বীরসিংহের সিংহপুরুষ জন্মেছিলেন "এঁড়ে বাছুর" পরিচয়ে। জন্মলগ্নে পিতামহ রামজয় তর্কভুষণ কর্তৃক প্রদত্ত এমন বদ-খেতাব যতই হাস্যোচ্ছলের হোক, বিদ্যাসাগর পিতামহের সে আখ্যার বরখেলাপ করেননি কখনও। এঁড়ে বাছুরের জিদ আর একগুঁয়েমি তাঁর মধ্যে ছিল। "বাঙালির বিষ সাপের বিষ না" এবং ওঝার আজ্ঞা যে ম্যাজিস্ট্রেটের আজ্ঞা নয় যে হুকুম মাত্র নেমে যাবে বলে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যে কটাক্ষ করেছেন তাঁর প্রতিবাদ বুঝি বিদ্যাসাগরের ব্যক্তিত্ব দিয়ে করা যায়। সেজন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, বিশ্বকর্মা চার কোটি বাঙালি তৈরি করতে করতে মাঝে মাঝে দুই একজন মানুষ তৈরি করে ফেলেছেন। বিদ্যাসাগরই তার একজন। কেননা, তিনি বেসিক পার্সোনালিটি নিয়ে জন্মাননি। মনোবিজ্ঞানীদের ধারণা সমাজের মানুষ সমাজের সবকিছু মেনে নিতে শেখে। এটা বেসিক পার্সোনালিটি। মনোবিজ্ঞানীরা এটাকে এভারেজ পার্সোনালিটি বলেছেন। বিদ্যাসাগর এই এভারেজ পার্সোনালিটির ঊর্ধ্বে ছিলেন। তাঁকে ব্যাখ্যা করা যায় সমাজবিজ্ঞানী রালফ লিনটনের ভাষায়। রালফ লিনটন বলেছেন, যখন মানুষ সমাজের আর সবার মতো করেই কথা বলে তখন তাঁকে আলাদা করে চিহ্নিত করা যায় না। তখন সে একটা ইউনিট হিসেবে কথা বলে। সেই মানুষই আলাদা যার স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব আছে। তিনিই সেই "দি অথেন্টিক ইন্ডিভিজুয়াল"।
বিদ্যাসাগরই ঊনবিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ অথেন্টিক ইন্ডিভিজুয়াল। ইয়াং বেঙ্গল গ্রুপ যখন প্রগতির নামে প্রথা ভাঙছে কিন্তু একই সাথে ইংরেজদের প্রতি অন্ধ আনুগত্যে ভরপুর, ঠিক সে সময়েই দৈহিক কাঠামোর চেয়ে মাথা কিঞ্চিৎ মোটা অপুষ্ট বাঙালি লোকটি বেছে নিয়েছেন সমাজ সংস্কারের পথ। ব্রিটিশরাজ কর্তৃক তিনি বিধবা বিবাহের আইন পাস করিয়ে নিয়েছেন ঠিকই। কিন্তু ব্রিটিশদের অন্যায়কে মেনে নেননি। সেজন্য দেখা যায় হিন্দু কলেজের প্রিন্সিপাল কার সাহেবের সাথে দেখা করতে গেলে কার সাহেব টেবিলের ওপর পা তুলেই বিদ্যাসাগরের সাথে কথা বলেন। সুযোগ পেয়ে বিদ্যাসাগর একই কাজ কার সাহেবের সাথে করলে চারিদিকে বিতর্ক শুরু হয়। বিদ্যাসাগর পরবর্তীতে বলেন, টেবিলের ওপর পা তুলে সম্বোধনের সংস্কৃতি আপনাদের কাছে থেকেই শেখা।
বিদ্যাসাগরের "তালতলার জুতা" কাহিনীটাও বিখ্যাত। এশিয়াটিক সোসাইটিতে বিদ্যসাগরকে নেটিভ জুতা পরে যাওয়ার কারণে খুলে ঢুকতে বা হাতে করে নিয়ে ঢুকতে বলা হলে তিনি এশিয়াটিক সোসাইটির ভিতরে না ঢুকে বের হয়ে আসেন। পরে ইংলিশ ম্যান পত্রিকায় লেখেন। বিদ্যাসাগরের এই ঘটনা গ্রেট শু ঘটনা বা বাংলায় তালতলার চটি ঘটনা নামে পরিচিত।
"এই দুর্বল ক্ষুদ্র হৃদয়হীন কর্মহীন দাম্ভিক তার্কিক জাতির প্রতি বিদ্যাসাগরের এক সুগভীর ধিক্কার ছিল। কারণ তিনি সর্ববিষয়ে এর বিপরীত ছিলেন", রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন। আর তাই তিনি বিদ্যসাগরকে দেখেছেন কাকের বাসায় কোকিলের ডিম পাড়ার মতো করে। কাকের বাসায় কোকিল যেমন ডিম পাড়ে বিধাতা তেমনি কৌশলে বিদ্যাসাগরকে দিয়ে বাঙালিকে মানুষ করার চেষ্টা করেছে। তবুও, বাঙালিকে মানুষ করা সহজ নয়। এবং এজন্য দেখা যায় শিক্ষিত অশিক্ষিত সবার কাছে থেকে তুমুল অসহযোগিতা। বিদ্যাসাগরের নীতি ছিল তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে।
বিদ্যাসাগরই ঊনবিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ বাঙালি হিউম্যানিস্ট। তিনিই প্রথম নারীবাদী এবং মুক্তমনা। সংস্কারের ধার ধারতেন না। ছিলেন ঈশ্বর ও পরকালে অবিশ্বাসী। পরকাল নিয়ে হাসি তামাশা করতেন প্রায়ই। আর ছিলেন অসামান্য যুক্তিবাদী। তাঁর যুক্তির কাছে হার মেনেছে বারাণসী সংস্কৃত কলেজের প্রিন্সিপাল ব্যালেন্টাইন সাহেব। শিক্ষা কাউন্সিলর ময়েট সাহেব মেনে নিয়েছেন এই একগুঁয়ে লোকটার কথা। সমাজ থেকে অন্ধকার কুসংস্কার দূর করতে তিনিই প্রথম উপলব্ধি করেছেন শিক্ষার গুরুত্ব। তাই শিক্ষাবিস্তারে মেনে নিয়েছেন পাথর বিছানো বন্ধুর পথ। নারীশিক্ষা আর মাতৃভাষায় শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষাকে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে তাঁর নিঃস্বার্থ অবদান অনস্বীকার্য।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ বাঙালি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর যাঁকে বিনয় ঘোষ দেবতা না, যথার্থ মানুষ, হিউম্যানিস্ট বলে আখ্যা দিয়েছেন তিনি ছিলেন তাঁর সমকালে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবীদের একজন। এই মহান ব্যক্তিটির জন্ম ২৬ সেপ্টেম্বর, ১৮২০ সাল। জন্মদিনে তাঁর প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা।
আহমদ শরীফ যথার্থই বলেছেন, "সেই যে বাংলা গদ্যরীতির "জনক" বলে তাঁর এক খ্যাতি আছে সেই জনকত্বই তাঁর স্থিতি। তিনি নতুন চেতনার জনক, সংস্কারমুক্তির জনক, জীবন-জিজ্ঞাসার জনক, বিদ্রোহের জনক, শিক্ষা-সংস্কারের জনক, সংগ্রামের জনক, ত্যাগ তিতিক্ষার জনক। জনকত্বই তাঁর কৃতি আর কীর্তি। সমকালীন বাংলার সব নতুনেরই জনক ছিলেন। তিনিই ছিলেন "ঈশ্বর"। আর বদরুদ্দিন ওমর আক্ষেপ করে বলেছেন, বাঙালি মুসলমান সমাজে বিদ্যাসাগরের মতো এমন একজন সমাজ-সংস্কারক আসেননি। এই দুঃখ আহমদ শরীফেরও ছিল।
বিদ্যাসাগর সবচেয়ে বেশি আধুনিক ছিলেন তাঁর শিক্ষাচিন্তায়। তাঁর শিক্ষাচিন্তা দুইশ বছর পরে এসেও যে কতটা প্রাসঙ্গিক তা কল্পনাই করা যায় না। সময় পেলে একদিন তাঁর শিক্ষাচিন্তা নিয়ে পোস্ট করব।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।