমরা বিশ্বাস করি একমাত্র ঈশ্বরই পারেন এই যন্ত্রণার অবসান ঘটাতে। আসলে বিষয়টা সাধারণভাবে দেখলে এমন সরল সমীকরণ ছাড়া অন্য কিছু আসবে না। কারণ কোনো কিছুর উপর বিশ্বাস স্থাপন তখনই সম্ভব, যখন সেই বিষয়ের যুক্তিসঙ্গত ইতিবাচক ফলাফল আমরা প্রাত্যহিক জীবন দিয়ে উপলব্ধি করতে পারি এবং সেটা জীবনের মানোন্নয়নে প্রয়োগ করতে পারি। ধর্মের ক্ষেত্রে বিশ্বাস অর্জনের এই নিয়ম খাটেনা। তবুও কেন ধর্ম মানুষের এই বিশ্বাস অর্জন করতে সমর্থ হোলো? এমনটা নয় যে শুধুমাত্র বিজ্ঞান বিরোধী মানুষরাই ধর্মে আস্থা রাখেন। অনেক বিজ্ঞানীকেও ধর্মের উপর প্রবল আস্থা রাখতে দেখা গেছে। কারন এখানে বিবিধ। কিছু মানুষ আছেন, যারা নিজের দক্ষতার উপর আস্থাহীন। আত্মবিশ্বাসের অভাবজনিত কারণে জীবনের সফলতার জন্য তারা কোনো না কোনো অবলম্বন খোঁজেন। আধ্যাত্মবাদের সাফল্য এইজন্যই যে এই মতবাদ বাস্তবের রুক্ষতা থেকে অনেক দূরে নিয়ে গিয়ে মানুষকে এক স্বপ্নীল সুখময় জীবনের স্বপ্ন দেখায়। বোঝানো হয় একমাত্র নিরলস ঈশ্বর সাধনাই সেই লক্ষ্যে পৌঁছনোর একমাত্র পথ। তাই সেই ঈশ্বরের জয়গান করলেই যদি এমন জীবন পাওয়া যায়, তবে কেন মানুষ অন্য মতাদর্শ গ্রহন করবে? কী আশ্চর্য ! তাই না,
দেশের জ্বলন্ত সব সমস্যাগুলিকে খুব কৌশলে এড়িয়ে, দেশ এখন ধর্মীয় ভাবাবেগ নিয়ে উত্তাল। আর আমরা নির্বাক হয়ে তা শুনছি, যাইহোক।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।