তাহলে শোন অমিয়, আমার নিজের জীবনের কাহিনী বলি তোমাকে। আমি চাকরী করার এতদিন পরে আজও দুঃস্বপ্ন দেখি আমি চাকরী পাইনি। 1997 এ কলেজ থেকে পাস করার পর আমি এই চাকরী পাই 2002 সালে। এই সময় টা হন্যে হয়ে চাকরী খুঁজেছি। আমার কলেজমেট, সিনিয়র জুনিয়র পাড়ার দাদা, সবার কাছে গিয়ে একটা কাজ চাইতাম। অফিস পাড়া তে গিয়ে নিজের সিভি অফিসে অফিসে জমা দিয়ে আসতাম, কিন্তু কোথাও কোনো চাকরি পাচ্ছিলাম না। রানাঘাট থেকে শেয়ালদা মান্থলি টিকিট কেটে নিতাম মাসের শুরুতেই। এসে কলকাতাতে যেখানে যা পেতাম অ্যাপ্লাই করতাম। এমনকি স্টেশন এর গায়ে কাঁচা হাতে লেখা কর্মখালি বিজ্ঞাপন গুলোতেও অ্যাপ্লাই করে দিতাম। গিয়ে দেখতাম সেগুলো হয়তো কোনো দোকানের সেলসম্যান বা কনস্ট্রাকশন কোম্পানিতে মিস্ত্রির চাকরি। শেষমেষ একটা জব কনসালটেন্সি তে ফিস দিয়ে রেজিষ্টার করলাম। তখন কলকাতায় চাকরীর আকাল, ওখানে থেকে দু একটা করে ইন্টারভিউ দিচ্ছে, কিন্তু সবই মোটামুটি বাইরের কোথাও কল সেন্টার এর চাকরী। বাড়ির একমাত্র সন্তান হবার সুবাদে বাইরে যেতেও পারছি না। তাছাড়া টাকাপয়সা যা দেবে বলেছিল, তাতে হিসেব করে দেখেছিলাম হয়তো ঘর থেকেই আরো এক্সট্রা টাকা দিতে হতো। বাড়ির অবস্থাও ভালো ছিলো না। হটাৎ দেখি ইন্টারভিউ কল আসা বন্ধ হয়ে গেলো। ল্যান্ডলাইনে ফোন করলে শুধু এনগেজ টনে আসে। কিছু দিন পর গিয়ে দেখি সেই অফিসে তালা বন্ধ। আসে পাশে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম কনসালটেন্সি টাই বন্ধ হয়ে গেছে। আমার মত আরো অনেকেই এসে ঘুরে গেছে।
পুরোদস্তুর হতাশ হয়ে গেছি। হটাৎ একদিন বাড়ীতে একটা চিঠি আসে। খাম খুলে দেখি ইন্টারভিউ কল লেটার। স্টার ইনস্ট্রুমেন্ট বলে একটা কোম্পানির সেলস এর ওপেনিং। ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে সেলস এর চাকরী করবো!! হাতে কোনো চাকরী নেই, বেকার বসে আছি কিন্তু তাও সেলস এর চাকরীর ইন্টারভিউ শুনেই একটু ইতস্তত করছিলাম। শেষমেষ বাবার কথা শুনে গেলাম ইন্টারভিউ দিতে। সাদামাটা অফিস কিন্তু কর্মব্যস্ত লোকজন। রিসেপশন এ গিয়ে বললাম আজ আমার ইন্টারভিউ আছে। ওখানে বসা রিসেপশনিস্ট বললো - নাম?
- মানব পাত্র।
- আপনার বাড়ি রানাঘাটে। আজকেই এসেছেন? জল খাবেন? আপনি একটু বসুন আমাদের এমডি স্যার এখনো আসেননি। উনিই আপনার ইন্টারভিউ নেবেন।
শুনেই কিরকম খটকা লাগলো। কোম্পানির এমডি স্বয়ং ইন্টারভিউ নেবে! মনে কু গাইছে। ঘন্টা খানেক অপেক্ষা করার পর এক ভদ্র লোক সুট বুট পরে অফিস ঢুকলেন। রিসেপশনিস্ট আমার ব্যাপারে ওই ভদ্রলোককে বললেন। তারপর ভদ্রলোক ঢুকে গেলেন লোকের লাগোয়া চেম্বারে। খানিক পরে রিসেপশনিস্ট মহিলা আমাকে বললেন আপনি রেডী থাকুন স্যার এখুনি ডাকবেন আপনাকে। আমি জিজ্ঞেস করলাম
- যিনি এখন ঢুকলেন উনিই কি এমডি স্যার?
- হ্যাঁ।
আবার খটকা! এমডির এরকম একটা চেম্বার। শিওর ফ্রড কেস।
- যান। স্যার ডাকছেন আপনাকে।
ঢুকে পড়লাম। ইন্টারভিউ টা টেকনিক্যাল কম, হাবিজাবি আলোচনা করেই কাটলো। যেহেতু সেলস এর চাকরী, যা বুঝলাম কথা বলার স্কিল বাজিয়ে দেখছিলেন। আমার কথাবার্তা শুনে ওনার পছন্দ হয়েছিল। ওখানেই চাকরী বাকরী পাকা কথা হয়ে গেলো। সেলস এর চাকরী। বিভিন্ন কোম্পানিতে গিয়ে ওদের তৈরি ইনস্ট্রুমেন্ট বিক্রি করতে হবে। মাস গেলে আমাকে 1600 টাকা দেবে। নো ওয়ার্ক নো পে। কিন্তু মাল বেচতে পারলে ইনসেনটিভ দেবে। আসলে ঐ ভদ্রলোক ছিলেন আইআইটি থেকে পাস করা। কিছুদিন এমএনসি তে চাকরী করার পর নিজেই এন্টারপ্রেনার হয়ে গেছেন। এবং নিজের কোম্পানিতে নিজেই এমডি।
রঘুদা ছিলো আমার সিনিয়র। শুরুর দিকে সাথে করে বিভিন্ন কোম্পানি তে নিয়ে যেত। ওর কাছেই শেখা যে কোম্পানিতে মাল বেচতে যাবো, ওখানে পিয়ন থেকে শুরু করে সবাই কে "স্যার" বলতে হয়। আমাদের একটাই পরিচয় " ভেন্ডর"। কেমন করে স্যার দের খুশি করে মাল বেচতে হয়, আসতে আসতে করে শিখে নিচ্ছি। কোন ঠাকুর কোন ফুলে সন্তুষ্ট হয় শিখছি। রঘুদা আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে, যা স্কুলে কলেজে শেখানো হয় না। বলতে গেলে কাজের দুনিয়ায় রঘুদাই আমার শিক্ষাগুরু। শুরুর মাস দুয়েক দাদার সাথেই যেতাম। তো একবার হয়েছে কি, কলকাতার চৌরাঙ্গী তে একটা অফিসের পারচেজ ম্যানেজার এর কাছে আমাদের কিছু মেটেরিয়াল এর ডিল করতে গেছি। রঘুদা তেল দেবার মাস্টার, আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে অনেক গুণগান করে - বলে রায় সাহেব খুব ভালো লোক.... একেবারে মাটির মানুষ.... রায় সাহেব আছে বলেই আমাদের কোম্পানি এত বড় বড় অর্ডার গুলো পায়। জানিস রায় সাহেব রোজ কতদূর থেকে আসেন? সেই আসানসোওওল থেকে! আরো অনেক কিছু...
ওই কোম্পানি খুব ভালো পেমেন্ট প্রসেস করে দিত, পুরনো রেকর্ড তাই বলছে। ওখানে খুব বেশি মার্জিন না রেখেই আমরা অফার দিতাম। হটাৎ এই রায় সাহেব বলে বসে, আচ্ছা আমি যে তোমাদের অর্ডার প্রসেস করবো, তাতে আমি কি পাবো? এমনিতে এর আগে এই কোম্পানিতে কেউ কখনো এরকম কিছু চায়নি। এই কোম্পানির ডিরেক্টর এর সাথে আমাদের এমডি স্যার এর ভালো সম্পর্ক আছে। তাও ব্যবসার খাতিরে আমি বললাম - আমি তো স্যার আপনাকে এই ব্যাপারে কিছু বলতে পারবো না। আমি এমডি স্যার এর সাথে কথা বলে আপনাকে জানাবো।
অফিসে ফিরে এসে এমডি স্যার কে বলাতে উনি একটু মুচকি হেসে আমাকে বললেন - পাত্র, এরা চুনোপুঁটি। তাও চেয়েছে যখন তুমি বলবে আমাদের এমডি সাহেব নিজে একটা ভালো লেদার ব্যাগ আপনার জন্য পাঠিয়েছে। আর ধর্মতলা থেকে একটা ব্যাগ কিনে নিয়ে যাবে।
পরদিন সকালে যথারীতি আমি ব্যাগ কিনে নিয়ে গিয়ে একটা পিসিও বুথ থেকে ওনার ল্যান্ডলাইনে কল করে এমডি সাহেবের শেখানো বুলি আউরে দিলাম। উনি খুব খুশি হলেন। আর বললেন - শোন তুমি তাহলে ব্যাগ টা নিয়ে আমাদের অফিসের সামনে ফুটপাথে একটু দাড়াও আমি আসছি।
অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিছুক্ষন এর মধ্যেই দেখলাম রায় সাহেব আসছেন। আমার দিকে হনহন করে হাঁটতে হাঁটতে এসে আমার কাছে এসে অলমোস্ট ব্যাগ টা হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে সোজা হাঁটা লাগালেন। কিরকম একটা খারাপ লাগতে লাগলো। যাই হোক অর্ডার টা আমরা হপ্তা খানেকের মধ্যেই পেয়ে যাই।
ভগবানের কৃপায় এর কিছু দিনেই মধ্যেই আমি ইস্কো এ অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে জইন করি। পোস্টিং বার্নপুর।
আস্তে আস্তে করে ধাতস্ত হচ্ছি নতুন লাইফে। বার্নপুরে টাউনশিপ বেশ ভালো। জমজমাট বাজার আর যোগাযোগ ভালই। ডিপার্টমেন্টে ঢুকে কাজ কর্ম শিখছি। আমি রোলিং মিল মেন্টেন্যান্স ডিপার্টমেন্টে জয়েন করি। ভেবে অদ্ভুত লাগতো, যে আমার রোল টা হটাৎ কিরকম উল্টে গেছে। এই দিন কতক আগে পর্যন্ত আমি মার্কেটিং করতে সাহেব দের কাছে যেতাম এখন লোকে আমার কাছে আসছে।
একদিন সন্ধ্যে বেলা, ডিউটি থেকে বেরোতে বেরোতে অনেকখানি দেরি হয়ে গেছে। ফেরার পথে রোজ একবার করে একটা চায়ের দোকানে ঢু মারতাম। সেদিন চা খেতে গিয়ে দেখি দোকানে দাড়িয়ে আছে সেই রায় সাহেব। হাতে সেই আমার হাত থেকে "ছিনিয়ে নেওয়া" লেদার ব্যাগ। পুরনো লোক দেখে ভালো লাগলো, গিয়ে ডেকে কথা বললাম - রায় সাহেব আপনি এখানে?
উনি উল্টে আমাকে প্রশ্ন করলেন তুমি এখানে কি করছ?
বললাম -আমি ইস্কো এ জইন করেছি এই একমাস হলো।
- তা বেশ। কোন পোস্টে জইন করলে?
- অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার। রোলিং মিল মেন্টেন্যান্স ডিপার্টমেন্ট।
শুনেই ওনার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। ব্যাগ হাতে নিয়ে হনহন করে হাঁটতে হাঁটতে ওখান থেকে পালিয়ে বাঁচলেন মনে হলো। কিরকম অদ্ভুত লাগল ব্যাপারটা।
পর দিন অফিসে ঘটনার কথা বলি। ডেসক্রিপশন শুনে আমাদের ফোরম্যান চন্দন বাবু বললেন - ও বুঝেছি। আপনি অজয় রায় এর কথা বলছেন। ওনার স্ত্রী আমাদের ডিপার্টমেন্টেই আছেন। সুলেখা বলে যে মেয়েটি আমাদের কাগজপত্র নিয়ে যায়, অজয় রায় তারই হাসব্যান্ড। সুলেখার বাবা ইস্কো তেই ছিলেন, রিটায়ার করার আগেই হার্ট অ্যাটাকে মারা যায়, সুলেখা চাকরিটা পায়, লোকে বলে অজয় নাকি টাকার লোভেই সুলেখা কে বিয়ে করেছিল।
ভাবো অমিয়! সময়ের কি পরিহাস। যে লোক টা নিজের ক্ষমতা দেখিয়ে আমার হাত থেকে ব্যাগ টা ছিনিয়ে কাল পালিয়েছিল। সেই লোক টাই আজ আমাকে দেখলে মুখ লুকিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।