'নেক্রোফোবিয়া' সম্বন্ধে আমরা কমবেশি সবাই একপ্রকার জানি। Google- এ সার্চ করলে প্রথমেই বেশ সুন্দর একটা কবরস্থানের ছবি চোখে পড়ে। সেটিতেও আমার ভীতু হৃৎপৃণ্ড দুর্ধর্ষ রকমের ভয় পায়। বেশ কয়েকবছর পর্যন্ত আমি কোনো শোকবাড়িতে যেতে পারতাম না। কিছুদিন হলো আবার শুরু করেছি। কেননা, ওই যে, কর্তব্যটুকু আগে, সামাজিকতা আগে।
ঈশ্বরের দয়ায় নেক্রোফোবিয়া-র সঙ্গে সঙ্গে প্যাসমোফোবিয়া, সিনোফোবিয়া ও নাইটোফোবিয়া সবই মোটামুটি পেয়েছি। তবে এই কয়েক মাসে আরো যেটা লক্ষ্য করলাম সেটি হলো, 'টেলিফোবিয়া'। অর্থাৎ, চরমতম প্রয়োজন বোধ না করলে অনন্তকাল পর্যন্ত ফোন বেজে গেলেও আমি তুলি না। তুলবই না। প্রথমত, আমার ফোনে 'kal ho na ho'- র instrumental ringtone টা আমার ভীষন প্রিয়, তাই মন দিয়ে সেটাই শুনি। এছাড়াও আরো একটি মেজর কারণ আছে বটে; ওই যে ফোন তুললেই কথা বলতে হয়, ওইটেই আমার ভীষন রকম ভয়।
শরৎবাবু একবার বলেছিলেন, "মানুষ নিজে কথা না কইলেই পরের কথা তার কানে এসে ঢোকে। সংসারে কম কথার লোকের জন্য ভগবান এই শাস্তির সৃষ্টি করে রেখেছেন।" বড়ো ভালো কথা বলেছিলেন সন্দেহ নেই। মাঝে মাঝে তো মনে হয় আমার জন্যই লিখে গেছেন। কোনো বন্ধু বান্ধবীর সাথে আউটিং হোক বা ফ্যামিলি গেট টুগেদার, সব জায়গায় আমি শুধু নির্বাক শ্রোতা র ভূমিকায় পালন করতাম। জীবনে খুব কম সংখ্যক জায়গা ছিল যেখানে আমি দু-একটি কথা বলতাম বা বলা ভালো ' কথা বলার চেষ্টা করতাম '। আমি যেই না বলতে শুরু করলাম, 'জানিস একবার....' শুধু ভূমিকাটুকুই হয়েছিল, এখনও ব্যাখ্যা, ভাবসম্প্রসারণ,উপসংহার বাকিই ছিল। কিছুক্ষন পর খেয়াল করি আমি বেমালুম আমার কথা থামিয়ে দিয়ে সামনের জনের কথা মন দিয়ে শুনতে শুরু করেছি। তারপর মনে পরে আমার গল্পটিরই অনুরূপ উদাহরণ তার মনে পড়ে যাওয়াই সে তার গল্পটির রসিয়ে মজিয়ে শুরু করেছে আর আমার সাধের গল্পটির ভূমিকাতেই ছেদ পড়েছে।
তবে একটি অলৌকিক ক্ষমতায় বরপ্রাপ্ত আমি। সেটি 'কাঠ মেরে পড়ে থাকার নিঞ্জা টেকনিক'। বাড়িতে কোনো অচেনা, অজানা, দূরসম্পর্কের, কোনোদিন না দেখা 'খুব কাছের আত্মীয়' আবির্ভূত হলে তড়িঘড়ি চাদর মুড়িয়ে চোখ বুঁজে ঘুমিয়ে যাওয়া বা অলমোস্ট মরে যাওয়ার একটি বিশেষ কৌশলে পারদর্শী আমি। আমাদের সোঁদা বাংলায় যাকে বলে 'কাঠ মেরে পড়ে থাকা'। নিঃসন্দেহে আপনার ঘুম ভাঙ্গবে আত্মীয়রা চলে যাওয়ার পরই। পাঠকগণ চেষ্টা করে দেখতে পারেন। কিছু পিলে চমকানো বাজখাঁই গলা আর কিছু অপ্রত্যাশিত ইন্টারভিউয়ের হাত থেকে রেহাই পাবেন।
তবে হয়তো না করাই ভালো। জিনিসটা ভালো দেখায় না। তাছাড়া মা র হাতের মারও পড়ে খুব।
আমায় নিয়ে মা-ও আজকাল বড়ো চিন্তিত থাকে। আমার সমস্ত কাজকর্মকেই মা একপ্রকার সাইকোলজিক্যাল ডিসঅর্ডার - এর রূপ দিয়ে দেয়, যেটি মা-র সবথেকে বড় ডিসঅর্ডার। তার একমাত্র কারণ 'introvert' বা 'অর্ন্তরমুখিতা' শব্দটিকে মা মানতেই চাইনা।
আমি ছোটবেলা থেকেই ভীতু, অলস, অসুস্থ এবং শারীরিক গড়ন কিছুটা 'পাগলা দাশু'-র মত। ছোটবেলায় স্কুলজীবনটার বেশিরভাগটাই কেটেছে আমার inferiority complex আর identity crisis এর সঙ্গে । ফলত সবাইকে দূর থেকেই অনুধাবন ও পর্যবেক্ষণ করাই ছিল আমার ভালোবাসার বিষয়। স্কুলজীবনে আমার নাম কেও জানুক আর নাই জানুক আমার কাছে সবার নাম, পছন্দের বিষয় ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য মনোযোগ সহকারে নিরীক্ষণ করাই ছিলো আমার স্কুলে পাঁচ ঘণ্টা কাটানোর পক্রিয়া। এখনও মাঝে মাঝে নিজেকে 'the girl on the train' এর আংশিক 'রেচল' এর মতই লাগে।
আমি কোনো সাইকোলজিক্যাল ডিসঅর্ডারে ভুগি কিনা জানি না। একা ভালই লাগে, একাকী লাগে না। জানি সবার কিছু না কিছু কমফোর্ট জোন থাকে। আমার ভালো লাগে ভিড়ের মধ্যে থেকে একটু সরে গিয়ে এককোনে নিরালায় ভীড় পরিদর্শন করতে। হয়তোবা ভালো লাগে বন্ধু বান্ধবীর ছোট্ট পরিধিতে এককোনে মিশে থাকতে, নির্বাক শ্রোতা হয়ে তাদের অনুসরণ করতে। আবার কখনো প্রবহমান ভিড়ের মধ্যে নিঃশব্দে পাশে বসে থাকা ছেলেটির বা মেয়েটির ফোনালাপ শুনতে।
সবাই জানে ঘরের কোণ আমার খুব প্রিয়। যেখানেই যায় একটু পর চেয়ার হিঁচড়ে একটু কোনার দিকে নিয়ে যাবোই। কিন্তু আমার গুটিকতক আদুরে বন্ধু বান্ধবীরা তাও ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান করলে whatsapp গ্রুপে আমার নামটা ঠিক অ্যাড করেই দেয়। যতোই তারা নিজেদের গল্পে মত্ত থাক, আমি এলে তারা খুশিই হয়। আমি বললে তারা শোনে না বা বলা ভালো আমার গলার স্বরটি আস্তে বলে শুনতে পাই না। কিন্তু আমি লিখলে তারা মন দিয়েই পড়ে।
কারণ আমরা অসুস্থ নই, আমরা শুধু অন্তর্মুখী। আমাদের রং মিশতে সময় লাগে ঠিকই। কিন্তু অসমসত্ত্ব দ্রবণ বলে আমাদের নিংড়ে বার করে দেবেন না।
ভিড়ের মধ্যে Identity crysis এ এখন আর ভুগি না। আমার নিঞ্জা টেকনিকটিও বদলাচ্ছি ধীরে ধীরে। আজকাল কমবেশি ফোনটাও ধরার চেষ্টা করছি। আর ফোবিয়ার থেকে বড়ো, প্রিয়জনের প্রয়োজনে আমাদের উপস্থিতি। আমরা পাশে থাকি, থাকব ও। কেননা আমরা ভীতু, আমরা অন্তর্মুখী, অসামাজিক নয়।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।