গঙ্গার ধারে ছোট শহর কলকাতা। বড়বাজারের ভিড় রাস্তা এঁকেবেঁকে একশো ঠ্যালাগাড়ি, হাজার দোকান, লক্ষ দরদাম আর বিবাদী বাগ পেরিয়ে যেই না এসে পড়ে সাহেবসুবো প্রাচীনতায়, আমার চলাচল শুরু। রেড রোড পেরিয়ে একদিকে চলে যাই ধর্মতলায় কখনও, কখনও অন্যদিকে পার্কস্ট্রীট বা তারামণ্ডল। আরও কিছুটা এগোলে আমার চলাচল বাড়ে। পিজি হাসপাতালের পাশ দিয়ে হরিশ মুখার্জি রোড, গুরুদ্বারা, বলবন্তের ধাবা, ২৫ টাকার ভাঁড়ে পুরু দুধের চা। গঙ্গার গা থেকে সরে আমি এসেছি এখন আদিগঙ্গার কাছে। ওদিকে কেউ বিশেষ ঘেঁষে না। পেল্লায় নোংরা। কিন্তু আমার না গিয়ে উপায় নেই। গদাধর আশ্রম বা বলরাম বসু ঘাটের দিকে যাওয়ার উঁচুনিচু গলিগুলো ধরে হাঁটলে আমার এই শহরটাকে খুব আপন মনে হয়। একেবারে বুকে জড়িয়ে ধরতে পারি তার ধুকপুক, হলুদ বাড়ির সবুজ খড়খড়ি গুলোর দিকে তাকালে মনে হয়, ওপার থেকে চারুর মতো কেউ বুঝি লুকিয়ে রাস্তা দেখছে। কিন্তু আমি কাউকে দেখতে পাই না, তাই আমার আরও ভালো লেগে যায় এই শহরটাকে। ঘাটে যাওয়ার গলি ভাগ হয়ে গেছে আরও সরু সরু কানাগলিতে। দিনদুপুরেও মনে হয় সে সব রাস্তা অতল। বাড়ির সরু সরু দরজা, আধখোলা দরজা দিয়ে দেখা যায় ওইটুকু উঠোনেই একফালি কলতলা।
কলকাতার সঙ্গে আমার সখ্য ফুরোয় না। একবার মিনার্ভায় নাটক দেখতে গেছি, কিছুক্ষণ আগে পৌঁছে যাওয়ায় তার আশেপাশের রাস্তা ধরে হেঁটে হেঁটে ঘুরছি। হঠাৎ মনে হল, ওই বাড়িটার ওপারেই বুঝি নদী। মনে হওয়ার কোনোই কারণ নেই। তবু মনে হল। পুরোনো বাড়িটার ওপরে তখন প্রথম বর্ষার ঘোলাটে আকাশ। বিকেলবেলা। মনে হল, এই বাড়ির পিছনেই বুঝি শতসিঁড়ি নেমে যাওয়া একটা ঘাট আছে, যেন তার পাশ দিয়ে বৃদ্ধা, শান্ত, বিরাট গঙ্গা সমুদ্রে বয়ে চলেছে। তাই আমি সে বাড়ির পিছনের রাস্তায় আর গেলাম না। ওর পিছনে আরেকটা বাড়ি, তার পিছনে আরও একটা – জানি। কিন্তু আমি যে ভেবে ফেলেছি এই বাড়ির পিছনে ঘাট থাকতেই হবে! তাই থাকুক সে ঘাট আমার চোখে। ফেরার পথে আরেক জানলার খড়খড়ির আড়াল থেকে ভেসে আসছে গুরুগম্ভীর কণ্ঠস্বর, গলা উঠছে নামছে, কখনও বকছে কাউকে, কখনও নিরাশ। বুঝলাম, নাটকের রিহার্সাল চলছে। আমার ভারি মন খারাপ হল। এইটুকু বাড়ির পুরোনো জানলার ওপারে কত, কত স্বপ্ন। কত ইচ্ছে। কত আগামী না-পাওয়া। আমি, এক পথচারী, তাদের সাক্ষী থেকে গেলাম। আবার নিজের মনে মনে জড়িয়ে ধরলাম শহরটাকে। যে শহরে আকাশ দেখলে নদীঘাটের কথা মনে পড়ে, সে শহর ছেড়ে লোকে কেন যে প্রবাসে চলে যায়!
সেই যে হরিশ মুখার্জি রোডের সরু সরু গলি ধরে এগিয়ে গেছিলাম আদিগঙ্গার দিকে, সে পথ থেকে বেরিয়ে আর অল্প এগোলেই রানী শঙ্করী লেন, দুর্গাবাড়ি, আর দু-পা গেলেই হাজরার বড়রাস্তা, মানুষের ঢল। কখনও কখনও বেশি সন্ধেতে যখন হাজরা পেরিয়ে কালীঘাটের রাস্তা ধরে রাসবিহারীর দিকে এগোই, বাড়ির জন্য অটো ধরবো বলে, মনে হয় কলকাতার মাঝবরাবর একটা অদৃশ্য নদী আছে। বেশি সন্ধের প্রতিটা ফাঁকা রাস্তা তার জোয়ারে ভাসে, দিনফেরৎ ক্লান্ত গতরখাটুনের দল পাতা বা বাংলায় টান দিতে দিতে ভেসে যায় সেই নদীতে। পরদিন সকালে তাদেরই কেউ কেউ বেশ বেলা অব্দি ফুটপাথে পড়ে থাকে অচেতন। আমি হাঁটতে হাঁটতে সে নদীর স্রোত বুঝি পায়ের নিচে। বেসামাল হয়ে পড়ি। মুক্তাঙ্গনে নাটক ভাঙে। পাশের ফুটপাথে চা-দিদা তার সামান্য পসার নিয়ে বসে থাকেন। হুশ-হুশ গাড়ি চলে যায় গড়িয়াহাট বা সাদার্ন অ্যাভেনিউ-এর দিকে। চায়ে চিনি পড়ে। লেকমার্কেটের ফুল-দোকানীরা বারবার জল ছেটায় মালার গায়ে; মুরলীধর কলেজের পথে যাওয়ার রাস্তায় সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকে দামি-দামি গাড়ি; দই-লস্যির দোকানে ঝাঁপ নেমে আসে।
গড়িয়াহাট তখনও জমজমাট। বাজার-দোকান, দরাদরি, দাবার চাল – সবই চলছে বহাল তবিয়তে। তাকে ঠেলেঠুলে চলে যাওয়া যায় বিজন সেতুর নিচে। একটা বেজায় পুরোনো ট্রাম-গুমটি। পুরো অন্ধকার নয়, কোথায় জানি একটা-দুটো নিচুরঙের বাল্ব জ্বলছে, তাতে গুমটিকে আরও বেশি অন্ধকার লাগছে। মাঝেমাঝে ভূতুড়ে বাড়ির দরজা খোলার মতো ট্রামের ঘটাং-ঘট। বড়রাস্তা ভাগ হয়েছে দু-দিকে। একদিকে নিঃসাড় বসতবাড়ির সারি। অন্যদিকে বাজার, হট্টগোল। সে বাজারে কোনো বর্ষার সন্ধেয় দাঁড়িয়ে যদি ওপরে আকাশের দিকে তাকানো যায়, দেখা যাবে বিজন সেতুর উঁচু হ্যালোজেনের আলো বেয়ে নেমে স্বর্গ থেকে নেমে আসছে ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি। দূরে ডাউন লোকালের ভোঁ। তখন, ঘোর জঞ্জালের মধ্যে থেকেও আমার মনে হয়, বর্ষার আকাশ থেকে যদি নিচের এই নীল প্লাস্টিক জড়ানো, আলোমাখা দোকান-পাট, মানুষজন দেখতে পাই কোনোদিন, জানবো কলকাতা আসলে কোনো নদী। আকাশের আলোয়ে সে রূপবতী। আমার খুব দুঃখ হয় সে-সব দৃশ্যে। কারুর মায়ায় সত্যি সত্যি বাঁধা পড়লে, তাতে দুঃখ ছাড়া আর কিছুই থাকে না।
আমি আমার সমস্ত ভালোবাসায়, অধিকারে দুঃখ পেতে রাজি। কলকাতা আমায় কখনও জড়িয়ে ধরেনি, কিন্তু আমার শিকড়ে জল দিয়েছে প্রতিদিন। সে বাঁধন চিনিয়েছে, ছেড়ে যাওয়াও। যদিও এ’ জন্মে আমার তাকে ছেড়ে যাওয়া হবে না। কারণ, কোনো-কোনোদিন মনে হয়, কলকাতা বুঝি শহর নয়, নদী নয়, কেবল কোনো ভালোবাসার মানুষ। রাত হয়ে এলে চোখ বন্ধ করে নিই এই সকল রাস্তা-মানুষজন থেকে, কিন্তু মনে মনে জানি, একদিন চোখ খুলে দেখব, এই সমস্ত ছোট-বড় রাস্তা, বাড়িঘর খড়কুটোর মতো কলকাতার সেই বিরাট, অদৃশ্য নদীতে ভাসছে। একদিন চোখ খুলে দেখব, সত্যিই মাথার ওপর ঘোলাটে বিকেলের আকাশ, আর আমার পায়ের কাছে সত্যিই এক নদীঘাট নেমে গেছে গঙ্গায়। একদিন চোখ খুলবো আরেক চোখের জন্য – সে চোখ কখনও নদী, সে-ই নৌকো আর বৈঠা, সে-ই বান হয়ে ভেঙে পড়ে আমাতে, আবার পরক্ষনেই মাঝি হয়ে আমায় সাহস দেয় গভীর জলে। সেই চোখ বেঁচে থাকার সমস্ত কারণ ও আমার দুঃখের আধার। তবু, কলকাতার বুকে দাঁড়িয়ে ভালোবাসায়, ভালোবাসি – এ কথা বলতে পারায় এখনও অহংকার আছে। শেষে তার দুঃখ। কিন্তু নদী আর কবেই বা ঠিকানার সন্ধান দিয়েছে মানুষকে?
খুব ভালো লিখেছেন।..
ধন্যবাদ আপনাকে। মতামত পেয়ে ভালো লাগল।