স্বাধীনতা দিবস বলে খুব তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠতে হবে, এ সব কথা নৈমিত্তিক জীবনে এখন অর্থহীন। প্রাইমারি স্কুলে পড়ার সময় এই দিনটির অর্থ ছিল। বাবা সকাল সকাল ঘুম থেকে তুলে স্নান করিয়ে ভাল জামা পরিয়ে স্কুলে পাঠাতেন। ভাল মনে আছে, অন্য দিন ছেঁড়া হাই চপ্পল পরলেও এই একটা দিন কালো বুট পরে স্কুলে যেতাম। তার আগে বাবা সন্দুর করে পালিশ করে রাখতেন জুতো জোড়াখানা।
একবার স্বাধীনতা দিবসের দু’দিন আগে স্কুলের বড়দিভাই ডেকে বললেন, ‘শোন তোকে একটি কবিতা পাঠ করতে হবে। যা মেয়েদের স্কুলে গিয়ে ক্লাস ফাইভের বাংলা বইটা নিয়ে আয়।’ পড়তাম প্রাইমারি স্কুলে। আর মেয়েদের হাইস্কুলে যেতে হবে শুনে বুকটা ধড়াস করে উঠল। পাশেই বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়। গিয়ে সেই স্কুলের হেড দিদিমণিকে বললাম। তাৎক্ষণাৎ উনি একটা বাংলা বই দিলেন। তা নিয়ে বড়দিভাইয়ের হাতে দিলাম। উনি দু’একটা পাতা নাড়াচাড়া করে বললেন, ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’ কবিতাটা পাঠ করবি। আমার উপর পুরোপুরি ভরসা হয়নি তাঁর। তাই ক্লাসের ফার্স্ট বয়কে ডেকেও ওই কবিতাটি পাঠ করার কথা বলেন।
স্কুলে বসেই দু’দিন ধরে রিহার্সাল দিলাম। মাঝে মাঝে গিয়ে বড়দিভাইয়ের কাছে শুনিয়ে আসতাম। ‘কাণ্ডারী! তব সম্মুখে ওই পলাশীর প্রান্তর/ বাঙ্গালীর খুনে লাল হল যেথা ক্লাইভের খঞ্জর’ এই লাইনটা কোনও মতে রপ্ত করতে পারছিলাম না। বড়দিভাইয়ের সামনে বারবার হোঁচট খাচ্ছিলাম, আর ততবারই তিরষ্কৃতও হচ্ছিলাম। ক্লাসের ফার্স্ট বয় দিব্যি গড়গড় করে বলে দিচ্ছিল। স্বাধীনতা দিবসের দিন সকাল সকাল সাজিয়ে গুছিয়ে বাবা স্কুলে পাঠিয়ে দেয়। হাতে একটা কাগজ আর এক বুক টেনশন নিয়ে সব ক্লাসের সামনে কবিতাটি পাঠ করেছিলাম। সে দিন হোঁচট খেয়েছিলাম কিনা মনে নেই। তবে বড়দিভাই কোনও বকা দেননি। আজ কারণটা বুঝতে পারি, ক্লাসের ফার্স্ট বয় সে দিন আসেনি।
স্বাধীনতা দিবসে আমাকে নিয়ে আমার বাবার যতটা তৎপরতা ছিল, বাবা হয়ে বুঝলাম ছিটেফোঁটা তা আমার গায়ে লেপটে নেই। তবুও আগের দিন ঠিক করে রেখেছিলাম, একটা তেরঙ্গা পতাকা মেয়েকে কিনে দেব আর একটা নতুন শব্দ শেখাব। আর নিউটাউনে থাকার সুবাদে এই কৌতূহলও ছিল এখানকার আকাশচুম্বী বিল্ডিংয়ের বাসিন্দারা কেমন করে স্বাধীনতা উদযাপন করে তা দেখার। সকাল সকাল হাতে থলি নিয়ে বাজারে বেরিয়ে পড়ি।
ভীষণ কর্পোরেট। সব কিছু মাপা। ফুটপাথ দিয়ে এক একটা আবাসন পেরোচ্ছি, যেন ক্যামেরার রিলের মতো দৃশ্যপট গুলো পাল্টে যাচ্ছে। এক আবাসনের সামনে দাঁড়িয়ে দেখলাম, সারি সারি চেয়ারে পক্ককেশীরা বসে। আর তাদের সামনে পরিপাটি শাড়ি পরা কিছু মহিলা জটলা করে দাঁড়িয়ে। একজন মাইক হাতে নিয়ে বলছেন, সত্যি করে স্বাধীনতা কী হওয়া উচিত? অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর না করলে এই স্বাধীনতা কখনওই সার্থক হবে না...। আরও অনেক কিছু বলতে লাগলেন। আমার শুধু চোখ পড়ল লাইন দিয়ে সাজানো লাল নীল চার চাকা গাড়িগুলির দিকে।
পাশের আবাসনে দেখলাম, কেউ একজন খালি গলায় দেশাত্ববোধক গান গাইছেন। সবাই বসে তারিয়ে তারিয়ে তা উপভোগ করছেন। চা বিস্কুটের ট্রে নিয়ে এ দুয়ার ও দুয়ারে পাক মারছে কেয়ারটেকার। সত্যিই আর কী বা করার আছে আমাদের। বাড়িতে গিয়ে একটা কেক আর তেরঙ্গা মেয়ের হাতে তুলে দিলাম। ভীষণ খুশি। তেরঙ্গার কোন রঙের কী নাম সে শিখেছে। যেটা শেখেনি, তা হল তেরঙ্গার মাঝে অশোক চক্র। তাকে বললাম, বলো তো এটা কী? সব রঙের নাম বললেও এটা একেবারে আউট অব সিলেবাস। বললাম, “অশোক চক্র”। মানে বোঝাতে গিয়েছিলাম। বাধ সাধল মন। থাক, ওটা আমার জন্যই তোলা...