এখনকার শ্রম কোড , নতুন অপরাধের জন্ম দেবে: যা জানতে পারা গেছেঃ
মৃত ভাদু সেখ রামপুরহাট এর অন্ধকার জগতের বাদশা হয়ে ওঠার আগে সরকারি কাজে লাগা ভাড়া গাড়ির ড্রাইভার ছিলেন আর কংগ্রেস করতেন আর তখনকার মস্তান আঙুর সেখের সংগে থাকতেন। আপাতত পুলিশের কাছে ধরা দিয়েছেন আনারুল , তিনি নাকি বগটুই হত্যাকান্ডের মূল পান্ডা, আগে ছিলেন মুর্গির মাংসের দোকানের কর্মচারী। এখন দুজনেই নাকি ঘটনার সময় সেখানকার বড়শোল পঞ্চায়েতের তৃণমূল নেতা। এর আগেও নানা ভয়ানক অপরাধ সেই গ্রামেই ঘটেছে। গ্রামের অনেকে নাকি ঘরছাড়া।
এইবার ভয়ানক অপরাধ ঘটেছে, প্রাণহানি ঘটেছে, অপরাধের চক্রের প্রভাব ক্রমশঃ বাড়ছে , বালি ও পাথরের খাদানের ট্রাকে করা তোলাবাজি ই নাকি এই প্রভাব খাটানোর মূল উৎস। এগুলো আমরা সবাই খবর পেতে শুরু করেছি।
ভাদু নাকি বডি গার্ড পুশতেন হাজার হাজার টাকা মাইনে দিয়ে , তাদের কাছে নাকি থাকতো বে আইনি অস্ত্র। সেসবও খবরে আসছে। বিচার প্রচেষ্টা সিআইডি, সিট, সিবিআই ইত্যাদি কিছু শুরু হয়েছে, হয়্তো কিছু অপরাধী ধরা পড়বে, তবে জনমত ও আইনের চাপ বজায় রাখতে না পারলে আমি ব্যক্তিগত ভাবে আদৌ ভরসা করার কোন কারণ দেখছি না।
স্বল্সশিক্ষিতের উচ্চাকাঙ্খা
আমি বীরভূমের ছেলে, খুব বেশি শিক্ষিত নই, সর্ব অর্থে খুবই মধ্যমান। বিশ্বায়নের সময়কার সরকারী নীতির সুবিধা পেয়েছি আমার প্রজন্মের অনেকের মতো। শ্শরমের দাম না পাওয়া মানুষের টাকার আর মানুষের ট্যাক্সের টাকায় চলা শস্তার পাবলিক সেকটর শিক্ষার সুযোগের পরে কিছু পেশাভিত্তিক ট্রেনিং করে কাজ করি সংসার চালাই।
এই হানাহানি ক্রুদ্ধ ও করে দুঃখ দেয়। হতাশার মধ্যে ভাবছিলাম একটু অন্য কথা। ১৯৯০ এর পর থেকে , যখন থেকে বাঙালি মায়ের ছেলেরা বাঙ্গালোর চলে যাচ্ছে বলে একটা রোল উঠেছিল, যার ফলেই পরবর্তীতে সেক্টর ফাইভ রাজার হাট সার্ভিস সেক্টর ইত্যাদি, আমি ভাবছিলাম, শুধু পশ্চিমবঙ্গ না, সারা দেশেই স্বল্প শিক্ষিতের সামাজিক অর্থনৈতিক উচ্চাকাংখা চরিতার্থ করার উপায়, সোশাল মোবিলিটির উপায় সরকারি পলিসি তে ঠিক কি আছে, তার কতটা রামপুরহাটে ছিল? (এই গোটা সময় জুড়ে আছে চীনের উত্থান, কৃষি তে নীতি সমর্থনের ক্ষয়, শ্রমিক অধিকারের ক্ষয়, প্রচুর ছোট উ্ৎপাদন সংস্থার নানা সংকট। পড়াশুনো, স্বাস্থ্যক্ষেত্রের ,জীবন যাপনের খরচ বৃদ্ধি। এখন তার সঙ্গে জুড়ে গেছে সরকারি চাকরি বস্তুটাকেই লোপাট করার প্রচেষ্টা। রাষ্ট্রের কাছে নাগরিক কি চাইতে পারে তার মৌলিক সংজ্ঞাই বদলে যাচ্ছে, অথচ যারা বদলাচ্ছেন তাদের নাম দেওয়া হয়েছে পপুলিস্ট, যাতে সেটুকুকেও নীতির দক্ষিন যাত্রায় গড়ে পিটে নিতে সুবিধা হয়।)
ধরা যাক, সরকারী চাকরি বা তার সংরক্ষন নীতি ইত্যাদি। তো সরকারী চাকরি জিনিস টা , বিশেষ করে স্কুল মাষ্টারি, কলেজ মাশ্টারি, অন্যান্য পাবলিক সারভিস কমিশন, ইত্যাদির একটা এখনকার তুলনায় অপেক্ষাকৃত নিয়মিত নিয়োগ ছিল, বেশ, কিন্তু সেটা তো স্বল্প শিক্ষিতের জন্য না। ২০১৩-২০১৪ পরে সেসব ও নিয়মিত থাকে নি। সারভিস সেকটর এর বাড় বাড়ন্তে , স্বল্পশিক্ষিত যুবক যুবতি পেয়েছেন টা কি? কল সেন্টার একটা উত্তর, তবে রামপুর হাটে সেসবের বালাই নাই। উৎপাদন শিল্প , মেক ইন ইন্ডিয়ার ভাঁওতা বাজির আগে ও পরে , কি এমন বেড়েছে, যে লক্ষ কোটি মানুষের কাজ আছে, হিসেব করলে দেখাই যাবে, ৯ এর দশকের শেষ দিক থেকেই পশ্চিমবঙ্গ বিহারের মতই সারা দেশের লেবার সাপ্লায়ার।
৮ এর দশকের ভূমি সংস্কারে কিছুটা, গ্রামীন বাজার বৃদ্ধিতে কিছুটা হয়তো ঠেকানো গেছিল, কিন্তু তথ্য প্রযুক্তি কিংবা আর্থিক পরিষেবা ব্যবসা ও চাকুরি ক্ষেত্র, একটু সম্মানজনক নানা গোত্রের অভিবাসন আর ২০১০-১১ পর্যন্ত সরকারী চাকুরি, নানা স্তরের শিক্ষকতা, স্থানীয় প্রশাসনে কিছু কাজ, মোটামুটি গ্রাজুয়েট ছেলেমেয়েদের একটা হিল্লে হতে হয়তো কিছুদিন করেছে, কিন্তু বাকিটা তো মহাশূন্য। তৃণমূল একটি মহা ভুল ভাল পার্টি, নানা ধরণের ব্যাপক চক্রান্ত দিয়েই তাদের ক্ষমতায় আনা হয়েছে, অপরাধের আইনি বা নির্বাচনী শাস্তি তাদের কপালে আছে কিনা জানি না, মানুষ সচেতন হলে আছে না হলে নেই, লড়াই তে কিছু মানুষ থাকবেন সে পর্যন্ত ঠিক।
কিন্তু স্বল্প শিক্ষিতের উচ্চাকাংখা একমাত্র ইমারতি ব্যবসা আর তোলাবাজি ব্যাবসায় যে আধা আইনি বা বে আইনি চরিতার্থতা পেল, সেটার রাজনৈতিক লাভ যারা তুললেন, তাদের সমালোচনা করা এমনকি ভোটে হারানোর প্রচেষ্টার সঙ্গে সঙ্গে একটু খেয়াল রাখা দরকার, আমাদের বীরভূমে কিন্তু মানুষের রোজগার বাড়ানোর তেমন কিছু অবশিষ্ট নাই, এবং সারা দেশেই এই অবস্থা। এটা ন্যাশনাল স্কিল এজেন্সি , আর ডিমনিটাইজেশনের ধাপ্পাবাজি দিয়ে, মেটানো সম্ভব না, আবার সবাই কে বিনা পরীক্ষায় উচ্চ্মাধ্যমিক পাশ করিয়েও মেটানো সম্ভব না।
অন্যদিকে পরিযায়ী শ্রমিকদের ন্যূনতম নিরাপত্তা না থাকাটাও কিন্তু সমস্যা, গ্রামীন রোজগার প্রকল্প দিয়ে সবটা হচ্ছে না। পেশাদার সমাজে
উচ্চাকাঙ্খাকে সাফল্যের শর্ত হিসেবে ধরা হয়, স্বল্পশিক্ষিত দের ক্ষেত্রে তার অন্যথা হবে কেন। কেন ড্রাইভারের স্বচ্ছল শুধু না বিত্তবান হবার ব্যবস্থা আরো সমবন্টিত হবে না।
অপরাধে শিউরে উঠুন, কিন্তু সরকার গুলোর আর্থিক নীতির সীমাবদ্ধতা তেও আপনার আত্মারাম খাঁচাছাড়া হওয়াই উচিত। এবং সেটা শুধু মধ্যবিত্ত দৈনন্দিনের সীমিত অভিজ্ঞতায় না, তার বাইরেও তার একটা পরিসর আছে। গতকাল চা ওয়ালার টেলিভিসনে কুইজ কন্টেস্ট জেতা বা হোয়াইট টাইগার পড়ে বা সিনেমা দেখে চমকেছেন, আজ প্রাক্তন ড্রাইভার আর মুর্গীর দোকান ওয়ালার প্রাসাদ দেখে চমকাছেন। স্ট্রাইক কেন লোকে ডাকছে, সেটাও একটু ভাবুন, অপরাধের মনস্তত্ত্বের কাটাছেঁড়া র থেকে সেটা একটু দীর্ঘস্থায়ী ভাবনা হবে।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।