১৯৭১ সালে পূর্ব বাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের অভ্যুত্থান ভারতে তথা পশ্চিম বঙ্গে আমাদের এপারের বাঙালিদের কাছে অনেকগুলো নতুন বার্তা বয়ে এনেছিল। গোড়ার দিকে তার অনেক কিছুই আমরা বুঝিনি। বুঝতে পারিনি। তার সমস্ত কিছু আত্মসাৎ বা আত্মস্থ করতে আমাদের সময় লেগেছে। এক একবারে অল্প অল্প করে বুঝেছি। উনিশ্শ আশির দশকে এসে অনেকটা বুঝেছিলাম বলে এখন মনে পড়ছে। অবশ্য তত দিনে রাজনীতির সূত্রে বাংলাদেশের একটি কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে আমাদের দলের সম্পর্ক স্থাপিত হয়ে যাওয়ায় এবং ওপার থেকে বিভিন্ন নেতা কর্মীরা নিয়মিত এপারে আসতেন বলে তাঁদের থেকে শুনে শুনে অনেক কিছু আমরা অল্প অল্প করে বুঝতে পেরেছিলাম।
কী বুঝেছিলাম?
আজ মনে হচ্ছে, এই প্রশ্ন আমাদের এপারের লোকদের নিজেদেরকে করা দরকার।
আমরা ভারতীয় বাঙালিরা প্রায় ভুলেই ছিলাম যে পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণ বাঙালি এবং তারাও বাংলা ভাষায় শুধু কথা বলে তাই নয়, তারা বাংলায় কবিতা লেখে, নাটক করে, গল্প উপন্যাসের জন্ম দেয়। বাংলাতেই সিনেমা করে। তারাও রাগ হলে বাংলাতেই গালি দেয়। খুশি হলে বাংলাতেই প্রশংসা করে। ১৯৭১ সালে আমাকে কেউ জিগ্যেস করলে আমি ওদেশের একজনও লেখক বা কবির নাম বলতে পারতাম না। একটা সিনেমার নাম বলতে পারতাম না। পরে জেনেছি, এই অজ্ঞতা আমার একার নয়। আমাদের পশ্চিম বাংলার এক ব্যাপক অংশের মানুষই এরকম অজ্ঞ ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ সেই অজ্ঞতা ভাঙতে শুরু করল। তবে সেই অজ্ঞতার অসীম আসুরিক শক্তি। বিগত পঞ্চাশ বছরেও তা খুব বেশি ভাঙেনি। খানিকটা মচকেছে মাত্র।
আজ অবিশ্বাস্য লাগলেও বলি, আমার জানায় পশ্চিম বাংলায় ১৯৭২ সালের আগে কোনো দিন ২১শে ফেব্রুয়ারিতে কোথাও কোনো অনুষ্ঠান হয়নি। ১৯৫২ সালের সেই আন্দোলনের রক্তাক্ত ইতিহাস কি এপারের কেউ—অন্তত আমাদের গুরুজন স্থানীয়রা—জানতেন না? অবশ্যই জানতেন। তথাপি, তাতে বাঙালি হিসাবে গর্ব বোধ করার প্রেরণা জাগেনি। আমাদের স্কুলবেলায় কোনো শিক্ষক (এমনকি বাঙাল হলেও) কোনো দিন গল্পচ্ছলেও ক্লাসে এসে ভাষা আন্দোলনের সেই গৌরবময় গাথার রোমন্থন করেননি। পূর্ব বাংলা তখনও আমাদের দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ বুদ্ধিজীবী চেতনায় পাকিস্তান। পাকিস্তানেরই অংশ। মুসলমানের দেশ। হিন্দুদের তাড়িয়ে দেয়। ওদের আবার সংস্কৃতি কী? আমাদের বাংলা সাহিত্যের প্রথিতযশা অধ্যাপক—সুকুমার সেন, অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রমুখ—যখন বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস লিখেছেন, ছোট কিংবা বড় বই, স্কুল স্তর বা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য, তাতে কখনই ওদেশের বাংলা সাহিত্যের ঠাঁই হয়নি। মধ্যযুগের দুচার জন মুসলমান কবি তাতে দুএক পৃষ্ঠার আশ্রয় পেলেও আধুনিক কালের কাউকেই আমাদের চোখে পড়েনি এবং/অথবা মনে ধরেনি।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ প্রথম সেই দিকে আমাদের দৃষ্টি ফেরাল। আমাদের মধ্যে ওদেশকে জানার প্ররোচনা যোগাল। রাতারাতি আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ বেতারের অনুষ্ঠান শুনে (সেই বেতারকেন্দ্র তখন কলকাতায় বসেই কাজ করছিল) শিখে ফেললাম সেই হৃদ্তন্ত্রীতে নাড়া দেওয়া গান, “আমার ভাইয়ের রক্ত রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি?” শিখলাম, “আবার যখন গান ধরেছি গাব গো সেই গান,/ অত্যাচারীর বিরুদ্ধেতে খড়গ কৃপান!” কিংবা, “শহিদ মিনার ভেঙেছ আমার ভাইয়ের রক্তে গড়া,/ দেখ, বাংলার হৃদয় এখন শহিদ মিনারে ভরা।” এরকম আরও অনেক গান। সেই সময় কলকাতারই কোনো সিনেমাহলে দেখেছিলাম এক অনবদ্য বায়োস্কোপ—“জীবন থেকে নেওয়া”। এই প্রথম সামসুর রহমান, জহির রায়হান, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস আমাদের পত্রপত্রিকায় আলোচ্য হয়ে উঠলেন। আমরা ভালো করে জানলাম মৌলানা ভাসানির লিগ ছেড়ে বেরিয়ে গিয়ে ন্যাপ আর কৃষক মজুরদের নিয়ে বৃহত্তর গণ সংগ্রাম গড়ে তোলার কথা।
মুক্তিযুদ্ধের বছরটাতে ছেড়ে যেতে হবে জেনে পাকিস্তানি শাসক ও সেনা কী ভয়ঙ্কর নৃশংস বর্বর অত্যাচার চালিয়ে গেছে বাংলাদেশের নরনারীর উপর, আমি জেনেছি ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে ঘুরতে গিয়ে। সেই সব শুনেছি আর ভেবেছি, ধর্মীয় গোঁড়ামি মানুষকে কতখানি অমানুষ করে দিতে পারে, তার যেন লক্ষ লক্ষ নমুনা পাকিস্তান বাংলাদেশের ঘরে ঘরে রাস্তায় পুকুরের ধারে, ঝোপেঝাড়ে শহরে গ্রামেগঞ্জে ছড়িয়ে রেখে গেছে। আসলে পূর্ব পাকিস্তানই তো ছিল পাকিস্তানের বৃহত্তর অংশ। অন্তত জনসংখ্যার বিচারে। আর ভূগোলের দুহাজার কিলোমিটারের ফাঁক কি ঠুনকো ধর্মের মিল দিয়ে পূরণ করা যায়? কিন্তু ক্ষমতার ভরকেন্দ্র ছিল পশ্চিমে। পূর্ব ছিন্ন বাহু ছিল কাঁচামালের আড়ত। তাকে ওরা ছেড়ে যায় কী করে?
ইংরেজ আর ভারতীয় বণিকরা মিলে এই এক আশ্চর্য দেশের পরিকল্পনা করেছিল বটে। সাম্প্রদায়িক সমস্যা সমাধানের নামে, তাদের এই দেশ ভাগ, আসলে দুটো প্রদেশ ভাগ, প্রকল্প কোটি কোটি মানুষের জীবনে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে কী সব মারাত্মক সমস্যার বোঝা চাপিয়ে দেবে, তারা কি ভেবে দেখেছিল? শুধু তো উদ্বাস্তু সমস্যাই নয়। ভাষার সমস্যা। পরিবহন। রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা একবার ভেঙে দিলে তাকে নতুন করে জোড়া দেওয়া কি মুখের কথা? চাল আর মাছ বাদ দিয়ে বাকি খাদ্যের উপকরণের যোগান আসবে কোত্থেকে? স্কুল কলেজের জন্য কাগজ, হাসপাতালের জন্য ওষুধপত্র?
ইতিহাসে কোনো দিন শাসকরা সাধারণ মানুষের কথা ভাবে না। ইংরেজ ভাবেনি, অবিভক্ত ভারতের ভাবী শাসকরা ভাবেনি, পাকিস্তানি শাসকরা ভাবেনি, . . . ।
স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষও অচিরেই আবিষ্কার করলেন, বাংলাদেশের নবাসীন শাসকরাও ভাবছে না।
পাকিস্তান আমলের শেষ নির্বাচনে জয়ী আওয়ামি লিগ দল ভারত সরকার তথা ইন্দিরা গান্ধীর সৌজন্যে পাকোত্তর কালে মসনদে বসে গেল। ১৬ ডিসেম্বরের বিজয় তো আর মার্চে ঘোষিত ভোটের ফলাফলের পাদটীকা নয়। মুক্তিযুদ্ধ একা আওয়ামি লিগের সদস্যরাই করেনি, বহু দল এবং বহু নির্দলীয় মানুষ তাতে অংশগ্রহণ করেছেন, বিশাল ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করেছেন। স্বাধীন সরকারে যাতে তাঁদের কেউ ক্ষমতার ভাগ না পায়, তা সুচারুভাবে দেখা হল। আর যারা ক্ষমতার তখতে বসল, তারা এমন একটা গণতন্ত্রের কুর্সি বানাল, যার চারটে পায়ার নীচেই তেঁতুল বীচি রাখা আছে। স্বাধীনতার ছয় বছরের মধ্যেই বাংলাদেশ আবার ঢুকে গেল পাকিস্তানি আমলের মতো সেনা ব্যারাকের খাপে। ক্ষমতার উচ্চাসন থেকে মুক্তিযুদ্ধ সংশ্লিষ্ট নায়কদের একে একে সরিয়ে সামনে উঠে এল মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী সেনানায়করাই।
সে যাক গে’। সে ওদের অভ্যন্তরীন ব্যাপার। আমাদের অত ভাবার কী আছে? আমাদের আজকের সমস্যা হল, বাংলাদেশের ভেতরের ঘটনাবলির প্রচার কীভাবে এদেশের রাজনীতিকে, সমাজমনকে প্রভাবিত করে।
বাংলাদেশ থেকে দলে দলে হিন্দুরা কেন ভারতে চলে আসছে? মুসলিমরা তো ভারত থেকে দলে দলে বাংলাদেশে যাচ্ছে না! তাহলে কি সংখ্যালঘু নিপীড়ন বাংলাদেশে ভারতের চাইতে বেশি হয়?
অনেকেরই জানা নেই, বিভাজনের পর হিন্দুরা যেমন পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে বিপুল স্রোতের মতো ভারতে চলে আসতে থাকে, সংখ্যায় বা স্রোতের অর্থে ততটা না হলেও মুসলিম জনসংখ্যার একটা বেশ বড় অংশ হিন্দুস্তান ছেড়ে পাকিস্তানে চলে যায়। প্রথমটা যতটা জানা আছে, প্রচারে আসে, দ্বিতীয়টা তেমন করে জানা নেই এবং প্রচারেও আসে না। ঘটনাটা তাই বলে অস্বীকার করা যায় না। তা সত্ত্বেও এটা সত্য যে এপারে চলে আসা হিন্দুদের সংখ্যা ওপারে চলে যাওয়া মুসলমানের চাইতে অনেক বেশি।
একেবারে বিভাজনের মুখে—কদিন আগে বা পরে—যারা পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে এদেশে চলে এসেছিল তারা মূলত দাঙ্গাহাঙ্গামার ভয়ে বা কারণেই চলে এসেছিল। তার পর থেকে যারা এসেছে, তাদের প্রায় সকলেই এসেছে ওদিকের তুলনায় এপারে বেশি সুযোগ সুবিধা পাওয়ার লোভে বা প্রত্যাশায়। তারা এপারে এসে যে দাঙ্গার গল্প শোনায় তা অনেক ক্ষেত্রেই মিথ্যা বা অতিরঞ্জিত। এই নিয়ে সুলেখা সান্যালের ১৯৪৮ সালে লেখা “বাস্তুভিটা” নামে একটা চমৎকার গল্প আছে। অগ্রণী (ফাল্গুন ১৩৫৫) পত্রিকায় বেরিয়েছিল। নিজে উদ্বাস্তু পরিবারের সদস্য হওয়ার কারণে আমি এমন অনেককে খুব কাছ থেকে চিনি যাঁরা উদ্বাস্তু খাতায় নাম লিখিয়ে যত রকম সরকারি সুযোগ সুবিধা পাওয়া যায় সব নিয়েছেন। ওপারে জমিবাড়ি বাঁচিয়ে রেখে, বিক্রিটিক্রি করে এদিকের ব্যবস্থায় নিশ্চিন্তে যোগ দিয়ে তারপর “আমগ দ্যাসে অখন আর হিন্দু গো থাকনের উপায়ই রাখে নাই” বলে জমিয়ে রসিয়ে গল্প করে। অনেকে এপারে চলে আসার পরেও ওপারে জমি বাড়ি ব্যবসা সব অক্ষত রেখে এসেছেন এবং মাঝে মধ্যে গিয়ে সেগুলির দেখাশোনা করেন। সম্পদ সংগ্রহ করে আনেন।
এই সমস্ত তথ্যের যদি আনুপূর্বিক সংখ্যাতাত্ত্বিক সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করা যেত, তাহলে অনেক বিস্ময়কর ঘটনা আমাদের সামনে উন্মোচিত হত।
তার মানে কি বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা নেই?
তা নয়। আছে। বেশ গভীরেই আছে। ভারত পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ—এই তিন ভাইয়েরই সাম্প্রদায়িকতায় হাত পাকানো আছে একশ বছরেরও বেশি সময় ধরে ঐক্যবদ্ধ ঐতিহ্যের সূত্র হিসাবে। তবে প্রচারের কৌশলে, আমরা ভারতীয়রা পাকিস্তান বা বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক ঘটনার খবর যতটা সবিস্তার জানি, নিজেদের দেশেরটা সেই মাপে জানতে পারি না। সংবাদ মাধ্যম এবং সরকারি নিয়ন্ত্রণ এই ছাঁকনির কাজটা খুব সুচারুভাবে সম্পন্ন করে থাকে। একই ভাবে পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের রাষ্ট্রগুলিও তাদের গণমাধ্যমকে এমন ভাবে চালায় যাতে সেই দেশের লোকেরা ভারতের সংখ্যালঘু নির্যাতনের খবর যে পরিমাণে পায়, নিজ নিজ দেশের সংখ্যালঘুদের উপর নিপীড়নের খবর তার একশ ভাগের এক ভাগও পায় না।
বিপরীত দিক থেকে বাংলাদেশে এবং পাকিস্তানে সেকুলার গণতান্ত্রিক শক্তিগুলি যে মাত্রায় সংখ্যালঘু নির্যাতনের নিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়, তার খবর ভারতে প্রায় আসেই না বলা যায়। অনুরূপে, ভারতের বামপন্থীরা যতটুকু সাম্প্রদায়িকতার বিরোধিতা করে, সংখ্যালঘুদের পাশে দাঁড়ায়, সেই খবরও যেন বাংলাদেশ বা পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ জানতে না পারে, রাষ্ট্র এবং বৃহৎ গণ মাধ্যম তা সুনিশ্চিত করে ফেলে। তিন দেশেরই সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী এবং রাষ্ট্রীয় শক্তির মধ্যে এ এক আশ্চর্য মৌন বোঝাপড়া।
তথাপি একথা অনস্বীকার্য, বাংলাদেশে ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে একটা রাজনৈতিক অভ্যুত্থান হয়েছে বলে এবং ভাষার প্রশ্নকে কেন্দ্র করেই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে বলে, ভারত ও বাংলাদেশের রাষ্ট্র পর্যায়ে যাই পরিকল্পনা হয়ে থাকুক, সাধারণ শিক্ষিত মানুষদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা একটা ভালো রকম গভীরতা পর্যন্ত প্রোথিত হতে পেরেছে, যাকে গত পঞ্চাশ বছরের নিরন্তর প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এখনও মুছে ফেলা সম্ভব হয়নি। উপর থেকে বোঝা না গেলেও ভাষা আবেগ ধর্মীয় আবেগের তুলনায় অনেক গুণ বেশি শক্তিশালী। সেই কারণেই তো মধ্য প্রাচ্যে ইসলামের পতাকার নীচে এতগুলি দেশকে একটা দেশ এক জাতি হিসাবে গড়ে তোলা হয়নি। অসংখ্য টুকরো টুকরো ছোট ছোট দেশ হয়ে আছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এই ভাষা চেতনাই এত সক্রিয় যে আমরা ওপারের সাহিত্য সংস্কৃতি গান কবিতা সিনেমার খবর না রাখলেও ওপারের ওরা কিন্তু পশ্চিম বঙ্গে এবং ভারতের অন্যান্য জায়গায় বাংলাতে কী কী কাজ হচ্ছে, কে বা কারা করছে, সমস্ত খবর রাখে। এই একই কারণে, বাংলাদেশে প্রকাশিত বইপত্র পশ্চিমবঙ্গ বা ত্রিপুরায় যত বিক্রি হয়, আমাদের এদিককার প্রকাশিত বই পত্রপত্রিকা বাংলাদেশে তার চাইতে অনেক বেশি বিক্রি হয়ে থাকে।
অবশ্য অনেক বই চুরি করেও ছাপানো হয়। আন্তর্জাতিক কপিরাইট আইন লঙ্ঘন করে। কিন্তু তাতেও আমার উত্থাপিত থিসিসটাই আরও বেশি করে প্রমাণিত হয়। প্রবাসেও এই প্রবণতা কাজ করে চলেছে। ইউরোপে আমেরিকায় অস্ট্রেলিয়ায় যে সমস্ত প্রবাসী ভারতীয় বাঙালি বসবাস করেন, তাঁদের উদ্যোগে যে বাংলা সংস্কৃতির চর্চা হয়ে থাকে, তাতে বাংলাদেশের প্রবেশাধিকার থাকে না বললেই চলে। সেটা গান, সিনেমা, নাটক, উপন্যাস—যা নিয়েই হোক। পক্ষান্তরে বাংলাদেশের যে বাঙালি এই সব দেশে প্রবাসে থাকেন, হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে তাঁরা সমগ্র বাংলা সংস্কৃতিরই অনুশীলনকে বাঁচিয়ে রাখেন। বাংলা ভাষার প্রতি আবেগ ও ভালোবাসাটা তাঁদের অনেক বেশি গভীর অসীমান্তিক ও সর্বজনীন। আমাদেরটা বরং অনেক বেশি খণ্ডিত আঞ্চলিক এবং পক্ষপাতদুষ্ট।
বাংলাদেশে হিন্দুদের দুর্গাপূজার সময় মৌলবাদী হামলার খবর আমরা প্রচুর পাই। সেগুলো মিথ্যা নয়। কিন্তু অন্য আর একটা খবর আমরা কার্যত পাই না। বাংলাদেশের হিন্দুদের সংখ্যা পশ্চিম বাংলার হিন্দুদের তুলনায় চার ভাগের এক ভাগ। অথচ ওদেশে দুর্গাপূজার সংখ্যা পশ্চিম বাংলার চাইতে বেশি। ঘনায়মান সাম্প্রদায়িকতার পরিবেশে এটা কী করে সম্ভব হয়?
পশ্চিম বাংলায় মুসলমানের জনসংখ্যা ২৮ শতাংশ হলেও সরকারি চাকরিতে মুসলমানের অস্তিত্ব তিন শতাংশের বেশি নয়। পক্ষান্তরে বাংলাদেশে হিন্দু জনসংখ্যার অনুপাত আট শতাংশ হলেও সরকারি চাকরিতে হিন্দু কর্মচারির অনুপাত প্রায় ২৭ শতাংশ। এটাই বা কী করে হয়?
এই সমস্ত তথ্য তুলে ধরার কারণ হল, আমরা যে নানা ক্ষেত্রে একপেশে খবর পেয়ে থাকি, এবং পূর্ণাঙ্গ ছবি পাই না, সেই কথাটা যাতে আমাদের মাথায় ঢোকে।
বাংলাদেশে এক স্কুলের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে ২০১৭ সালে অত্যন্ত অসম্মান জনকভাবে ধর্মীয় অবমাননার কথা তুলে যে আওয়ামি লিগ এমপি লাঞ্ছনা করেছিল, দেশ জোড়া প্রতিবাদের ফলে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়েছে। যদিও ভক্তকে আবার এক মিথ্যা ঘুসের মামলায় ফাঁসানো হয়েছে। মুক্তচিন্তক অভিজিত রায় বা অনন্ত বিজয় দাশের হত্যাকারীদের অবশেষে আদালতে শাস্তি ঘোষণা হয়েছে। হৃদয় মণ্ডলের অবমাননাকারীরাও বাংলাদেশে পার পায়নি। দেরিতে হলেও দশ দিনের মাথায় তিনি জামিন পেয়েছেন। ভারতে অনুরূপ ঘটনায় কপিল মিশ্র বা অনুরাগ ঠাকুরের কোনো শাস্তি তো দূরের কথা, পুলিশ এমনকি এক রাতের জন্যও তাদের স্পর্শ করেনি। পহলু খানের হত্যাকারীরা হত্যার ভিডিও ছড়িয়েও “প্রমাণের অভাবে” আদালতে বেকসুর ঘোষিত হয়েছে। নরেন্দ্র দাভোলকর, গৌরী লঙ্কেশের হত্যাকারীরা ভারতে নিশ্চিন্ত যে পুলিশ তাদের গায়ে হাত দেবে না। ওমর খালেদকে দুই বছরেরও বেশি সময় বিনা বিচারে জেলে আটকে রাখা হয়েছে। এই সব ঘটনার পাশাপাশি তুলনা করলে ভারত ও বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক হিংসা ও সংখ্যালঘু নির্যাতনের যতটা সাদৃশ্য দেখা যাবে, অপরাধ দমনে ততটাই বৈসাদৃশ্য চোখে পড়বে। ভারত এখন সংখ্যালঘু ও দলিত নির্যাতক হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক অপরাধীদের জন্য সেজ হয়ে উঠেছে। পাকিস্তান ও বাংলাদেশকে অনেক পেছনে ফেলে।
আমরা আশা করব, বাংলাদেশ গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করে তার অসাম্প্রদায়িক মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সম্প্রসারিত করে বিশ্বের সামনে আবার মাথা তুলে দাঁড়াবে। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বৎসর পূর্তিতে এই আশা করাটা নিশ্চয়ই খুব বেশি দাবি নয়।
[এই রচনার একটি সামান্য ভিন্ন ভাষ্য বাংলাদেশ বিষয়ক একটি সঙ্কলনে স্থান পেতে চলেছে।]
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।