২৬শে সেপ্টেম্বর। দিনটা শিক্ষক দিবস নয়। বিদ্যাসাগরের জন্মদিন। সেই উপলক্ষে এই দিনটা কোন দিবস হিসাবে মর্যাদা পায়নি আজও!
সেই সময় শুধুমাত্র ব্রাহ্মণ বৈদ্যরাই সংস্কৃত কলেজে পড়ার সুযোগ পেতেন। সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ পদে দায়িত্ব নেওয়ার পর বিদ্যাসাগর অনেক গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার সাধন করেছিলেন। তিনি সেকেলে রীতিনীতি পাল্টে দিয়ে নতুন রীতিনীতির সূচনা করেছিলেন। সর্বসাধারণের জন্য সংস্কৃত কলেজে অধ্যয়নের সুযোগ তিনিই করে দেন।
ইতিহাসের পাতা যতই অদলবদল হোক না কেন আজ পর্যন্ত কোনো সন্ন্যাসী শুধু বাংলার কেন সমগ্র ভারতবর্ষ উপমহাদেশ বা সমগ্র পৃথিবীর কোত্থাও কোনো নবজাগরণের ছিটেফোঁটাও আনতে পারেননি। যে ঈশ্বর এনেছিলেন তাঁর পুজো আমরা করি না। আমরা অলৌকিকের পিছনে দৌড়ে নিজেকে বাস্তববাদী প্রমান করার চালাকি করি।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর “বিদ্যাসাগরচরিত”- এ বলেছিলেন— “বাংলাভাষার বিকাশে বিদ্যাসাগরের প্রভাব কিরূপ কার্য করিয়াছে এখানে তাহা স্পষ্ট করিয়া নির্দেশ করা আবশ্যক। বিদ্যাসাগর বাংলাভাষার প্রথম যথার্থ শিল্পী ছিলেন।” বাঙালি হয়ে বাংলা পড়তে না পারাটা যে চরম অশিক্ষা, সেটাই আজেকে পশ্চিমবঙ্গের অনেক শিক্ষিত বাঙালি জানেন না! এখন বেসরকারী স্কুল, ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াশোনার হার বাড়ছে। ফলে সরকারী বাংলা স্কুলগুলো বন্ধ হতে চলেছে। বিদ্যাসাগরের “বর্ণপরিচয়” আর রবীন্দ্রনাথের “সহজ পাঠ” না পড়ে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াশোনা শেষ করে সময়ের সুযোগে সরকারী স্কুলে চাকরীর দাবি করেন।
বিদ্যাসাগর বাঙালির জন্য সারা জীবন লড়াই করেছেন, কাজ করেছেন। আবার বাঙালির কাছেই প্রতি নিয়ত অসম্মানিত ও অপমানিত হয়েছেন। তাঁর প্রচেষ্টায় বিধবা বিবাহ আইন পাস করতেই বিভিন্ন খবরের কাগজে প্রশংসার সঙ্গে অনেক খবরের কাগজেই ভীষণ রকম নিন্দার ঝড় উঠেছিল। তাঁর পক্ষে এবং বিপক্ষে নানা রকম তর্জা গান বাঁধা হয়েছিল। এবং তাঁকে হত্যার সরযন্ত্রও হয়েছিল। তিনি ভয় পাননি। অত্যন্ত ঘৃণায় জীবনের শেষ প্রায় চব্বিশ বছর কোনো হিন্দু ব্রাহ্মণ বাঙালির মুখদর্শন করেননি। সেই সময় তিনি থাকতেন আদিবাসি জেলেদের সঙ্গে। মাছ ধরা ও মাছ বিক্রি করায় সাহায্য করতেন তাঁদের। অহঙ্কার শব্দটা তাঁর অভিধানে ছিল না কখনোই। এই পণ্ডিত মানুষটি অতি সাধারণ দরিদ্রদের সঙ্গেই অনায়াসে থাকতে ভালোবাসতেন।
একবার ভাবুন তো মেয়েদের পড়াশোনার কথা কেউ ভাবতেই পারতেন না। সে সময় লেখাপড়া শুধুমাত্র ছেলেদের জন্য। ভাবতে পারছেন সময়টা? যে সময়ে বিবেকানন্দের মত সন্ন্যাসী, বীর যুবকগনের জন্য প্রচার করছেন,— “কার্যসিদ্ধর জন্য আমার ছেলেদের আগুনে ঝাঁপ দিতে প্রস্তুত থাকতে হবে”। আর মেয়েদের জন্য বলছেন,— “হে ভারত, ভুলিও না—তোমার নারীজাতির আদর্শ সীতা, সাবিত্রী, দময়ন্তী; ভুলিও না তোমার বিবাহ, তোমার ধন, তোমার জীবন ইন্দ্রিয়সুখের, নিজের ব্যক্তিগত সুখের জন্য নহে”। সেই সময়ে দাঁড়িয়ে একমাত্র বিদ্যাসাগর ভাবতে পেরেছিলেন মেয়েদের শিক্ষার কথা। সমস্ত বিপর্যয় কাটিয়ে একমাত্র বিদ্যাসাগরের চেষ্টায় মেয়েরা আজও পড়াশোনা করার সুযোগ পেয়েছেন।
বাংলার মেয়েদের, উপোস করে শিবের ব্রত পালন করার চেয়ে বিদ্যাসাগরকে সম্মান জ্ঞাপন করে তাঁর সমাজ সংস্কারে নিজেকে পুনঃজাগরন করাটা সত্যিকারের ঈশ্বর লাভের ক্ষেত্রে ঢের বেশি প্রয়োজন। তাতে বরং বিদ্যাসাগরের আনা আধুনিক নবজাগরণের আলোকে বাস্তব শিক্ষার প্রসার ঘটবে। কারণ এখনো বেশিরভাগ মেয়েরা লেখাপড়া করে শ্বশুরবাড়িতে খুন্তি ধরেন আর স্বামীর মঙ্গলকামনায় উপবাস করেন। আজকাল ছেলেরাও কেউ শেখার জন্য ভালোবেসে আনন্দ নিয়ে পড়াশোনা করেন না। সবাই কোনো একটা মোহে পড়াশোনা করেন। বোধহয় ট্যাঁকশালার মতো কোন একটা যন্ত্রের জন্য। এখন অবিভাবকরাও সন্তানদের সেইভাবেই তৈরি করেন। কোথায় যেন পড়েছিলাম— “বাঙালির রবিপক্ষ আছে, দেবিপক্ষ আছে কিন্তু ঈশ্বরপক্ষ নেই”। তার দরকার থাক বা না থাক, যেটা দরকার তা হল, তাঁর তৈরি সমাজের অত্যন্ত আধুনিক সংস্করণ গুলো যুক্তির সঙ্গে মন থেকে মেনে নিয়ে কাজের মাধ্যমে এগিয়ে নিয়ে চলা। তবে রবীন্দ্রনাথের গানকে যেমন ‘রবীন্দ্রসংগীত’-এ বা নজরুলকে যেমন ‘বিদ্রোহী কবি’তে বন্দী করে ফেলা হয়েছে। ভাগ্যিস বিদ্যাসাগরের ক্ষেত্রে তেমনটা হয়নি! সেক্ষেত্রে ইনি মুক্তিই পেয়েছেন।
—সুবিমল
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।