একটি ঘটনার উল্লেখ করে লেখাটি শুরু করি
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তখন ৫০ টাকা বেতনে চাকরি করছেন, সে সময় সংস্কৃত কলেজে ব্যাকরণের অধ্যাপক পদ খালি হল। সে পদের বেতন ছিল ৯০ টাকা। সংস্কৃত কলেজ কতৃপক্ষ ঈশ্বরচন্দ্রকে অনুরোধ করল সেই পদটি নেওয়ার জন্য। বলাবাহুল্য বিদ্যাসাগর সেই সময়ে সেই পদে উপযুক্ত মানুষ ছিলেন। কিন্তু তিনি রাজী হলেন না। তাঁর মনে পড়ল তারানাথ তর্কবাচস্পতি মহাশয় অত্যন্ত আর্থিক দূরাবস্থায় আছেন। এই ৯০ টাকা বেতনের চাকরিটা তাঁর দরকার। তারানাথের বাড়ি ছিলো কালনায়। কলকাতা থেকে পায়ে হেঁটে বিদ্যাসাগর কালনায় পৌঁছোন এবং তারানাথকে ৯০ টাকা বেতনের এই আকর্ষণীয় চাকরি নিতে অনুরোধ করেন। বিষ্ময়ে হতবাক হয়ে তারানাথ বলেছিলেন, তুমি মানুষ না ঈশ্বর? তারানাথের করা এই প্রশ্ন আমাদেরও - ইনি কি সত্যিই মানুষ না ঈশ্বর? এই তারানাথ পরবর্তী কালে বিদ্যাসাগরের সমাজসংষ্কারমূলক কাজে, বিদ্যাসাগরের বিরোধিতা করেছিলেন। জীবনের শেষ দিকে কেন বিদ্যাসাগর ভদ্রলোকদের সান্নিধ্য ত্যাগ করে আদিবাসীদের সাথে থাকতেন তার পিছনে অসংখ্য অসংখ্য অকৃতজ্ঞতার ঘটনার মধ্যে এই ঘটনাও ছিল।
১৮৫৬ সালে তিনি বিধবা বিবাহ প্রবর্তন করেন। এই সমাজসংষ্কার করতে গিয়ে তাঁকে সমাজের সর্বস্তর থেকে বিরোধিতা, এমনকি জীবনের ঝুঁকি নিতে হয়। তবু তাঁকে দমানো যায় নি। কিন্তু এই আইন প্রবর্তন করাতেই থেমে না থেকে তিনি ১৮৫৬ থেকে ১৮৬৭ - এই ১১ বছরে ৬০টি বিধবাবিবাহ নিজের খরচে দেন। এতে তাঁর ৮২০০০ টাকা ব্যয় হয়। বিরাট ঋণ হয়ে যায়। তাঁর এত ঋণ হয়ে গেছে শুনে একটি কমিটি গঠন করে কিছু লোক সাধারণ মানুষের কাছ থেকে টাকা তোলার উপক্রম করলে তিনি তাদের তা করতে কড়া ভাবে নিষেধ করেন। নিজেকে তিনি নিজেই ঋণমুক্ত করেন। এরপর তিনি লক্ষ্য করেন সে সময়ে পুরুষের বহুবিবাহের চল থাকায় বহু পুরুষ এক স্ত্রী থাকা সত্বেও একজন বিধবা বা কুমারীকে বিয়ে করছে। এর পরেই বিদ্যাসাগর পুরুষের বহু বিবাহ ও নারীর বাল্য বিবাহের বিরূদ্ধে আত্মনিয়োগ করেন।
মাইকেল ও বিদ্যাসাগর
সুদূর ভার্সাই-এ থাকা মাইকেল মধুসূদন চূড়ান্ত অর্থকষ্ট ও বিরাট ঋণগ্রস্ত হয়ে সাহায্যের জন্য যাদের চিঠি দিয়েছিলেন, একমাত্র সাহায্য এসেছিল বিদ্যাসাগরের কাছ থেকে। নিজে ঋণ করে মাইকেলকে এক বিরাট পরিমাণ অর্থ বিদ্যাসাগর না পাঠালে মাইকেলকে বিদেশের মাটিতে চূড়ান্ত অপমান ও কারাবাস ভোগ করতে হত।
নারী শিক্ষা ও বিদ্যাসাগর
১৮৫৭ থেকে ১৮৫৮ - এক বছরে বিদ্যাসাগর নারীদের জন্য ৩৪টি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। স্কুলের গাড়ি গিয়ে বালিকাদের বাড়ি থেকে তুলে আনত, আবার স্কুল শেষে আবার বাড়িতে পৌঁছে দিত। স্কুল তৈরী, শিক্ষকদের বেতন, আসবারপত্র, বই কেনা যাবতীয় খরচ বহন করতেন বিদ্যাসাগর। সারাজীবন তিনি নারীদের জন্য স্কুল তৈরী ও সেই সব স্কুলের যাবতীয় খরচ বহন করে গেছেন।
দয়ার সাগর
তাঁর অসংখ্য দানের কথা, বহু ঘটনা প্রকাশ্যে আসে নি। কারণ অকৃতজ্ঞ অসংখ্য মানুষ বিদ্যাসাগরের কাছ থেকে উপকার পেয়ে সে সব কাউকে বলা তো দূর কথা, বিদ্যাসাগরের ক্ষতি করেছেন। সারাজীবন বিদ্যাসাগর হিন্দু, মুসলমান, উচ্চ, নীচ এসব বিভেদ না করে পীড়িত মানুষের সেবা করেছেন। অসংখ্য কলেরা রোগীকে পথ থেকে তুলে এনে তাঁদের সেবা করেছেন। ১৮৬৬ সালে ভয়ানক মন্বন্তরের সময় অন্নসত্র খুলে তিনি বহুদিন ধরে অসংখ্য অসংখ্য ক্ষুধায় পীড়িত মানুষের মুখে অন্ন তুলে দেন। এসময় তিনি অকাতরে অর্থ ব্যয় করেন। ১৮৬৯ সালে ম্যালেরিয়া জ্বরের (সে সময় একে বর্ধমান জ্বর বলা হত কারণ বর্ধমান জেলায় প্রথম এটি শুরু হয়) ভয়াবহতার সময় বিদ্যাসাগর বহু দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপন করেন, তিনি বহু মানুষের জীবন বাঁচান। অসংখ্য মানুষ তাঁকে ঠকিয়েছে। ছেলের পড়াশোনা, মেয়ের বিয়ে, সাংসারিক দুর্দশা এসব কথা বলে অসংখ্য লোক বিদ্যাসাগরের কাছ থেকে টাকা, পয়সা নিয়ে তা অপব্যয় করেছে। এসব প্রতারণা বার বার হয়েছে, তবু তিনি শিবজ্ঞানে জীবসেবা বন্ধ করেন নি।
আত্মসম্মান বোধ ও বিদ্যাসাগর
আলু পটল বেচব, তবু যে চাকরিতে সম্মান নেই তা করব না। বিদ্যাসাগর একবার বলেছিলেন কথাটা। সম্মানের সাথে আপোষ করেন নি বলে লোভনীয় চাকরী ছেড়েছেন একাধিক বার। এমন কি ভাই এর বিয়েতে আসবার সময় ছুটি পেতে অসুবিধা হচ্ছিল, কিন্তু মা ডেকেছেন, বিদ্যাসাগর জানিয়ে দেন ছুটি না পেলে চাকরি ছেড়ে দেবেন কিন্তু মা যখন ডেকেছেন, তখন বীরসিংহে তিনি যাবেনই। শেষ অবধি তাঁকে ছুটি দিতে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ। উত্তাল দামোদর সাঁতরে পার হয়ে বিদ্যাসাগর গ্রামে ভাই এর বিয়েতে আসেন।
হিন্দু কলেজের অধ্যক্ষ কার সাহেব বিদ্যাসাগরকে বসতে না দিয়ে টেবিলের উপর পা তুলে অভ্যর্থনা করলে কয়েক দিন পরে কার সাহেবকে ঠিক এক ভাবে টেবিলে পা তুলে অভ্যর্থনা করে, বসতে না দিয়ে পাল্টা জবাব ফিরিয়ে দেন বিদ্যাসাগর।
নীলদর্পণ নাটকের অভিনয় দেখতে বসে নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের বিরূদ্ধে বিদ্যাসাগরের রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটে যায় যখন তিনি নীলকর সাহেবের ভূমিকায় অভিনয় করা অর্ধেন্দুশেখরের উদ্দেশ্য নিজের জুতো ছুঁড়ে মারেন। সাথে সাথে অভিনয় থামিয়ে বিদ্যাসাগরের উদ্দেশ্যে প্রনাম করে অর্ধেন্দুশেখর জানান - এ তাঁর অভিনয়ের সেরা পুরস্কার, এ জুতো তিনি সারাজীবন নিজের কাছে রেখে দেবেন।
বাংলা ভাষা ও বিদ্যাসাগর
বাংলা গদ্য সাহিত্যের জনক তাঁকে পুরোপুরি বলা যাবে না। কারণ মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকার, রামমোহন রায় এঁরা বিদ্যাসাগরের আগেই বাংলা গদ্যের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছেন। বিদ্যাসাগরের কৃতিত্ব তিনি গ্রাম্য পাণ্ডিত্য, গ্রাম্য বর্বরতা থেকে বাংলা ভাষাকে মুক্ত করে বাংলা ভাষাকে পৃথিবীর এক অতীব সন্মানীয়, ভদ্র ভাষায় পরিণত করেছেন। বিদ্যাসাগরের পরম বিরোধী মানসিকতার মানুষ সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র বলেছেন বিদ্যাসাগরের ভাষা অতি সুমধুর ও মনোহর। তাঁহার পূর্বে ও পরে এমন সুমধুর বাংলা গদ্য আর কেউ লিখতে পারেন নি। কমা, সেমিকোলন এসব যতিচিহ্ন বাংলা সাহিত্যে এনেছেন বিদ্যাসাগর। আমাদের সবার অক্ষর পরিচয়, ভাষা শিক্ষার হাতেখড়ি আজও করান বিদ্যাসাগর।
তাঁর জীবনে এত অবিস্মরণীয় ঘটনা, অনেক লিখলেও কিছুই লেখা হয় না।
একবার সাহেবদের একটি অনুষ্ঠানে তিনি প্রধান অতিথি হিসাবে ধুতি, চটি পড়ে আসায় তাঁকে দারোয়ান আটকে দেয়। এরপর অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তারা তাঁর সাথে যোগাযোগ করলে তিনি জানান পোশাক না মানুষ - আপনারা কাকে আমন্ত্রণ করেছেন?
কার্মাটারে এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে তিনি যখন ট্রেন থেকে নামেন, দেখেন এক বাঙালী সামান্য কিছু মালপত্র নিয়ে কুলির খোঁজ করছেন। নিজের পরিচয় না দিয়ে বিদ্যাসাগর তাঁর মালপত্র নিজে বহন করেন এবং শোনেন বিদ্যাসাগরের বক্তব্য শোনার জন্য তিনি এসেছেন। পরের দিন বিদ্যাসাগরের বক্তব্য শুনতে গিয়ে ঐ বাঙালী বোঝেন যে তিনি বিদ্যাসাগরকে দিয়ে কুলির কাজ করিয়েছিলেন। অনুতপ্ত হয়ে তিনি ক্ষমা চেয়ে নেন, তাঁকে সস্নেহে বিদ্যাসাগর বলেন
নিজের মালপত্র নিজে বইতে কিসের লজ্জা?
এমন মহাসাগর তুল্য মানুষটিকে নিয়ে অনেক পাতা লিখে গেলেও কিছুই লেখা হয় না।
১৮৬৬ সালে একটি বালিকা বিদ্যালয় পরিদর্শন করে ফেরার সময় ঘোড়ার গাড়ি উল্টে বিদ্যাসাগর ভীষন আহত হন। তাঁর লিভারে ভয়ংকর আঘাত লাগে। অনেকের ধারণা এই আঘাতই তাঁর মৃত্যু ত্বরান্বিত করে।
ভারতের ইতিহাসে, মনুষ্য জাতির ইতিহাসে প্রতিভাসম্পন্ন মানুষ অনেক এসেছেন। কিন্তু এত বেশী মনুষ্যত্ববোধসম্পন্ন কোনও মানুষ ইতিহাসে আর বোধ হয় কেউ আসেন নি। বিরলের মধ্যে বিরলতম এমন মানুষ হাজার হাজার বছর পরে জন্ম নেন। তাঁকে কোটি কোটি প্রণাম জানাই।
তাঁর কথা লিখতে লিখতে মনের অজান্তে চোখের পাতা জলে ভিজে এল আমার। যাঁরা তাঁকে দর্শন করবার, প্রণাম করবার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন, তাঁদের মানব জন্ম সার্থক।
আজ তাঁর ১৩১তম মহাপ্রয়াণ দিবস।
স্বামীজির একটি কবিতা শুধু বিদ্যাসাগর সম্পর্কে সবচেয়ে বেশী প্রযোজ্য -
বহুরূপে সন্মুখে তোমার
ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর
জীবে প্রেম করে যেই জন
সেই জন সেবিছে ঈশ্বর
*******