#পাহাড়যাপন
বনপাহাড়ের দেশ। সবুজ ঘন জঙ্গল। মাথার ওপর গাছের শাখা প্রশাখায় একসুরে ডেকে চলেছে দোয়েল, ময়ূর, ম্যাগাপাই, আরও কত নাম না জানা পাখি। মাটির রং খয়েরি সবুজ, মনে হয় খানিক আগেই হয়ে গেছে একপশলা বৃষ্টি। কচি সবুজ পাতাগুলো থেকে এখনও জল চুঁইয়ে পড়ছে। টুপ,টুপ,টুপ টুপ...নাকে ভেসে আসছে বৃষ্টির সোঁদা গন্ধ। মুক্ত আসমানি শামিয়ানার নিচে একখানা মাত্র বাড়ি, তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে মস্ত এক গাছ। বাড়ির রোয়াকে বসে কলকেতে টান দিচ্ছে এক বৃদ্ধ, তাকে কোথায় যেন দেখেছি।
মন দিয়ে দেখে চিনে ফেলি। আমারই প্রতিরূপ, তবে ভারি আনমনা। কোত্থেকে আমদানি করা হল একে? তাজ্জব! কেসফাইলের দরকার পড়ে না, সব কিছু আপনা হতেই স্পষ্ট হয়ে আসে আমার কাছে।
বুড়োর বেয়াদব চোখের দিকে তাকালেই বোঝা যায়, কাল মধ্যরাতেও যথারীতি বিছানা ছেড়ে নেমে এসে আকাশের তারার সঙ্গে আড্ডা দিয়েছে সে! বুড়ো কিছুরই তোয়াক্কা করল না সারাজীবন। নগরজীবনের সমঝদাররা কত করে বোঝালো, কিন্তু জীবনকে হিসেবনিকেশ করে দেখার দৃষ্টি যে সে অনেক আগেই খুইয়েছে। স্বেচ্ছায় বর্জন করেছে গৃহপালিত স্টেটমেন্টের নিয়মিত আপডেট আর গাজোয়ারি করে হাতছাড়া করেছে সোহবতি শিক্ষার শংসাপত্র। একফালি আকাশ আর এক পৃথিবী সবুজ নিয়েই সে খুশি। এক চিলতে ঘর আর গুমরে ওঠা মেঘ নিয়ে তার সংসার। হঠাৎ বৃষ্টির চমক আর ঝড়ের সঙ্গে গুলতানি। অদ্ভুত এই গ্রাম! এখানকার নিয়মও অদ্ভুত। মন নিয়ে কাজকারবার, বাজারে পসসা সাজিয়ে বসে না কেউই। বরং সবাই মিলে গল্পের আসর হয়। কেউ গল্প বলে, কেউ শোনে। কল্পনা নয়, স্মৃতির অনুজ্জ্বল কোণে রাখা চকমকি গল্প। ঘটনা, কিসসা, হয়তো বা স্রেফ লাতিফা! এরম করেই কাটে। স্মৃতি ও বিস্মৃতির মেহফিল শেষ হয়। প্রিয়জনের সঙ্গে বিচ্ছেদও ঘটে, কিন্তু বিদায়বেলায় বিমর্ষতা আর আক্ষেপে হাত ধরাধরি করে আসে না এই গ্রামে। বরং সেতার বা শেহনাইয়ের সুর ভেসে ওঠে পুরোনো আয়না ভেঙে গেলে...
এখনও বাড়িটা চোখের সামনে ভাসে। এই পৃথিবী থেকে সেখানে যাওয়া যায় না। তার অবস্থান ভিন্ন ছায়াপথে। হয়তো বা এই বাড়ির একমাত্র বাসিন্দার সঙ্গে দেখা হতেও পারত গ্রহান্তরের পথিকের, কিন্তু সে নিজেও যে পাক খেয়ে চলেছে নিরুদ্দেশ জীবনচক্রের গোলকধাঁধায়। তার কোনও ঠিকানা নেই, ভেঙ্গে পড়া কয়েকটি আয়নার স্বীকোরক্তিই তার সম্বল। দেখতে গেলে কোনও কাজও নেই তার, ফসল ফলানো আর রান্না করাটাকে কাজ বলে আমরা স্বীকার করেছিই বা কবে? গাছ আর পাখিদের সঙ্গে গল্পগাছা চলে বাকিটা, আর চলে রোয়াকে বসে কলকে টানা। এখনও সেই একই দৃশ্যের মঞ্চায়ন চলছে, প্রতিদিনেরই মতো। কিছুক্ষণের মধ্যেই অন্ধকার নেমে যাবে, চোখ বুজলে শুনতে পাওয়া যায় ঝিঁঝিঁর শব্দ।
আর মাত্র কয়েক সেকেন্ড। আমি এখনও দেখতে পাচ্ছি বাড়িটা, বাড়ির লোকটাকে। ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে আসছে দৃশ্যটা।
চোখের পলক বন্ধ হল। বৃষ্টিভেজা বন আর পাহাড়ি গ্রাম উবে গেল মুহুর্তে। সাদা মার্বেলের ঘরে দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। কল্পনাকলের মেশিন থেকে বেরিয়ে এসে চশমা খুললাম, চোখ মুছলাম রুমাল দিয়ে। সার্কিটগুলো বদলাতে হবে। সবুজের ছোঁয়া চোখে লেগে আছে বলেই হয়ত...অভ্যেস ছেড়ে গেছে আজ ৫০০ বছর। ছেলেবেলার নেশা! তখন আমি বাড়ি পালিয়ে বনপাহাড়ের দেশে যেতে পারতাম, একটা বই খোলাই যথেষ্ট ছিল। তখন আমি সবুজ দেখতাম সিঁড়ির কোণায় বা ছাদের পাঁচিলের গায়ে, বুকসেল্ফের তাকে বা আয়নায় কাঁচে। সবুজ দেখার অভ্যেসে ভেজাল ছিল না কোনও।
তখন আমি মানুষ ছিলাম।
অসাধারণ - লেখা আর ছবি
ছবিটা অপূর্ব।
ভালো লাগলো। এরকম জায়গা সত্যিই আছে। মনের দুমকা, দিকশূণ্যপুর, আইল্যান্ড অফ সেল্ফ ... সাইলেন্স।