রাজার বোন বুলি
রাজার মা যেদিন মারা গেল, সেদিন আমাদের পাড়ায় উপচে পড়ছিল ভিড় মেয়েদের। সেদিন ছিল পর্য্যায়ক্রমে রোদ এবং বৃষ্টি, সেই সঙ্গে শনি কিংবা রবিবারের ছুটি। বেশ বেলা করে ভাত খাবার পরেই বৃষ্টি থেমে গিয়ে ঝলমলিয়ে রোদ উঠল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই গলির একদম ভেতরের বস্তি থেকে শববাহকেরা আর দেরি না করে দৌড়ে বেরিয়ে পড়ল। তারা যেন বৃষ্টি থামার অপেক্ষাতেই ওৎ পেতে ছিল। মোড়ের মাথায় আমাদের বাড়ির কাছটায় আসতে না আসতেই পাড়ার যত সধবা মেয়ে ছিল সবাই হুড়মুড়িয়ে পড়ল রাজার মায়ের ডেডবডি থেকে সিঁদুর ভাগাভাগি করে নিতে। আমরা ছোট বাচ্চারা দোতলার বারান্দার ওপর থেকে ঝুঁকে এই চমকপ্রদ লাইভ শো উপভোগ করছিলাম। রাজা, মানে পাড়ার নামকরা রাজাগুণ্ডা, তার বড় ভাই গোপাল - এরা দুজনে খাটিয়ার সামনের দিকটা ধরে রেখেছিল, পেছনের দিকটায় তেমন চোখে পড়বার মত কেউ ছিল না। রাজার বাবা বিষ্টু ড্রাইভার তখন মদ খেয়ে এতটাই বেসামাল যে তাকে সামলাচ্ছিল কয়েকজন লোক। রাজার বোন বুলিকে দেখা যাচ্ছিল তেমাথার মোড়টায় ফ্রক পরে দু কোমরে হাত রেখে দাঁড়িয়ে থাকতে। বুলির তখন বছর পনর বয়স হবে। সে যে ডেডবডি, খাট, ভিড়, এসমস্তর দিকে তাকাচ্ছিল না, তা বোঝা সম্ভব হয়েছিল কারণ দোতলার বারান্দা থেকে সব কিছুরই একটা চমৎকার ভিউ পাচ্ছিলাম আমরা। বুলি ওসব ভিড় থেকে বেশ খানিকটা দূরত্ব রেখে এদিক ওদিক মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছিল। যারা জানে না, তাদের পক্ষে বোঝা সম্ভবই হবে না যে, যে খাটটাকে ঘিরে সিঁদুর নেবার জন্য কাড়াকাড়ি পড়ে গেছে, সেই খাটের ওপরে শোয়ানো ডেডবডিটা বুলির গর্ভধারিণীর। তবে হ্যাঁ খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, যে ওর খালি পা, অন্য দিনের মত ও কিন্তু খরখরে গলায় চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কথা বলছে না। শববাহকেরা চলে গেলে, সে স্বাভাবিক ভাবে হেঁটে হেঁটে গলির ভেতরে চলে গেল। একবারও তাকে চোখের জল মুছতে দেখলাম না। মুছবে কোত্থেকে, চোখ দুটো একদম শুকনো ছিল ওর।
তখন বিংশ শতাব্দীর শেষ চতুর্থাংশের তাৎপর্যপূর্ণ সময়কাল। দিল্লি ও বাংলার মসনদে ঘটে গেছে ক্ষমতার হস্তান্তর। বুলির মায়ের মৃত্যুর দেড় দুবছরের মধ্যেই দেশের রাজনীতিতে আমূল পরিবর্তন ও নানান স্থানীয় ঘটনার রেশে আমাদের উত্তর কোলকাতার পাড়াতেও উত্তেজনার শেষ নেই। মধ্যবিত্ত বাড়ির ছাদে ছাদে নিত্য নতুন টিভির অ্যান্টেনা বসছে, খালপাড়ের কোল্ডস্টোরেজে আগুন লেগেছে —সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে পুড়েছে বাটার অয়েল। খবরের কাগজে এ নিয়ে নিয়মিত লেখা হয়। অন্য পাড়ার লোকে আমাদের কাছে খোঁজখবর নেয় আগুনের সর্বশেষ পরিস্থিতি ব্যাপারে। এতো আগুন নয়, যেন ফাগুন লেগেছে বনে বনে! সেই আগুনের ধোঁয়ার গন্ধে ও ছায়ায় সারাটা পাড়া আচ্ছন্ন হয়ে থাকে। বুলিকে দেখাই যায় না। আগে সে সকালে বিকেলে পাড়ার মোড়ে টহল দিয়ে যেত, খরখরে স্বরে একে ওকে শাসাত, অবিকল ক্ল্যাসিকাল ডান্সারদের স্টাইলে মাথাটা ঢকঢক করে নাড়িয়ে এদিক ওদিক দেখে বীর দর্পে পেছন ফিরে গলির ভেতরে মিলিয়ে যেত, তার ফ্রকের পিঠের দিকে বোতামগুলো সব ছেঁড়া ছিল, দুটো সেফটিপিন দিয়ে আটকানো থাকত পিঠের দিকটা, পিঠের অনেকটাই দেখা যেত তখন। বুলি টেপফ্রক বা ব্রা কোনওটাই পরত না ফ্রকের ভেতরে। এই দেড় দু বছরের মধ্যে সে নিশ্চয় পনেরো থেকে বেড়ে ষোলো কি সতের হয়ে গেছে। মনে হয় মায়ের মৃত্যুর পর সংসারের রান্নাবান্না ও অন্যান্য সাংসারিক কাজের ভারে সে ব্যস্ত, পাড়া বেড়াবার সময় পায় না। ওরা তো আর মাইনে দিয়ে কাজের লোক রাখা অ্যাফোর্ড করতে পারে না। রাজার জীবনেও তখন গুরুত্বপূর্ণ সময়। আগে যে পার্টির ছত্রছায়ায় সে বেড়ে উঠেছিল সে পার্টি হেরে ভূত হয়ে গেছে। রাজা শেল্টার খুঁজছিল। ক্ষমতাসীন দল অচিরেই রাজাকে দলভূক্ত করে নিল। পাশাপাশি দুটো পাড়ার মধ্যে নিয়মিত ক্ষমতার লড়াই চলে। কাছেই বিশাল বড় হাট বসে সপ্তাহে দুবার করে— বুধবার ও রবিবার। হাটে পন্য বেচতে আসা প্রতিটি ব্যবসায়ীর কাছ থেকে তোলা আদায়ের দায়িত্ব কোন পাড়ার গুন্ডাদের ওপর ন্যস্ত থাকবে সেই অস্পষ্ট সীমারেখা নিয়েই রোজ মারামারি, নিয়মিত পেটো পড়ে সন্ধের দিকে, লম্বা লম্বা ড্যাগার নিয়ে বীর বিক্রমে ছুটে যায় মাস্তানেরা একে অপরের দিকে। মারামারির চেয়ে চেঁচামেচিটা হয় বেশি। পুলিশ আসে না প্রথম দিকে, ঘন্টা খানেকের মধ্যে যুদ্ধ না থামলে তবে আসে। অন্য পাড়ার গুন্ডারা কিন্তু নতুন শাসকদলের কাছে শেল্টার পায় নি। বাবুয়া, লাল্টি, বাবলি, ইত্যাদি নাম লড়াইয়ের সময় গালিগালাজ মিশ্রিত চিৎকার থেকে শোনা যায়। একদিন দেখা গেল বুলি গোলাপী নাইলনের শাড়ি পরে সন্ধের মুখটায় হেঁটে যাচ্ছে শত্রুপক্ষের পাড়ার দিকে। পায়ে ম্যাচিং কালারের প্লাস্টিকের চটি। কায়দা করে চুল বেঁধেছে, সেই আগের মত ডিঙি মেরে হাঁটার স্টাইল, দেড় দুবছরেই মেয়ে থেকে বিলকুল মহিলা বনে গেছে। খবরে প্রকাশ শত্রুপক্ষের মাস্তান লাল্টি তার লাভার।
এর কিছু পরে দুপাড়ার মধ্যে ক্ষমতার লড়াই প্রায় থেমে গেলেও এই শান্তিস্থাপনের পেছনে বুলির কোনও ভূমিকা ছিল না। নিজের পাড়া ও লাভারের পাড়ার মধ্যে মারপিট বন্ধ করানোর কোনও উৎসাহ বা আগ্রহ তার আদপে কখনও ছিল বলে মনে হয় না, থাকার কোনও ভিত্তিও নেই। মারপিট কমে যাবার পেছনে একটা কারণ হয়ত রাজার পার্টি বদলানো, অন্যটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ - পাশের পাড়ায় সুপরিকল্পিতভাবে একটা নাগরিক অভ্যুত্থান হয়, অর্থাৎ জনগনের প্রোটেস্ট। তোলাবাজি নিয়ে গুন্ডামি বন্ধ করতে সেখানে একটা শান্তিকমিটি তৈরী হয়। এক ঢিলে দুই পাখী মরল, সন্ধেবেলার বোমাবাজি প্রায় বন্ধ হল এবং আগের চেয়ে অনেক বেশি সঙ্ঘবদ্ধ পদ্ধতিতে হাটের ব্যাপারীদের থেকে সুষ্ঠুভাবে তোলা আদায়ের ভার নিল শান্তিকমিটি। আগে পুলিশকে আলাদা করে পেমেন্ট করবার যে ব্যাপারটা ছিল সেটাও কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত হতে লাগল। দ্বিপাক্ষিক চুক্তি অনুসারে এক পাড়ার গুন্ডা-মাস্তানদের অন্য পাড়ায় প্রবেশ নিষেধ। বুলি সম্ভবত তখন অন্য পাড়ায় পাকাপাকি ভাবে চলে গেছল, সংসারের কাজ রান্নাবান্না ইত্যাদি সামলানোর জন্য ওদের বড়দা গোপাল বিয়ে করে নিল, এবং সৎভাবে জীবিকা নির্বাহ করতে দুইভাই ও কয়েকজন বন্ধু মিলে মোটরগাড়ি সারানোর একটা ব্যবসা খুলে ফেলে গলির মোড়ে। গুন্ডামি ছেড়ে মোটর মেকানিক হলেও রাজা ক্বচিৎ একটা দুটো পেটো বাঁধত। শোনা যেত, তার হাত খুব স্টেডি। সবাই বেশ খুশি হয়েছিল শুধু মারপিট কমে যাবার জন্যই নয়, হাটের গা ঘেঁষে সিনেমাহলের অপোজিটে সন্ধেবেলায় দলবেঁধে সস্তার বেশ্যারা দাঁড়াত - তাদেরও পাকাপাকি ভাবে উঠিয়ে দেওয়া হয়। পুনর্বাসনের ব্যবস্থা সম্বন্ধে কিছু জানা না গেলেও সবাই স্বীকার করেছিল যে পাড়াটা দিনকে দিন ভদ্র হয়ে যাচ্ছে। বেশ কয়েক বছর পরে, যখন অন্য পাড়ার গুন্ডাদের নাম ভুলেই যেতে বসেছি, বুলিকে আবার দেখা গেল এ পাড়ায়। তার নাইলনের শাড়িগুলো বেশ পুরনো হয়ে গেলেও কোলে একটি শিশু। শিশুটি খুবই ছোট - প্রায় সদ্যোজাত। আমাদের বাড়ির একতলার রোয়াকে পা ঝুলিয়ে বসে বুলি সেই শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াত, দোতলার বারান্দা থেকে ঝুঁকেও শিশুটিকে স্পষ্ট দেখা যায় না।
কিছুদিন পরে দেখলাম সে পাকাপাকি ভাবে আমাদের বাড়ির একতলার প্যাসেজে থাকতে শুরু করেছে। মেইন গেট ও ভেতরের দরজার মধ্যবর্তী জায়গায় নিজস্ব জিনিসপত্র রেখেছে, রাতেও ওখানেই ঘুমোচ্ছে, জল বাথরুমের দরকার হলে বাড়ির ভেতরে ঢুকে উঠোনের কলতলা থেকে জল নিচ্ছে, বাথরুম ব্যবহার করছে। কেউ কিছু বলে না, নানান সময়ে অনেক উদ্বাস্তু মানুষ এ বাড়ির রোয়াকে বা প্যাসেজে বসবাস করে গেছে। কিন্তু ও তো এই পাড়ারই মেয়ে, ও বাপের বাড়ি যায় না কেন? যাতায়াতের পথে দেখি সে জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে আছে বা ঠোঙা থেকে খাবার খাচ্ছে, কখনও এমনিই বসে থাকে বাচ্চা কোলে করে, গুনগুন করে গান গেয়ে বাচ্চাকে ঘুম পাড়ায়। মাঝখানে কদিন তাকে দেখলাম না। তার পরে আবার এসেছে। এবার ওকে ওপরে ডেকে এনে কথা বলা হল। বুলি প্রথমেই সংশোধন করে দিল ওর নাম বুলি নয় - বুড়ি। ছোটবেলায় ঠিক মত উচ্চারণ করতে পারত না বলে অমন করে বলত। সে পাখার তলায় পা ছড়িয়ে বসে জল খেল। তিন দিন আগে বাচ্চাটা মরে গেছে। ছেলে হয়েছিল। খুঁক খুঁক করে একটু কেঁদে নেয় সে। বাচ্চার বয়সের হিসেব সে গুছিয়ে দিতে পারছে না, কখনও বলছে চল্লিশদিন, কখনও বলছে কুড়িদিন কি একমাস। হয়ত ভেবেছে আতুরের সময় প্যাসেজে ছিল বলে যদি আমরা রাগ করি। মাথায় রুক্ষ চুলের ফাঁকে সিঁদুর, ও পাড়ার সেই লাল্টির সঙ্গেই থানার বড়বাবু বিয়ে দিয়েছিল। বলে, লাল্টিতো এখানে নেই, মার্ডার কেসে জেল খাটছে তাও তিন বছর হয়ে গেল। সর্বনাশ করেছে, তবে বাচ্চাটা কার? বুলি আবার খুঁকখুঁকিয়ে কাঁদতে শুরু করে দেয় আর কি। শত হলেও গর্ভধারিণী, বুকে এখনও দুধ আছে। ছেলে মরে গেছে, তবু দুধ আসছে, বুক কামড়ায় তার। ওকে পরামর্শ দেওয়া হয়, যে স্বামী জেলে আছে তাকে ডিভোর্স করে দিয়ে ঝাড়া হাত পা হয়ে ভদ্রভাবে নতুন জীবন শুরু করার। বুলি রাজি হয় না, একদিন এই পাড়াতেই তার মায়ের মৃত্যুতে সধবার দল হামলে পড়েছিল সিঁদুর ছোঁয়াতে, সেই মায়ের মেয়ে সে, তার সিঁদুরেরও খুব তেজ, ঐ সিঁদুরই তার স্বামীকে ফাঁসি হওয়া থেকে বাঁচিয়েছে, জেলে থাকলেও বেঁচে তো আছে। ডিভোর্স কি অমনি বললেই হয়? থানার ভেতর বড়বাবু বিয়ে দিয়েছিল না! বাপ-ভায়েরা বস্তিতে ঢুকতে দেয়নি সে ঠিক আছে, পাড়া ছেড়ে এখন যাবেটাই বা কোথায়, এই পাড়া হচ্ছে তার জন্মস্থান।