বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে রাধাকৃষ্ণ সর্বাধিক পূজনীয়। বৈষ্ণবধর্ম তো রাধাকেন্দ্রিক। আবার সাহিত্যাঙ্গনেও রাধাকৃষ্ণ দখল করে আছে বিস্তর জায়গা। সেই রাধার পরিচয় উদঘাটন করার জন্য এই পোস্টটি।
রাধার শাস্ত্রীয় পরিচয়ের পূর্বে কৃষ্ণের শাস্ত্রীয় পরিচয় কিছুটা জেনে নেয়ার প্রয়োজন আছে।
ঋগ্বেদের কয়েক জায়গায় কৃষ্ণের উল্লেখ পাওয়া যায় কিন্তু তাঁরা দেবকীনন্দন বা মহাভারতের বা বর্তমানে যাঁর পূজা করা হয় সে কৃষ্ণ নন। তবে, অথর্ববেদে কৃষ্ণের উল্লেখ পাওয়া যায়। বেদ আরও বেশি অধ্যয়ন করলে কৃষ্ণ নাম পাওয়া না গেলেও কৃষ্ণের বৈশিষ্ট্যধারণকারী বেশ কিছু নামের উল্লেখ আছে। তবে, সেই বৃহৎ শাস্ত্র থেকে খুঁজে বের করে আনা একটু কঠিন। কৃষ্ণের পরিচয় সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় ১) পুরাণে ২) হরিবংশে ৩) মহাভারতে। আঠারো খণ্ড পুরাণের সর্বত্র আবার কৃষ্ণের উপস্থিতি নেই। বিষ্ণুপুরাণ এবং ভাগবতপুরাণে অধিক উপস্থিতি লক্ষ করা যায়।
অথর্ববেদের উপনিষদে কৃষ্ণের উল্লেখ আছে। এবং তিনি দেবকীনন্দন কৃষ্ণ-ই। এই উপনিষদে কৃষ্ণের একজন প্রধান গোপীর কথা বলা আছে। তাঁর নাম গান্ধর্বী। তবে ইনি কৃষ্ণের প্রেমিকা নন। ইনি কৃষ্ণের কাছে তত্ত্বজিজ্ঞাসু একজন ভক্ত।
রাধার পরিচয় হিন্দুশাস্ত্রের ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ এবং জয়দেবের গীতগোবিন্দ ছাড়া আর অন্য কোথাও নেই। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে মনসাদেবী, ষষ্টিপূজা প্রভৃতিরও উল্লেখ আছে। তাই ধারণা করা হয় ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ তুলনামূলক আধুনিক পুরাণ।
ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ অনুসারে কৃষ্ণের যে পরিচয় তা ভাগবতপুরাণ, বিষ্ণুপুরাণ, মহাভারত এবং হরিবংশের অর্থের অনুগামী নয়। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ অনুসারে কৃষ্ণ বিষ্ণুর অবতার নন। বরং কৃষ্ণই বিষ্ণুসহ অন্যান্য দেবদেবী এবং জগতের স্রষ্টা। বিষ্ণু থাকেন বৈকুণ্ঠধামে কিন্তু কৃষ্ণের অবস্থান তার চেয়ে উপরে গোলকধামে। গোলকে গো, গোপ এবং গোপীদের বাসস্থান। এই গোলকধামের অধিষ্ঠাত্রী দেবী রাধা। গোলকে রাধার প্রতিযোগিনী ছিলেন বিরজা। কৃষ্ণ বিরজার গৃহে গেলে রাধা অতিশয় ক্রুদ্ধ হয়ে রথারোহনে সেখানে পৌঁছে বিরজার গৃহে প্রবেশোদ্যত হলে দ্বাররক্ষী শ্রীদাম বাধা দেন। রাধা তখন তাঁকে অভিশাপ করেন যে সে মর্ত্যে অসুর হয়ে জন্মগ্রহণ করো। শ্রীদামও রাধাকে মর্ত্যে জন্ম নিয়ে অসতী হওয়ার শাপ দেন। এই কথা শুনে কৃষ্ণও পৃথিবীতে অবতীর্ণ হওয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন। আর বিরজার গর্ভে কৃষ্ণ ঔরসে সাতটি পুত্রসন্তান হয়। তারা বিরজার অভিশাপেই পৃথিবীতে সাতসমুদ্র হয়ে জন্মগ্রহণ করে।
পরবর্তীতে কৃষ্ণ এবং রাধার পৃথিবীতে জন্ম হয়। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ অনুসারে কৃষ্ণ এবং রাধার ব্রহ্মার উপস্থিতিতে বিয়ে হওয়ার কথা উল্লেখ আছে। অর্থাৎ সেটা পরকীয়ার কাহিনী নয়। আরেকটা তথ্য হলো গোলকধামে শাপপ্রাপ্ত হয়ে রাধা পৃথিবীতে আগেই জন্মগ্রহণ করেন। সে হিসেবে কৃষ্ণের চেয়ে রাধা বয়সে বড়ো। কৃষ্ণ যখন নন্দের কোলে শিশু রাধা তখন যৌবনা।
যাইহোক, এই কাহিনী ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ এবং জয়দেবের গীতগোবিন্দ ছাড়া আর অন্য কোথাও উল্লেখ নেই। এখন কথা হলো আদি শাস্ত্রগুলোতে অনুপস্থিত থাকার পরেও ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে রাধা কেমনে আসলো। এই প্রশ্নের উত্তরের আগে ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের আদি সংস্করণে রাধাকে কী হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে তা দেখার দরকার আছে। আরাধিকা > রাধিকা > রাধা এইভাবে বিবর্তিত হয়ে রাধা হয়েছে। এই আরাধিকা কৃষ্ণের আরাধিকা বা যিনি কৃষ্ণের আরাধনা করেন এমন কাওকে বোঝানো হয়। কিন্তু আদিম সেই ব্যুৎপত্তিগত অর্থ বৈষ্ণবগণের কাছে বিশ্রুত হয়েছে। তার পরিবর্তে আধুনিক রাধা-কৃষ্ণের আধিপত্য শুরু হয়েছে।
প্রাচীন ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে উল্লেখিত আরাধিকার বিলুপ্তি এবং আদি শাস্ত্রে রাধার অনুপস্থিতির পরেও আধুনিক ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে রাধার উপস্থিতির সাথে একটা যোগ আছে। যোগটা হলো দার্শনিক যোগ।
ভারতবর্ষে যে দর্শনশাস্ত্রগুলোর উৎপত্তি হয়েছে তন্মধ্যে ছয়টি দর্শনের প্রাধান্য স্বীকৃত হয়। এই ছয় দর্শনশাস্ত্রের মধ্যে বেদান্তদর্শন এবং সাংখ্যদর্শন অধিক প্রভাবশালী। বেদান্তের দর্শন অদ্বৈতবাদ। অদ্বৈতবাদ হলো ঈশ্বর ভিন্ন কিছু নাই। জগৎ ও জীবগণ ঈশ্বরেরই অংশ। তিনি এক ছিলেন; সিসৃক্ষাপ্রযুক্ত (সৃজন করার ইচ্ছা) হয়ে বহু হয়েছেন। তিনি পরমাত্মা। জীবাত্মা তারই অংশ। ঈশ্বরের মায়া থেকেই জীবাত্মা প্রাপ্ত । আবার মায়া কেটে গেলে ঈশ্বরে বিলীন হয়।
অদ্বৈতবাদের অনেকগুলো ধারার মধ্যে প্রধান দুটি ধারা হলো: ১) ঈশ্বর ভিন্ন আর কিছুই নাই। ঈশ্বরই জগৎ; তা ভিন্ন জাগতিক কোনো পদার্থ নাই। ২) ঈশ্বরই জগৎ বা জগতই ঈশ্বর নন। বরং ঈশ্বরে জগৎ আছে। ঈশ্বর জগতের সর্বপদার্থে আছেন কিন্তু তিনি এসব পদার্থের উপরে। অর্থাৎ নিয়ন্তা। বৈষ্ণবধর্ম এই দ্বিতীয় মতের উপর প্রতিষ্ঠিত।
দ্বিতীয় প্রধান দর্শনশাস্ত্র হলো সাংখ্যদর্শন। কপিলের সাংখ্য ঈশ্বরকে স্বীকার করে না কিন্তু পরবর্তী সাংখ্য ঈশ্বরকে স্বীকার করে নিয়েছেন। সাংখ্যদর্শনানুযায়ী পরমাত্মা বা পুরুষ জড়জগৎ বা জড়জগন্ময়ী থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এই জড়জগৎ বা জড়জগন্ময়ীকে সাংখ্যগণ "প্রকৃতি" বলেছেন। সাংখ্যগণ প্রকৃতিকেই মনে করেন সর্বসৃষ্টিকারিণী, সর্বসঞ্চারকারিণী, সর্বসঞ্চালিনী এবং সর্বসংহারকারিণী। প্রকৃতিই সবকিছু করেন। পরমাত্মা বা ঈশ্বর কিছু করেন না। তিনি সম্পূর্ণরূপে পৃথক এবং সঙ্গশূন্য। সাংখ্যদের এই প্রকৃতি-পুরুষ থেকে প্রকৃতিপ্রধান তান্ত্রিকধর্মের উৎপত্তি। এই তান্ত্রিকধর্ম ধারণা করা হয় সেকালে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।
এবং সে কারণেই প্রকৃতিকে রাধা এবং পরমাত্মাকে কৃষ্ণ কল্পনা করে ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ রচিত হতে পারে। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে কৃষ্ণ রাধাকে উদ্দেশ করে এক জায়গায় বলেছেন, রাধা, তুমি না থাকলে আমি কৃষ্ণ; এবং তুমি থাকলে আমি শ্রীকৃষ্ণ। এই "শ্রী" শব্দটা বিষ্ণুপুরাণেও পাওয়া যায়। এবং বিষ্ণুপুরাণে শ্রী'র যে বৈশিষ্ট্য বলা হয়েছে ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণেও রাধার সেই একই বৈশিষ্ট্য বলা হয়েছে। তাই শ্রীকৃষ্ণ মানে হলো রাধাকৃষ্ণ। বা এভাবেও বলা যায় শ্রীর মধ্যে কৃষ্ণের প্রকাশ। বা প্রকৃতির মধ্যে পুরুষের প্রকাশ।
পরিশেষে বলা যায় রাধা হিন্দু শাস্ত্র প্রভৃতিতে অনুপস্থিত। কিন্তু বেদান্তের মায়াবাদ যা সাংখ্যের প্রকৃতিবাদ এবং পরবর্তীতে শক্তিবাদের জনপ্রিয়তার কারণে ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে রাধাকে সৃষ্টি করা হয়েছে। রাধা সাংখ্যের প্রকৃতির প্রতীক এবং কৃষ্ণ পরমাত্মা বা পুরুষের প্রতীক। সাংখ্যের প্রকৃতি-পুরুষের এবং বেদান্তের জীবাত্মা-পরমাত্মার মিলনাভিপ্রায় বা মিলনেচ্ছার কারণে ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে রাধার অবতারণা করা হয়েছে যা বৈষ্ণবগণের মধ্যে অধিক জনপ্রিয়। এবং হয়তো পরবর্তীতে বৈষ্ণবধর্মের কারণেই রাধা-কৃষ্ণ সাহিত্যের মধ্যে ঢুকে পড়ে ধর্ম সাহিত্য সবকিছুকে একাকার করে ফেলে।
উপরের আলোচনা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের "কৃষ্ণচরিত্র" এর দ্বিতীয় খণ্ডের আলোকে করা হয়েছে।
আমার কথা:
হিন্দুধর্মে বা বৈষ্ণবধর্মে বা কৃষ্ণের জীবনে রাধা যখনই প্রবেশ করুক কিংবা তাঁর শাস্ত্রীয় ও পৌরাণিক পরিচয় যাই হোক বাংলাসাহিত্য, ভারতীয় দর্শন এবং বাংলার মানুষের কাছে তিনি সত্যের চেয়ে অধিক সত্য। ধর্ম না হোক রাধাকৃষ্ণের নামে যে প্রেমকাহিনী প্রচলিত আছে তাই বা কম কিসের। এবং এ প্রেম মানবিক প্রেম তাই শাস্ত্রে নেই বলে বা ধর্মবিশুদ্ধকরণের নাম করে রাধাকে কোনোভাবে বাদ দেয়া যাবে না, সম্ভবও না এবং সেটা করা অনুচিত।
এই হানাহানি হিংসা ঘৃণা আর বিদ্বেষের পারমাণবিক পৃথিবীতে জয় হোক মানবিক প্রেমের।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।