এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • দিয়েন বিয়েন ফু এক দুর্গ  পতন :  এক সাম্রাজ্যের বিদায়

    Sudip Gupta লেখকের গ্রাহক হোন
    ২১ জুন ২০২১ | ২২৯০ বার পঠিত
  • (ভিয়েতনামী ও ফরাসী নামগুলির সঠিক উচ্চারণ আর তার বাংলায় বানান বেশীর ভাগই জানি না। দু এক যায়গায়, যেখান ইউটিউবে ডকুমন্টারী শুনে যা মনে হয়েছে সেটাই লিখেছি, বাকীটা যেরকম ইংরেজীতে লেখা আছে, সেই রকমই লিখেছি।)

    প্রেক্ষাপট :

    সময়টা ১৯৪০ থেকে শুরু করেছি। এর থেকেও পিছিয়ে গেলে মুশকিল।

    ভিয়েতনামের ইতিহাস বড়োই কুটিল। পাশাপাশি রাষ্ট্র, যেমন কাম্বোডিয়া, লাওস, থাইল্যান্ড - এদের ইতিহাস এতো রক্তাক্ত ছিলো না তখনো।

    ভিয়েতনামেরও সত্যিই কোনো উপনিবেশ হওয়ার যোগ্যতা ছিলো না। কী ছিলো ঐ দেশে? একেবারে সম্পুর্ণ কৃষি ভিত্তিক দেশ। খুবই গরীব। তাতে না আছে কোনো মুল্যবান খনিজ না আছে কল কারখানার প্রাচুর্য্য না কোনো ক্যাশ ক্রপ - রাবার, তূলো - এইসব কিছুই নেই। কৃষি বলতে মুলতঃ ধান চাষ। ব্যাস।

    দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই ব্যাপারটা এক অসম্ভব জগাখিচুরির রূপ নিয়েছিলো। ভিয়েতনামের উত্তর অংশে চিয়াং কাই শেকের চীনা সেনাদের আধিপত্য। দক্ষিণ ভাগে ভিশি (Vichy) ফ্রান্স (অর্থাৎ জার্মানীর অনুগত পাপেট ফরাসী সরকার)। ক্রমশঃই জাপানীরা এসে দখল করে নিলো। খাতায় কলমে কিন্তু ভিয়েতনাম তখনো ফরাসীদের কলোনি। নেহাৎই নাম কা ওয়াস্তে - ক্ষমতায় প্রচন্ড অত্যাচারী জাপানীরাই। ফরাসী "সরকার" তাঁদের হুকুম মতোই চলে।

    ১৯৪৫এ জাপানী অত্যাচারে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ ঘটলো ভিয়েতনাম জুড়ে। তুলনীয় ব্রিটিশদের অবদান ১৯৪২র বাংলার man made famine । কতো লোক অনাহারে মারা গেছিলেন ভিয়েতনামে? একটা দায়সারা হিসেব আছে কুড়ি লক্ষের । এর বেশী বিশ্বাসযোগ্য সঠিক কোনো তথ্য নেই।

    ৪৫'র ১৫ই অগস্ট, জাপানী সম্রাট হিরোহিতো আত্মসমর্পনের ঘোষণা করলেন। আনুষ্ঠানিক ভাবে সেই চুক্তি স্বাক্ষরিত হতে সময় লাগবে ২ সেপ্টেম্বর।

    ততোদিনে হো চি মিন ফরাসী সরকারের অপসারণ করে স্বাধীন ভিয়েতনামের আহ্বান জানিয়েছেন - কিন্তু সেটা প্যারিসে বসেই !

    কিন্তু ভিয়েতনামের দায়িত্ব নেবে কে? ফরাসীদের তখুনি অনুগত সেনাদের পাঠিয়ে দখলদারী নেওয়ার ক্ষমতা নেই। অগত্যা জাপানী সেনাদেরই বলা হোলো, আপনারাই একটু সামলে রাখুন।

    ৯ই সেপ্টেম্বরে কুওমিন্টাং চীনা সেনারা হ্যানয়তে আনুষ্ঠানিক ভাবে জাপানীদের হাত থেকে ক্ষমতার দখল নিলেন এবং অবিলম্বে যে কজন ফরাসী নাগরিক ছিলেন প্রশাসনে, তাদেরকে দূর করে দিলেন।

    ওদিকে, দক্ষিন ভিয়েতনামে, মানে সায়গনে, ১৩ই সেপ্টেম্বরে ব্রিটিশ সেনা (মুলতঃ ভারতীয় সেনা) জাপানীদের হাত থেকে সরকারী ভাবে ক্ষমতা নিলো - তবে সেও কিন্তু ফরাসীদের হয়েই।

    আর জাপানী সেনাদের মধ্যে এক হাজার সেনা ফরাসী/ব্রিটিশ আনুগত্য না মেনে উত্তর ভিয়েতনামে চলে গেলো সেখানকার স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দিতে।

    অবশেষে সায়গনে, সেই ২১শে সেপ্টেম্বরে আবার উড়লো ফরাসী পতাকা। সে ও "ব্যাং মারবে, ছুঁচো মারবে, সামনে ধরে দিলে" গোছের - সেই ব্রিটিশ তত্ত্বাবধানেই।

    খুব, খুবই সংক্ষেপে লেখা এই টাইমলাইন। এই মহা নাটকের দুই প্রধান চরিত্র - আমেরিকা ও ব্রিটেইন - তাদের হঠকারিতা, দ্বিচারিতা এবং নিয়মিত ঘোষিত সরকারি নীতি থেকে পাল্টি খাওয়া, এখনকার "দলবদলু" নেতাদেরও লজ্জা দেবে। সে সব লিখতে গেলে আরেকটি আলাদা প্রবন্ধ প্রয়োজন হবে।

    যারা আর একটু বিশদে জানতে চান তাদের জন্য একটি লিংক দিলাম, চাইলে পড়ে দেখতে পারেন : প্রায় বুলেট পয়েন্টে লেখা ,
    https://en.wikipedia.org/wiki/1940%E2%80%931946_in_French_Indochina

    উত্তর ও দক্ষিণ ভিয়েতনাম

    হ্যাঁ। চিরকালই একটা ফারাক ছিলো। সে তো সব দেশেই একটা আঞ্চলিক তফাৎ থাকে। খাওয়া, পোষাক, ধর্ম, কথ্য ভাষা। কোন ফুটবল ক্লাবের সমর্থক। বাঙালিদের মধ্যে যেমন আছে ঘটি ও বাঙাল। বিয়ের বিজ্ঞাপনে এখনো লেখা হয় পুঃ না পঃ বংগীয় দোসর চাই। কিন্তু মারপিট বা দাংগার মতন ঘটনা ঘটে না। এবং স্থানীয় লোক ছাড়া ঐ তফাৎ কারুর চোখেও পড়বে না। ভিয়েতনামেও সেরকমই।

    ভিয়েতনামে ঐতিহাসিক ভাবেই উত্তর ও দক্ষিণ ভাগের একটা তফাৎ ছিলো। চীনের কোল ঘেঁষা বলে উত্তর ভাগে বুদ্ধ ধর্মের লোক বেশী, দক্ষিনে ক্যাথলিক। ডায়ালেক্টেও তফাৎ আছে। রাজনীতিতেও।

    উত্তরে হ্যানয়কে ঘিড়ে কমিউনিস্টদের প্রাধান্য বেশী। সেই সময়ের ন্যাশনালিস্ট চীন সরকারের সেটি আদৌ পছন্দের বিষয় ছিলো না।

    উত্তর অঞ্চলে প্রায় দেড় লাখ চীনা সেনা গেঁড়ে বসেছে, তারা রীতিমতন হো চি মিনের বিরোধী। দক্ষিনে জাপানী সেনাদের সড়িয়ে প্রথমে ব্রিটিশ ও ধীরে ধীরে ফরাসীরা আসতে শুরু করছে। তাদের সমর্থনে ব্রিটেইন ও আমেরিকা।

    চিয়াং কাই শেকের চীনা সরকারের মদতে কমিউনিস্ট বিরোধী একটা ভিয়েতনামী দলও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। যারা ফরাসীদের বিরুদ্ধে যতো না যুদ্ধ করে তার থেকেও বেশী বেশী লড়ে কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে।

    কিন্ত চীন নিজেই তো বেসামাল। ক্রমেই মাও ৎসে তুংএর কমিউনিস্টেরা আরো ক্ষমতা দখল করে নিচ্ছে। চিয়াং কাই শেকের আসন টলোমলো। ভিয়েতনামে দেড় লাখ সেনা বসিয়ে রাখলে তো চলবে না। তাই ৪৬'র মাঝামাঝি সমস্ত চীনা সেনারাই নিজের দেশে ফিরে গেলো। গৃহযুদ্ধে কমিউনিস্টরা তাদের বিরোধীদের একেবারে কচুকাটা করে নিশ্চিহ্ণ করে দিলে ভিয়েতনামে ফরাসী সরকার ও কমিউনিস্ট ছাড়া আর কোনো পক্ষ বা দল থাকলো না।

    হো চি মিন যেমন ছিলেন একছত্র নেতা, তার ডান হাত ছিলেন গিয়াপ, নগো ভন গিয়াপ। উনি কোনো পেশাদার সেনানী ছিলেন না, জীবন শুরু করেছিলেন ইতিহাসের শিক্ষক হয়ে, যুদ্ধ করতে করতেই তিনি গেরিলা বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হয়ে উঠেছেন। অসংঘটিত গেরিলাদেরকে একটা শৃংখলাবদ্ধ প্রশিক্ষিত বাহিনীর রূপকারও তিনি। এক কিংবদন্তীর নায়ক। ভবিষ্যতে তাঁর নাম একই সাথে উচ্চারিত হবে দুনিয়ার সব সেরা সেনাপতিদের সাথেই।

    দুর্গম টংকিন অঞ্চলে ঘাঁটি গেঁড়ে তিনি ক্রমাগতঃ হামলা চালিয়ে যাচ্ছিলেন ফরাসীদের বিরুদ্ধে। সে রকম সাফল্য কোনো পক্ষেই ছিলো না।

    ৪৯ থেকে ৫৪ - War of attrition

    পরিস্থিতি অনেকটাই বদলে গেলো ১৯৪৯ সালে। চীনে মাওএর নেতৃত্বে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতায় এসে গেলো আর গিয়াপের বাহিনীকে অবাধে রসদ, অস্ত্র যোগান হতে থাকলো চীন থেকে। চীনে প্রশিক্ষণ শিবিরে ভিয়েতনামী গেরিলারা লড়াইএর কৌশল শিখতে লাগলেন। ভিয়েতনামের গেরিলা বাহিনীতেও কিছু চিনা "পরামর্শদাতা" যোগ দিলেন। গিয়াপ প্রথমেই চীন ভিয়েতনাম সীমান্ত অঞ্চল ফরাসীদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিলেন। চীন থেকে সাহায্যের পথে আর কোনো ভৌগলিক বাধা রইলো না।

    কিন্তু ফরাসী সেনাদেরকে নানান ভাবে উত্যক্ত করলেও সেরকম বড় দখলদরি কমিউনিস্টদের অধরাই থেকে গেলো। ফরাসীরাও বুঝেছিলো যে বনে জংগলে ঢুকে গেরিলা বাহিনীর মোকাবেলা করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। বরং কমিউনিস্টরা যেই তাদের দুর্গম ঘাঁটি ছেড়ে বাইরে আসবে তখ্নই ফরাসী সেনারাদের সুবিধে। তাদের অস্ত্রের সম্ভারও বেশী তায় আছে বিমান বাহিনী। অল্প কিছু হেলিকপ্টরও। নিয়মিত ভাবে প্যারাট্রুপারের ব্যবহার করাতেও ফরাসীরা দক্ষ ছিলেন। গেরিলাদের হাতে বড় অস্ত্র বলতে হাল্কা কামান ও মাঝারী মর্টার। ট্যাংক বা সাঁজোয়া গাড়ী তো দূরস্থান, রসদ নিয়ে যাওয়ার মতন ট্রাকই বা কই ?

    তবুও দিনের শেষে, হিসেব কষলে কমুনিস্ট "প্রভাবিত" অঞ্চল বেড়েই চলছিলো।

    উত্তর ভিয়েতনামে অনেকটা অঞ্চলই ভিয়েতমিন (সেই সময়ে কমিউনিস্টরা ঐ নামেই পরিচিত ছিলো) আওতায়। বেশ কয়েকবার ফরাসী বাহিনীর সাথে মুখোমুখি লড়াই হয়েছে ভিয়েতমিনদের - কিন্তু সে রকমএকতরফা সাফল্য জোটেনি কোনো পক্ষেই। কয়েকটি ক্ষেত্রে ফরাসীদের কনভয়ের উপর বিরাট অ্যামবুশ করে ফরাসীদের গতিবিধি অনেকটা সীমাবদ্ধ করে রেখেছিলো ভিয়েতমিনেরা। তবে ভিয়েমিনদের হতাহতের সংখ্যা অনেক বেশী থাকতো।

    আগ বাড়িয়ে হামলা চালিয়ে দু পক্ষেরই ক্ষতি বেশী হয়। দক্ষিণ ভিয়েতনামেও অঞ্চল "দখলের" সাথে সাথে চলতো সন্ত্রাসবাদী হামলা। রেস্টুরেন্টে বা অন্য যায়গায় গ্রেনেড আর বোমা ছোড়া, এইসব। আর দখল বলতে নিজেদের প্রভাব ও কতৃত্ব আরো বেশী করে ছড়িয়ে দেওয়া।

    ভিয়েমিনদের একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ স্ট্র্যাটেজিক উদ্দেশ্য ছিলো ভিয়েতনামের উত্তরপুর্ব অঞ্চল দখল বজায় রাখা ।

    এক তো ওটি লাওসের সীমান্তে। সে সময়ে লাওস ও কাম্বোডিয়া, দুই গরীব দেশে সেনা বাহিনী প্রায় কিছুই ছিলো না। একবার লাওসএ ঢুকলে তারপর খুব সহজেই কাম্বোডিয়া হয়ে ভিয়েতনামের মধ্যভাগকে পাশ কাটিয়ে দক্ষিন ভিয়েতনামের সায়গন ও মোহানা অঞ্চলে হামলা চালানো সহজসাধ্য হবে।

    দুই নম্বর কারন, ঐ অঞ্চলে পাহাড়ী তাই (TAI) জনগোষ্ঠীর বসবাস। তারা খুবই ফরাসীদের অনুগত । ফরাসীদের সেনাবাহিনীর যে ভিয়েতনামী সেনারা, তাদের অনেকেই (প্রায় দশ হাজার) এই জনগোষ্ঠীর লোক।

    তিন নম্বর, এই অঞ্চলে ধান চাষ যথেষ্ট হয়। উত্তর পশ্চিমের ভিয়েতমিন গেরিলাদের দুর্গম ঘাঁটিতে খাদ্যাভাব লেগেই থাকতো। সেটির কিছুটা সুরাহা হবে।

    তাছাড়াও, ঐ অঞ্চলে ফরাসী মদতে তৈরী হয়েছিলো "তাই" জনগোষ্ঠীর একটি গেরিলা বাহিনী, যেটি নিয়মিত কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে সংঘর্ষ বাঁধাতো। তাদেরকেও দূর করার কাজটাও শেষ করতে হবে।

    আর আরেকটি বড়ো কারন ঐ অঞ্চলের আফিম চাষ - খুবই লাভজনক ব্যবসা ।

    ঠিক একই কারনগুলির জন্য ফরাসীরাও চাইছিলো ঐ অঞ্চলে একটা ঘাঁটি করবার। তাদের পছন্দ হলো দিয়েন বিয়েন ফু। একেবারে লাওসের সীমান্ত ঘেঁষে। হ্যানয় থেকে আকাশপথে ২৭৫ কিলোমিটার আর লাওসের সীমান্ত থেকে মাত্র ১৬ কিলোমিটার দূরত্ব। চারিদিকে প্রায় ছয় হাজার ফীট উঁচু বন জংগলে ঢাকা পাহাড়ের কোলে এক সমতল উপত্যকা। আড়ে বহরে মোটামুটি ১৯ x ১৬ কিলোমিটার। ঐ অঞ্চল একটাই যায়গা যেখানে বড় রানওয়ে গড়া যাবে যাতে ফ্রেঞ্চ কার্গো বিমান C47 সহজেই ল্যান্ড করতে পারবে। ঐ খানে কংক্রীটের বাংকার বানিয়ে ভারী আর্টিলারী সাজিয়ে দুর্গ করে দিব্বি থাকা যাবে। চারপাশের খাড়াই পাহাড় থেকে ভিয়েতমিনেরা হয়তো বা অল্প গুলি গোলা চালিয়ে উত্যক্ত করতে পারবে কিন্তু ওরাই বা ঐ পাহাড়ী পথে ভারী কামান তুলবে কী করে - এমন নয় যে ওদের হাতে তখনো ভারী কামান বা মর্টার ছিলো। কর্নেল পিরোথ, যিনি ছিলেন দিয়েন বিয়েন ফুর আর্টিলারী কমান্ডার তিনি বলেছিলেন ভিয়েতমিনেরা এক কামান থেকে তিনবার গোলা ছুঁড়লেই আমরা সঠিক ভাবে নিশানা করে পাল্টা গোলা দাগিয়ে সেই কামান উড়িয়ে দেবো। তখন পর্যন্ত্য ফরাসীদের সেনাদের অভিজ্ঞতা ঐ রকমই ছিলো। সুতরাং দিয়েন বিয়েন ফু - কারুরই আপত্তি ছিলো না। আর এটাও হিসেবের মধ্যে ধরাই ছিলো যে দরকার পড়লেই, হ্যানয় বা তার আশে পাশের যায়গা থেকে ঝটপট কার্গো বিমান বা যুদ্ধ বিমান আর প্যারাট্রুপ সেনারা হাজির হবেন - দিনে রাতে সব সময়েই। সুতরাং চিন্তার কোনো কারন নেই।

    ৫৩ সাল পর্যন্ত্য ঐ অঞ্চলটি যাকে বলে ভিয়েতমিন "অধ্যুষিত" এলাকা ছিলো, তবে ঠিক মুক্তাঞ্চল নয়। ফরাসীরা চাইছিলেন একটা খুব জোরদার বিজয়। কিন্তু সেটা সম্ভব হবে কী করে দুই পক্ষই যদি শুধুই চোরাগোপ্তা হামলা চালাতে থাকে। গিয়াপ আর মুখোমুখী লড়াইতে আগ্রহী নন আর ফরাসীরাও দুর্গম এলাকায় গেরিলা ঘাঁটিতে আক্রমন করায় উৎসাহী নন। তাই চারিদিকে গেরিলা অধ্যুষিত এলাকায় একটা রাতারাতি দুর্গ বানিয়ে ফেলে এবং লাওসের পথ অবরুদ্ধ করে একটা দারুন দাদাগিরি হবে। আর যদি গিয়াপ চাপে পড়ে নেহাৎই দিয়েন বিয়েন ফু'তে প্রতিআক্রমণ করে তো ফ্রান্সের পক্ষে একটা "Spectacular Victory" ওখানেই হবে।

    হ্যাঁ, এই "চমকপ্রদ লোক দেখানো বিজয়ের" একটা প্রেক্ষিত আছে। জেনারেল সালান ছিলেন ভিয়েনামের কমান্ডার ইন চীফ। দিয়েন বিয়েন ফুর প্রাথমিক পরিকল্পনা ছিলো তাঁরই। ৫৩'র মে মাসে তাকে সড়িয়ে এই পদে আসেন জেনারেল হেনরি নাভারে (Henri Navarre)। তাঁকে প্যারিসেই ভালো করে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছিলো এই যুদ্ধ আর বেশীদিন টানা সম্ভব নয়। কিছুদিন পরেই কমিউনিস্টদের সাথে একটা কম্প্রোমাইজ করতে হবে, হবেই। তার আগেই যদি একটা বড় লড়াই জিতে যাওয়া যায় তো শান্তি বৈঠকে ফ্রান্সের হাতেই থাকবে তুরুপের তাস। নাভারে'ও তাই দিয়েন বিয়েন ফু নিয়ে খুবই উৎসাহী ছিলেন।

    ১৯৫৪ - কে কোথায় দাঁড়িয়ে

    সেই সময়ে ভিয়েতমিন গেরিলা সেনার সংখ্যা লাখ তিনেক। এর থেকে বেশী লোকেদের অস্ত্র দেওয়ার সামর্থ্য ছিলো না গিয়াপের। ফরাসীদের প্রায় ৬.৭ লাখ সেনা । তবে এর মধ্যে লাখ দুয়েক ভিয়েতনামী ও থাইল্যান্ডের সেনা। আরো লাখ খানেক উত্তর আফ্রিকার ফ্রেঞ্চ কলোনীর মানে মূলতঃ আলজেরিয়ান আর মরোক্কোর সেনারা। ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডের সেনাদের যুদ্ধপটু বলে আদৌ সুনাম ছিলো না। আলেজেরিয়ানদেরও নয়। মরোক্কোর সেনারা অনেক বেশী সাহসী ও দক্ষ কিন্তু তাদের দুর্নাম ছিলো অত্যাচারী, লুঠেরা ও ধর্ষক বলে।

    যে সব ফরাসী সেনারা স্বদেশ থেকে আট হাজার মাইল দূরে এই অনর্থক যুদ্ধে সামিল তাদের মধ্যে কিন্তু বীরত্ব ও আত্মত্যাগের বহু ঘটনা ও উদাহরণ ছিলো। কী ছিলো তাদের মোটিভেশন?

    মনোবিদদের ধারনা সদ্য সমাপ্ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অতি লজ্জাজনক ইতিহাস থেকে মুক্ত হওয়ার জন্যই ফরাসীরা ভিয়েতনামে ওরকম প্রাণপন লড়েছিলেন। অন্ততঃ একবার দুনিয়াকে দেখিয়ে দেওয়া তারা পরাজিতের জাত নন। তবে খোদ ফ্রান্সেই কিন্তু এই সম্পুর্ণ অনর্থক যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ক্রমশঃই জোড়ালো হয়ে উঠছিলো।

    এবং আমেরিকা? এই তো বছর তিনেক (১৯৫০) সালেই এক প্রচন্ড রক্তাক্ষয়ী লড়াইতে সামিল হয়েছিলো কোরিয়াতে ।পঞ্চাশ হাজারেরও বেশী আমেরিকান হতাহত হয়েছিলো। অবশেষে কোনো সুস্পষ্ট ফলাফল হয় নি, বড়জোর বলা যায় সম্মানজনক ড্র। ৫৪' সালে দুই কোরিয়ার মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়। সেই ঘা শুকানোর মধ্যেই আমেরিকার কী এতো উৎসাহ ছিলো এই লড়াইতে ফরাসীদের সমর্থন করতে? এই যুদ্ধে ফরাসীদের অস্ত্র ও অন্যান্য রসদের ৭৫%ই আসতো আমেরিকার থেকে। এ যেন "আমরা চেক লিখে দিচ্ছি, যাও তোমরা লড়াই করো। দুনিয়াকে কমিউনিস্ট মুক্ত রাখো"।

    চীন - সেই সময়ে (১৯৫৩) ভিয়েতনামের যুদ্ধে নিজেদেরকে ভালোই জড়িয়ে ফেলেছে। প্রতি মাসে, গড়ে আড়াই হাজার টন গোলা বারুদ ও অন্যান্য রসদ পাঠিয়ে যাচ্ছে ভিয়েতমিনদের। ঠিক আগের বছরের গড়ের থেকে পাক্কা দশগুন বেশী। এই সময় থেকেই চীন, ভিয়েতমিনদের মোলোটোভা ট্রাক আর বুলডোজারও পাঠাতে শুরু করে দিয়েছে। গেম চেঞ্জার যদি বলেন তো চীনা সামরিক সাহায্যের মধ্যে শুরু হয়েছে M2A1 ১০৫ মিমি ভারী কামান, ১২০ মিমি ভারী মর্টার আর ৩৭ মিমি বিমান বিধ্বংসী কামান। দিয়েন বিয়েন ফু'র লড়াইতে এরাই চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।

    ফ্রান্স কিন্তু নাজেহাল। নিজের দেশের থেকে সেনাবাহিনির সাধারন ফৌজ ও অফিসার - দুটোই কমতির দিকে। ভাড়াটে সেনাদের নিয়ে এতো দূরের দেশে আর কতো লড়াই চালানো যায়? ঐ সেনাদের মধ্যে মধ্যে হাজার চারেক প্রাক্তন নাৎসী SS সেনাও আছে। তারা সময় মতন কোথাও পালাতে পারে নি। যুদ্ধ করা ছাড়া আর কিছুই জানে না। অগত্যা ফ্রান্সের হয়ে সেই সুদূর ভিয়েতনামে। এদের কাছ থেকে কতোটুকু মরণপন অঙ্গীকার আশা করা যায়? ফ্রান্সের কমিউনিস্ট পার্টি তখন যথেষ্ট শক্তিশালী। তারা এই যুদ্ধের খোলাখুলি বিরোধী। তাদের সাথে রয়েছেন আরো অনেক মুক্তমনা মানুষ। এদের কন্ঠস্বর দিন দিনই বাড়ছে। আর এই যুদ্ধের খরচা টেনে যাওয়াও ফ্রান্সের পক্ষে কষ্টকর হয়ে উঠছে।

    এবং ব্রিটেইন। জার্মানীর আত্মসমর্পনের পর পরই জেনেরাল ইলেকশনে লেবার পার্টীর ভরাডুবি হয়, ফলে এক জীবন্ত কিংবদন্তি হওয়া সত্ত্বেও চার্চিল অপসারিত হন। ১৯৫১ গণভোটে আবার ফিরে আসেন চার্চিল। যদিও খুবই অসুস্থ ছিলেন এবং সেটা মানসিক ভাবেও (তুলনীয় আমাদের দেশে অটল বেহারী বাজপেয়ীর প্রধানমন্ত্রিত্বের শেষ কবছর), তবু তার মতামত অগ্রাহ্য করা যেতো না। চার বছর পর, ৫৫ সালে তিনি স্বাস্থ্যের কারনে পদত্যাগ করেন।

    ব্রিটেইন তো তখন অনেকাংশেই তার কলোনীদের হারিয়েছে। অর্থনীতিও মজবুত নয়। সেনা বা রসদ পাঠিয়ে ফ্রান্সকে সমর্থনের প্রশ্নই নেই। ভিয়েতনামে ফ্রান্সের ভুমিকা, চার্চিল কিন্তু আদৌ সমর্থন করেন নি। এর পরে দেখবো কিছুটা চার্চিলের জোরালো আপত্তির জন্যই আমেরিকা দিয়েন বিয়েন ফুর লড়াইএর সময়ে সড়াসড়ি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে নি।

    রাশিয়া, আর এক সুপার পাওয়ার, ভিয়েতনামকে মরাল সাপোর্ট দিয়েছিলো ১০০% ভাগ - তাদের সাহায্য ঐ চীনের হাত ঘুড়েই আসতো ।

    ভিয়েতনাম কমিউনিস্ট পার্টিতে বেশ স্পষ্ট ভাবেই সোভিয়েটপন্থী ও চীনপন্থী - দুটি গোষ্ঠী ছিলো। হো এবং গিয়াপ এরা সেটাকে ব্যালেন্স করেই চলতেন, তবে পার্টিটা ক্রমশঃই চীনের দিকেই ঝুঁকছে সেটা সবাই টের পাচ্ছিলেন।

    দিয়েন বিয়েন ফু

    ১৯৫৩, বিশে নভেম্বর। সকালের পাহাড়ী কুয়াসা দূর হতেই হ্যানয় থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে প্যারাট্রুপার সেনা এসে ল্যান্ড করলো দিয়েন বিয়েন ফুতে। ঐ অঞ্চলে তখন অল্প কিছু ভিয়েতমিন গেরিলারা ছিলেন। তাদেরকে অল্প প্রচেষ্টাতেই দূর করে দিলো ফরাসী সেনারা। এরপর প্যারাড্রপ করে হাল্কা কামান, মর্টার, আরো রসদ এবং দুটি বুলডোজারও পৌঁছে গেলো সেখানে। প্রথম কাজই হচ্ছে যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব একটা এয়ারস্ট্রিপ বানাতে হবে যাতে বড় কার্গো বিমান নামতে আর উড়তে পারে। সেদিনই ৪৫০০ ফরাসী সেনা ল্যান্ড করেছিলো দিয়েন বিয়েন ফুতে।

    পরিকল্পনা ছিলো আর কয়েক মাসের মধ্যেই প্রায় বারো হাজার সেনাদের আস্তানা হবে এই দুর্গ। তাতে মজুত থাকবে প্রচুর গোলা,বারুদ ও অন্যান্য রসদ। থাকবে মাঝারী ও ভারী আর্টিলারি। কিছুদিনের মধ্যেই ছটি M-24 চাফি (chaffe ) ট্যাংকও পৌঁছে গেলো দিয়েন বিয়েন ফুতে, ঐ আকাশপথেই ।

    এইবারে ঐ রানওয়ের পাশে বড় কমান্ড পোস্ট বানিয়ে তার চারপাশ ঘিড়ে যেসব ছোটোখাটো পাহাড় (বা টিলা) আছে সেরকম সাতটিতে বাংকার, কামান, কাঁটা তারের বেড়া, ট্রেঞ্চ এইসব বসিয়ে এক দুর্ভেদ্য পরিধি বা প্যারামিটার বানানো হলো। ফরাসীরা খুব নিশ্চিন্ত। সেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই তারা কেল্লা বানিয়ে যুদ্ধ করতো, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ম্যাজিনো লাইনের ট্র্যাডিশন বোধহয় তখনো খুব উজ্জ্বল।

    ঐ কেল্লার ভিতরে প্রায় ষোলো হাজার ফরাসী ও তাদের মিত্র পক্ষের সেনা। বার কয়েক কেল্লা থেকে বেরিয়ে তারা আশপাশে অঞ্চলে হানা দিতে গিয়ে যথেষ্ট নাজেহাল হয়েছে। তাই চুপচাপ কেল্লাতেই বসে থাকা - একঘেয়েমি ছাড়া অন্য কোনো সমস্যা নেই।

    আর ততোদিনে বিয়েন বিয়েন ফু প্রায় একটা "টুরিস্ট স্পট" হয়ে গেছে। ফরাসীরা তো বটেই, ব্রিটিশ ও আমেরিকান জেনেরাল থেকে রাষ্ট্রদূত, নানান হোমড়া চোমড়া আসছেন পরিদর্শনে । সবাই ঢেলে প্রশংসা করছেন। জেনারেল নাভারেও খুব গর্বিত।

    যেন এক পিরামিড...

    মাও ৎসে তুং বলেছিলেন, যুদ্ধে বিজয় নিশ্চিত হলে, তবেই শত্রুকে আক্রমণ করা উচিৎ। শত্রুর তুলনায় দুগুন চার গুন, কী সম্ভব হলে ছয়গুন বেশী শক্তি নিয়েই লড়তে হবে। গিয়াপ একেবারেই সেই স্কুলেরই ছাত্র। যেমন ছিলেন মন্টেগোমারি বা জুখব, সে রকম জেনেরাল তিনি। প্রতিটি খুঁটিনাটি ব্যবস্থা আগাম পরিকল্পনা করে একেবারে হুবহু মেপে জুকে না করলে তিনি আগ বাড়িয়ে লড়াই চাইতেন না। কোথাও ঘাটতি থাকলে "ঠিক আছে, ওটা ফীল্ডে নেমে ম্যানেজ করে দেবো" এই নীতিতে উনি বিশ্বাস করতেন না। তাই লজিস্টিকের পুঙ্খানুপুঙ্খ সুরাহা না হলে তিনি লড়াইতে সামিল হতে চান নি কখনো।

    গিয়াপ তাই খুব গুছিয়ে কাজ শুরু করলেন। লড়াই নিয়ে চিন্তা পরে হবে, তার আগে লজিস্টিক।

    সবই চাই। খাবার থেকে গোলা বারুদ। রাস্তাঘাট প্রায় কিছুই নেই। চারিদিক থেকেই যোগাড় করতে হবে। চালই আসছিলো এমন কি পাঁচশো মাইল দূর থেকেও। ট্রাকে করে যতদূর নিয়ে যাওয়া যায়। তারপর কখনো ঘোড়া বা খচ্চরের পিঠে, কখনো বিশেষ ভাবে রি-ইনফোর্সড সাইকেলে, আর কিছু না জুটলে শুধুই পিঠে বেঁধে।

    এই reinforced সাইকেল একটি নতুন উদ্ভাবন। সাইকেলের সীটটা সড়িয়ে দিয়ে রডের উপরে একটা বাঁশ আড়াআড়ি ভাবে বসিয়ে, দুই দিকে বস্তা ঝুলিয়ে দেওয়া হতো। না, ঐ সাইকেল চালানোর কোনো উপায় নেই, হাতে ধরে টেনে বা ঠেলে নিয়ে আসতে হতো। একটা স্টিয়ারিং হাতলও থাকতো হ্যান্ডেলের সাথে লাগানো। একটা সাইকেলে ষাট থেকে সত্তর কেজি মাল আনা হতো - পাহাড়ী পথেও।

    এ ছাড়া ছিলো কুলি, যারা ২৫কেজি মাল পিঠে বেঁধে নিয়ে আসতেন। এই কুলিরা বেশীর ভাগ সময়েই খাবার বয়ে আনতেন - যাতে তাদের ভার প্রতিদিনই একটু একটু করে কমতো। ১২ হাজার ফৌজের জন্য এরকম মালবাহক লাগতো প্রায় পনেরো হাজার। বড় কামানের এক একটি গোলার ওজোনই ছিলো পঞ্চাশ ষাঠ কেজি।

    শুধু ট্রাকেই নয়, নৌকা বা ভেলাতেও প্রচুর রসদ পাঠানো হত। অবশ্য সেটা শীতকালেই সম্ভব হয়েছিলো, মার্চ থেকে বর্ষা নামলে স্রোতের উল্টো দিকে এই সব নৌকা - যেগুলো দাঁড় বেয়ে বা লগি ঠেলে চালাতে হতো, আর চালু ছিলো না। তবে ঐ সময়েই আরেকটি রুটে, নদীপথে সরাসরি চীন থেকে রসদ আমদানি শুরু হয়েছিলো।

    ট্রাকে করে পাঁচটা রুটে রসদ যেতো কিন্তু একটানা নয়। মাঝপথে যেখানে নদী আছে বা আদৌ কোনো রাস্তা নেই, সেইখানে ট্রাক থেকে মাল নামিয়ে পিঠে করে কিছুটা পথ গিয়ে আরেক দল ট্রাকে করে আবার কিছুটা যাওয়া যেতো। আর এই সবই করতে হতো যতোটা সম্ভব চুপিসাড়ে। জংলাপথে যাওয়ার সময় দুই পাশের গাছের মাথা গুলো দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হতো যাতে বিমানের চোখে না পড়ে। কনভয়গুলি রাতের বেলাতে যেতো কোনো আলো না জ্বালিয়েই।

    যে ভিয়েতমিন সেনারা দিয়েন বিয়েন ফুতে গিয়েছিলেন তারা সকলেই রীতিমতন প্রশিক্ষিত ও ইউনিফর্ম পরা সেনানী। তিন প্লাটুনে এক কোম্পানী,তিন কোম্পানিতে এক ব্যাটালিয়ন, তিন ব্যাটালিয়নে এক রেজিমেন্ট ও তিন রেজিমেন্টে এক ডিভিশন - মোটামুটি এই হিসেবে তারা সংঘটিত ছিলো।

    ফরাসীরা কি টের পান নি? অবশ্যই তারা খবর পেতেন। প্রায় ৫৫ হাজার ভিয়েতমিন সেনা, তাদের যাবতীয় গোলা বারুদ, কামান নিয়ে এতোটা পথ যাচ্ছেন, সে তো নজরে আসতোই। বিমান হানাও হতো প্রায়ই কিন্তু ডাইভ বম্বার চালানোর মতন দক্ষ বৈমানিক বিশেষ ছিলো না তখন ফ্রান্সের হাতে। আর উপর আকাশ থেকে একেবারে সঠিক নিশানায় (প্রিসিসন বম্বিং) বোমা ফেলবার মতন আধুনিক বিমান বা পটু বোমারুও ছিলো না। তবু ফরাসীরা মোটামুটি নিশ্চিন্তই ছিলেন। এটির কারণ বলতে গেলে Max Hastingsর কথাই লিখতে হয়, "a lethal cocktail of pride, fatalism, stupidity and moral weakness".

    এর মধ্যেই চলেছে ভিয়েতমিনদের একটানা সিভিল ওয়ার্ক। রাস্তাঘাট মেরামতি (৩০৮ কিলোমিটার), আর্টিলারির জন্য পাহাড়ে পাকদন্ডী পথ (track) ৬৩ কিমি, প্রায় ১৭০০ সেতু তৈরী বা সাড়াই, আরো অনেক কিছু। রাস্তাঘাট বা সেতু ভেঙে গেলে নিমেষে সহকারী কুলিরা শাবল গাইঁতি কোদাল ঝুড়ি নিয়ে সেই রাস্তা বা সেতু আবার সচল করে তুলতো অত্যন্ত দ্রুততার সংগে ।দিয়েন বিয়েন ফুর কাছে পাহাড়ী পথে কোথাও কোথাও শুধু পাকদন্ডী পথ, সেইখানে শুধুমাত্র রাতের আঁধারে দুই টন ওজনের বিশাল বপুর কামান শুধু পেশী শক্তিতে তুলে নিয়ে যাওয়া প্রায় এক অলৌকিক ঘটনা। একটুও ভুল চুক হলেই কয়েক হাজার ফিট নীচে খাদে পতন। আর এর সাথে সাথে রয়েছে কামানের গোলার বিশাল সম্ভার। গিয়াপ কোনো আপসেই রাজী ছিলেন না। তিন মাস ধরে এই বিশাল কর্মযজ্ঞ চলেছে, কিন্তু তিনি যথেষ্ট গোলা বারুদের ভাঁড়ার প্রস্তুত না হওয়া পর্যন্ত্য কোনো আক্রমণেই রাজী হন নি। তাঁর উপর চাপ ছিলো প্রচুর, কিন্তু গিয়াপ কোনো মতেই আগ বাড়িয়ে হামলা করতে রাজী হন নি।

    শুধু তো অকূস্থলে পৌঁছে দিলেই হবে না। ভারী কামান যাতে ফরাসী বিমান ও আর্টিলারীর সহজ শিকার না হয় তার জন্য পাহাড়ের ঢালে বিরাট "গুহা" বানিয়ে কামান গুলি লুকিয়ে রাখা হতো। তোপ দাগিয়েই তারা আবার গুহায় ঢুকে পড়তো। তার আশে পাশে থাকতো নকল কামান, যেগুলিকে ফরাসীরা ভুল করে নিশানা করে। এইসব কামান আর গোলা বারুদের জন্য মাটী খুঁড়ে বিশাল বিশাল শেলটার করা হতো - সেগুলির ছাদ তৈরী হতো গাছের গুঁড়ি, বাঁশ, তার উপরে কাদামাটী আর পাথরের স্তুপ - প্রায় তিন মিটার পুরু। আর এর জন্য গাছ তো আর আশপাশ থেকে কেটে আনা যাবে না - সহজেই ফরাসীরা টের পেয়ে যাবে। তাই অন্ততঃপক্ষে দশ কিলো মিটার দূরের অঞ্চল থেলে বাঁশ আর গাছ কাটা হতো।এইরকম এক একটি শেলটার দুশো লোক সারা দিন রাত খেটে ১০-১৫ দিনে বানিয়ে দিতো। শুধু কি কামানের জন্য? সুরংগ করে মাটীর নীচে আরো তৈরী হতো কমান্ড বাংকার, গোলন্দাজদের বিশ্রামের ঘর এবং ছোটো হাঁসপাতালও। টানেল ও ট্রেঞ্চ করে যোগাযোগ থাকতো সব সময়।

    মোটামুটি ভাবে ১০৫ মিমি শেল ১৫০০০, ৭৫ মিমি শেল ৫০০০, ১২০ মিমি শেল ৩০০০, ৮১/৮২ মিমি শেল ২১০০০ এবং ৪৪০০০টি ৩৭ মিমি শেল এইভাবে স্টক করে রাখা ছিলো। আর অন্যান্য সরঞ্জাম এবং সাধারন গুলি আর মর্টারের গোলা - এসবের আর হিসেব দিলাম না।

    যেন এক পিরামিড - এখন যেমন চোখের সামনে দেখলেও বিশ্বাস হয় না পাঁচ হাজার বছর আগে, কোনো যন্ত্র ছাড়াই মানুষ শুধু তার প্রেশী শক্তি দিয়েই এতো বড় সৌধ নির্মান করেছে, সেই রকম দিয়েন বিয়েন ফুর এই উদ্যোগ পর্বও এক বিস্ময়।

    গিয়াপ লড়াই শুরু করার আগেই এই যুদ্ধ জিতে গেছিলেন।

    খেলা হবে না

    ফ্রান্স কিন্তু ভিয়েতমিনদের রেডিও মেসেজ "পড়ে" তাদের অগ্রগতি ও পুরো ছক - সবটাই খুব ভালো ভাবেই জানতে পারছিলো। এমন কি কোন কোন সাইজের কামান এবং কতোগুলি, কতো গোলা বারুদের স্টক - এই সবই নাভারে এবং দিয়েন বিয়েন ফুর সেনাপতিদের কাছেই পৌঁছে যাচ্ছিলো নিয়মিত।

    কিন্তু ঐ যে, তারা আগ বাড়িয়ে প্রচুর ট্রেঞ্চ খুঁড়ে, আরো মাইন পুঁতে প্রতিরক্ষার তেমন চেষ্টাই করলেন না। এতোদিন ধরে তারা দেখে এসেছেন ভিয়েতমিন সেনারা আদৌ দক্ষ নয় কামান দাগাতে। তায় ফ্রান্সের তখন নুন আনতে পান্তা ফুরায়। মিলিটারি ইন্জিনিয়াররা দিয়েন বিয়েন ফুর প্রতিরক্ষা ঢেলে সাজাতে হিসেব করে চাইলেন ৩৬ হাজার টন রসদ, এবং অবশেষে পেলেন মাত্র ৪০০০ টন। সেও, বেশীরভাগটাই শুধু কাঁটা তার।

    ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রীর আসনও একেবারে নড়বড়ে। বিদেশ মন্ত্রী জর্জ বিদোঁর সম্বন্ধে গুজব ছিলো উনি একেবারে নার্ভাস ব্রেক্ডাউনের মুখোমুখি।

    এপ্রিল মাসে তাই মহা তোরজোড় করে শুরু হলো জেনিভায় শান্তি বৈঠক। কী ভাবে মুখ বাঁচিয়ে ফ্রান্স ফিরে আসতে পারে তারই সূচনা।

    আমেরিকা, চীন, ফ্রান্স আর ব্রিটেইন - এবং অবশ্যই দুই ভিয়েতনামের প্রতিনিধি। তখন পর্যন্ত্য আমেরিকার অবস্থান ছিলো "চীন আর ভিয়েতনামকে ভালোমতন রগড়ে দিতে হবে, তখনই তারা - আমরা যা বলবো সেটা শুনেই শান্তি চুক্তিতে রাজী হবে"।

    দিয়েন বিয়েন ফু, তাদের কাছে ছিলো একটা টোপ। একেবারে ভিয়েতমিনের খাসতালুকে দুর্গ বানিয়েছি - এইবার তো গিয়াপকে আসতেই হবে মুখোমুখী লড়াইতে আর তখনই ভিয়েতমিনদের নাকটা ভালো মতন ঘষে দিলেই তখন ব্যাটারা সুড়্সুড় করে সব কিছুতেই রাজী হয়ে যাবে। দিয়েন বিয়েন ফু - তাই ফ্রান্স ও আমেরিকার কাছে ছিলো কামারের এক ঘা।

    দিয়েন বিয়েন ফু'র ফরাসী সেনারা তখনো খুব উজ্জীবিত। জেনেভাতে শান্তি বৈঠক হবে জানতে পেরে অনেকেই খুব মুষড়ে পড়লেন - তাহলে আর লড়াই চালিয়ে লাভটা কী? ভিয়েতনাম কিন্তু একমনে লড়াইএর প্রস্তুতি চালাছে, তাদের প্রচেষ্টায় কোথাও কোনো ঢিলেমি নেই।

    ফরাসীরা তখনো বুঝতে পারেন নি দিয়েন বিয়েন ফু ভিয়েতমিনদের জন্য কোনো টোপ নয়। ওটা আসলে একটা ফাঁদ। আর তাতে ধরা পড়বে ফরাসীরাই।

    লড়াই হোলো শুরু

    ফরাসী ইন্টেলিজেন্স একেবারে হুবহু খবর আনতো। কোন দিন, কোন সময়ে গিয়াপ প্রথম আক্রমন করবে সেটাও তাদের জানা ছিলো। সেই দিনটা ১৩ই মার্চ। দিয়েন বিয়েন ফু'র লড়াইএর প্রথম দিন।

    কিন্তু সেই লড়াইএর আগেই গিয়াপ খুব হিসেব কষেই হ্যানয়ের আশেপাশের যে সামরিক বিমানঘাঁটি ছিলো সেইখানে গেরিলা হানা দিতে শুরু করেছিলো। কাৎ বি'র বিমানঘাঁটিতে ৭ মার্চে ভিয়েতমিন গেরিলারা গোটা দশেক সামরিক বিমান ধ্বংস করেন। তারও আগে, গিয়া লামের বিমানঘাঁটিতেও গেরিলা হামলা চালিয়ে দশটি বিমান ধ্বংস করেন, তাছাড়া সেখানকার বিমান মেরামতির ওয়ার্কশপটিও পুড়িয়ে দেন। সুনির্দিষ্ট আগাম খবর পেয়ে ফরাসীরা তাদের, দিয়েন বিয়েন ফুর দুটি বাদ দিয়ে বাকী পনেরোটি বিমানকে নিরাপদ স্থানে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেন কিন্তু গোটা দশেক বিমান নানান কারনে দেরী করে ফেলায় রানওয়েতেই ধ্বংস হয়।

    ১১ই মার্চ থেকেই ভিয়েতমিন কামান গোলা দাগিয়ে দিয়েন বিয়েন ফুর রানওয়ে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছিলো। কোনো বিমান উঠতে বা নামতে গেলেই বিমান বিদ্ধ্বংসী বিমানের হামলার মুখে পড়ছিলো। ফলতঃ ১৩ই মার্চ, যখন মূল আক্রমন শুরু হয় - তখন দিয়েন বিয়েন ফুর রানওয়ে একেবারেই অকেজো হয়ে গেছিলো। যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত্য ফরাসীরা তাদের যাবতীয় রসদ শুধু প্যারাড্রপেই পেতো।

    যেরকম খবর পেয়েছিলো ফরাসীরা, ১৩ই মার্চ হুবহু সেই সময়েই, অর্থাৎ সন্ধ্যা পাঁচটা নাগাদ ভিয়েতমিন সেনারা পেরিমিটারের একটা ঘাঁটিতে (বিয়াট্রিস। ফরাসীরা তাঁদের সব কটি অগ্রবর্ত্তী ঘাঁটির নামই রেখেছিলেন মেয়েদের নামে!) নাগাড়ে গোলাবর্ষণ করতে লাগলেন। আগে ভাগেই ভিয়েতমিনেরা (তাদের সংগে ছিলেন বেশ কিছু চীনা "উপদেষ্টা") নিখুঁত ভাবে ফরাসীদের কামানের অবস্থান দেখে তাদের কামান ও মর্টার এর নিশানা ঠিক করে রেখেছিলেন। কিছু সেনা রাতের অন্ধকারে বুকে হেঁটে কাঁটাতারের বেড়া'র কাছ ঘেঁষে পৌঁছে জেনে নিয়েছিলেন কোথায় কোথায় রয়েছে শত্রুসেনারা। অ্যান্টেনা দেখে বুঝতে পেরেছিলেন কমান্ড পোস্ট কোনটি।

    বিয়াট্রিসে তখন ফরাসীদের "ফরেন লিজিয়ন" এর দুর্দ্ধর্ষ ৪৫০ সেনা উপস্থিত। যদিও তাঁদের জন্য অফিসার ছিলো খুবই কম। ভিয়েতমিনেরা এর আগেই রাতের অন্ধকারে গভীর ট্রেঞ্চ কেটে কাঁটাতারের বেড়ার পঞ্চাশ গজের মধ্যে চলে এসেছিলেন।

    একটানা গোলায় প্রথমেই বিদ্ধ্বস্ত হলো কমান্ড পোস্ট। চুড়মার হলো বেশীর ভাগ কামানের কুপ (Pit)। ভিয়েতমিন সেনারা তখন ঘাঁটিতে ঢুকতে শুরু করে দিয়েছে। প্রতিটি বাংকারই তখন বিচ্ছিন্ন। প্রতিটি বাংকার দখলের হাতাহাতি লড়াই চললো মাঝ রাত পর্যন্ত্য। ব্যাস। তার পরেই বিয়াট্রিস পুরোটাই ভিয়েতমিনদের দখলে চলো এলো।

    পরেরদিন সকাল বেলাই গিয়াপের দূত হাজির বিয়াট্রিসের পাশের ঘাঁটি ডমিনিকে। কিছুক্ষনের জন্য যুদ্ধবিরতি যাতে ফরাসীদের মৃত ও আহতদের সড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে। এটা মহানুভবতা তো বটেই, তাছাড়াও একটা বিরাট সাইকলজিকাল লড়াইএর চাল। এর ফলে ফরাসীদের আরো অসুবিধে হলো, আহত সেনাদের নিয়ে। তারা তো তখন সম্পুর্ণ বিচ্ছিন্ন। তিনদিক দিয়েই ঘিড়ে রয়েছে ভিয়েতমিন।

    রাতারাতি একটি দুর্ধর্ষ ঘাঁটির পতন হয়ে গেলো? কয়েক ঘন্টার লড়াইতেই? ফরাসীরা বিশ্বাসই করতে পারছিলো না।

    এর মধ্যে ফরাসী আর্টিলারি কমান্ডার পিরোথ, যিনি বলেছিলেন কোনো ভিয়েতমিন কামানই তিনটের বেশী গোলা দাগাতে পারবে না, মানসিক ভাবে এতোই বিপর্যস্ত হয়ে পড়লেন যে সেই রাতেই তিনি একটি গেনেড আঁকড়ে ধরে আত্মহত্যা করলেন।

    ফরাসীদের গত তিন চার বছরের অভিজ্ঞতায় তারা জানতেন ভিয়েতমিনেরা কামানের কোনো আধুনিক প্রযুক্তি জানেন না। রেঞ্জ ঠিক করে দ্রুত ও সঠিক নিশানায় গোলা ফেলায় তাদের তাদের কোনো পটুত্ব নেই। কিন্তু যেটা জানতেন না যে গত এক বছর ধরে চীনে একদল ভিয়েতমিন গোলন্দাজ বিশেষ ভাবে ট্রেনিং নিয়ে রীতিমতন এক্সপার্ট হয়ে উঠেছেন। এ ছাড়া চীনা সহায়কেরা তো ছিলেনই।

    আরো ৫৩ দিন চলবে এই লড়াই যতোদিন না শেষ ফরাসী সেনাও হয় হতাহত নয় বন্দী হয়ে আত্মসমর্পন না করে।

    জেনিভা ও দিয়েন বিয়েন ফু

    রণাংগন থেকে চোখ সড়িয়ে, এইবার একটু দেখে নেই আন্তর্জাতিক রঙ্গমঞ্চে তখন কী নাটক চলছে।

    এদিকে যতদিন যেতে লাগলো ততই এটা পরিষ্কার হয়ে উঠলো যে দিয়েন বিয়েন ফুর পতন আটকানো যাবে না।

    ফ্রান্সের থেকেও আমেরিকার দুশ্চিন্তা যেন বেশী। ভিয়েতনাম হাতছাড়া হয়ে গেলে প্রায় অরক্ষিত লাওস আর কাম্বোডিয়া তো ছেলের হাতের মোয়া।

    আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আইসেনহাওয়ার দ্বিতীয় বিশযুদ্ধের হীরো। তার উপদেষ্টাদের মধ্যেও যুদ্ধবাজদের সংখ্যাই বেশী। আমেরিকা বেনামে অবশ্য এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ছিলো। CIA'র বিমান বাহিনী ছিলো একটা, সে ও নিজেদের নামে নয়। তাদের বিমান ও বেশ কিছু ভাড়াটে বৈমানিক দিয়েন বিয়েন ফুতে প্যারাড্রপে সড়াসড়ি অংশ নিতো। এ ছাড়া ভিয়েতনাম ও ফিলিপাইন্সের বিমান ঘাঁটিতেও ফরাসী বিমানের মেরামত, পাইলটদের ট্রেনিং - এইসবও চালু ছিলো। আমেরিকার সরকার, বিশেষতঃ স্বয়ং প্রেসিডেন্ড ও আর সেক্রেটারি ওফ স্টেট, জে এফ ডালেস ছিলেন খুবই লড়াকু মেজাজের যাদের বলা হয় "বাজপাখি" বা hawk। তাদের স্থির বিশ্বাস ছিলো যে ভিয়েতনামের এই চটি পরা গেরিলারা সুশিক্ষিত আমেরিকান সেনাদের সামনে দাঁড়াতেই পারবে না।

    দিয়েন বিয়েন ফুর লড়াই শুরু হতেই ফ্রান্সের চীফ অফ স্টাফ জেনারেল পল এলি ওয়াশিংগটনে গিয়ে স্পষ্টই জানিয়েছিলেন আমেরিকানরা এই যুদ্ধে সামিল না হলে এই যুদ্ধ জিতবার কোনো উপায় নেই ফরাসীদের। তিনি চাইছিলেন ফিলিপাইনসের বেস থেকে অতিকায় B29 সুপারফরট্রেস বোমারু বিমান গিয়াপের সেনাদের উপর বোমা ফেলতে শুরু করুক। আরো কিছু যুদ্ধবাজ আমলা ও জেনারেল তো সোজাসুজি ছোটো ট্যাকটিকাল নিউক্লিয়ার বোমার জন্যও সুপারিশ করেছিলেন। তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের ধমক খেয়ে ঐ নিয়ে আর কথা বাড়ান নি।

    ৩রা এপ্রিল একটি গুরুত্বপুর্ণ মিটিং'এ আমেরিকান বিমান ও নৌবাহিনীর যোগদানের প্রস্তাব এসেছিলো। সে সময়ের নেতা লিন্ডন জনসন কিন্তু খুবই বিরোধী ছিলেন। "আর একটা কোরিয়া আমরা চাই না"। তিনি আরো জানতে চাইলেন আমেরিকা ছাড়া আর কোনো মিত্র দেশ কি সড়াসড়ি এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে চায়? বিশেষতঃ ব্রিটেইন? শেষ পর্যন্ত্য সিদ্ধান্ত হোলো যে আমেরিকা একা একা এই যুদ্ধে যোগ দেবে না। ব্রিটেইন বা অন্য কোনো বড় দেশকেও সামিল হতে হবে। না হলে আমেরিকা ফ্রান্সকে সাহায্য করে যাবে ঠিকই, কিন্তু যোগ দেবে না।

    আইসেনহাওয়ারও চার্চিলকে একটি পার্সোনাল চিঠি লিখলেন, খুবই আবেগময় ভাষায় চাইলেন ব্রিটেইনের মরাল ও টোকেন সাপোর্ট। চার্চিলের একেবারেই রাজী হলেন না। কোরিয়া যুদ্ধের স্মৃতি মুছতে না মুছতেই আরেক অখ্যাত এশিয়ান দেশে ব্রিটিশ কোনো সেনাই পাঠাবে না - তিনি স্পষ্ট ভাবেই জানিয়ে দিলেন। এর পরেও আমেরিকা বিভিন্ন ভাবে ব্রিটেইনের উপর চাপ সৃষ্টি করেছিলেন, কিন্তু চার্চিলকে কোনোমতেই রাজী করানো যায় নি।

    ফলাফল নিয়ে কোনো সন্দেহ আর থাকছে না। এদিকে একদল বলেন অ্যাটম বোমা ফেলতে হলে চীনের উপরেই ফেলো, অন্যদল তাঁদের ধরে বেঁধে থামিয়ে দেয়।

    স্টেট সেক্রেটারি ডালেসের কমিউনিস্ট বিদ্বেষ এতোই তীব্র ছিলো যে শান্তি বৈঠকে চীনের উপস্থিতি মানতে তিনি মোটেই রাজী হচ্ছিলেন না। অবশেষে যখন বাধ্য হলেন তখন চৌ এন লাইএর সাথে করমর্দনে ছেলেমানুষের মতন আপত্তি জানিয়েছিলেন। ফলাফলে তাকে সড়িয়ে দেওয়া হোলো।

    জেনিভায় দু দফা বৈঠক হয়েছিলো। প্রথম দফায় কোরিয়া নিয়ে আর দ্বিতীয় দফায় ইন্দোচীন (সে সময়ের ভিয়েতনামের পোষাকি নাম) নিয়ে। কিন্তু এই শান্তি বৈঠকে আমেরিকার যোগদান মানে দিয়েন বিয়েন ফুতে ফ্রান্সের শেষ আশাটিও গেলো। ইতিমধ্যে ফ্রান্সের সরকার বদল হয়েছে। ফরাসী কমিউনিস্ট পার্টির সহযোগিতায় নতুন প্রেসিডেন্ট হলেন র‌্যাডিক্যাল পার্টির নেতা পিয়েরে মেন্ডিস ফ্রাঁ। তার নির্বাচনী প্রচারের মূল ইস্যুই ছিলো ইন্দোচীনের শান্তি। সে সময়ের একটা সমীক্ষায় দেখা গেছিলো মাত্র ৭% ফরাসী জনতা এই যুদ্ধের সমর্থক ছিলেন।

    ৮ মে জেনিভায় ইন্দোচীন বৈঠক শুরু হলো। তার আগে অবশ্য প্রচুর যাত্রাপালা হয়ে গেছে, সেই বিবরণ আর লিখলাম না। ঠিক আগের দিনই দিয়েন বিয়েন ফুর লাড়াই শেষ হয়েছে - ফরাসী পক্ষের শেষ সেনানীও আত্মসমর্পণ করেছেন। এখন বিজয়ী ভিয়েতমিনদের কথাই শুনতে হবে, মানতে হবে ।

    কেল্লা ফতে

    গিয়াপের মিলিটারি তত্ত্বের একটি ছিলো লড়াই শুরুই করতে হবে একটা প্রচন্ড আঘাত দিয়ে যাতে শত্রুসেনা মানসিক ভাবে ধ্বস্ত হয়ে পড়ে। প্রতিআক্রমণের জন্য আর ক্ষমতাই থাকবে না। কামারের এক ঘা দিয়েই লড়াই শুরু।

    প্রথম দিনের ছয় ঘন্টার লড়াইতেই বিয়াত্রিস ঘাঁটির পতনের পরেই তিনি আক্রমন করলেন দ্বিতীয় ঘাঁটি গেব্রিয়েলে। এবং সেটারও পতন হলো অচিরেই। এই ঘাঁটিতে ছিলেন আলজেরিয়ান সেনারা। তারা অল্পক্ষণ লড়াই করেই স্রেফ পালিয়ে গেলেন।

    বাকী পঞ্চাশ দিনের রানিং কমেন্টারি আর দিচ্ছি না। রানওয়ের পাশেই ছিলো মূল কমান্ড পোস্ট আর তাকে ঘিড়ে এক থেকে তিন কিলোমিটার দূরত্বে সাতটি ঘাঁটি। ৩০ থেকে ৬০ মিটার উঁচু টিলা বা ছোটো পাহাড়ের উপর ঐ সব ঘাঁটি।

    গিয়াপের কাছে তো ঐ অঞ্চলে ট্র্যাকটর বা বুলডোজার ছিলো না।

    তার ভারী কামান আর অন্যান্য রসদ সবটাই হাতে হাতে টেনে ঠেলে এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে নিয়ে যেতে হতো পরের আক্রমনের জন্য। তাই তাকে নিয়মিতই একটু সময় নিতে হতো, একটানা হুড়মুড়িয়ে আক্রমন করার ক্ষমতা ছিলো না। তাই প্রথম তিনদিনের চমকপ্রদ সাফল্যের পরেই তিনি বার বারই থেমে যাচ্ছিলেন। তায় তার গোলা বারুদের স্টকও আবার গড়তে হবে।

    ইতিমধ্যে ফরাসী সেনাদল থেকে থাই, ভিয়েতনামী ও আলজেরিয়ান সেনারা অনেকাংশেই স্রেফ পালিয়ে গেলেন। কেউ কেউ ঘন জংগলের মধ্য দিয়ে গেলেন লাওসের পথে। বাকীরা ঐ দিয়েন বিয়েন ফুর আশে পাশেই বনে জংগলে লুকিয়ে থাকলেন। ফরাসীদের তো নতুন করে রসদ যা আসতো সবটাই প্যরারাড্রপ করে। যেগুলি সীমানার বাইরে পড়তো সেইখান থেকেই খুঁজে পেতে যা খাবার থাকতো সেই দিয়েই টিঁকে থাকতেন ঐ পলাতক সেনারা। ২৬শে এপ্রিল ইসাবেল ঘাঁটির আলজেরিয়ান সেনারা তো স্রেফ বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন। কিন্তু ফরাসী পক্ষে অবস্থা এতোই সঙ্গীন যে এই বিদ্রোহীদের কোনো শাস্তিও দেওয়া হয় নি।

    ১৫ থেকে ৩০শে মার্চ - এই দুই সপ্তাহ গিয়াপ কোনো বড় আক্রমন করলেন না। ছোটো ছোটো সংঘাত ও নাগাড়ে গোলাবর্ষণ করে উনি ফাঁদটা আরো টাইট করে তুললেন। দিয়েন বিয়েন ফুর সেনাপতি দে'কাস্ট্রিকে(De' Castries) শেষটায় আর বাংকার থেকে বেড়োতেন না - যুদ্ধ পরিচালনা তো দূরের কথা। তাকে সড়িয়ে দিয়ে ফরাসী প্যারা বাহিনীর নেতা কর্নেল লাঙ্গলাই (Pierre Langlai) একেবারে বিদ্রোহ করে নেতৃত্ব দখল করে নিলেন।

    ফরাসীদের ডিফেন্স পেরিমিটারও ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে। যুদ্ধের শুরুতে ছিলো বারো হাজার একর, যুদ্ধের শেষ কদিনে ফরাসীদের হাতে ছিলো দশ বারো একর মাত্র।

    তবে ফরাসীরা কিন্তু লড়াইতে ক্ষান্ত দেন নি। ওরই মধ্যে বহুবার তারা প্রতিআক্রমন ও চালিয়েছেন, বেশ কয়েকবার কিছু এলাকা আবার ছিনিয়ে নিয়েছেন। সেগুলি কোনোটাই স্থায়ী হয় নি। কিন্তু ফরাসীরাও শেষদিন পর্যন্ত্য যুদ্ধকামী ছিলেন। ভিয়েতমিন হতাহত এর সংখ্যাও অনেক বেশী। ঘাঁটি দখলের লড়াইতে যখন দুই দল মুখোমুখী এবং লড়াইটা হাতাহাতি - তখন গিয়াপের সেনাদের মধ্যে হতাহত হতেন অনেক বেশী।

    ভিয়েতমিন কামানগুলি গুহার থেকে সামান্য মুখ বাড়িয়ে গোলা ছুঁড়েই ঝটপট আবার ভিতরে ঢুকে যেতো। ফরাসীরা "কাউন্টার ব্যাটারী" অর্থাৎ বিপক্ষের কামানের ঝলকানি আর আওয়াজ হিসেব করেই রেঞ্জ ঠিক করে প্রতিআক্রমন করতে ওস্তাদ ছিলেন কিন্তু ভিয়েতমিনেরা তাদেরকে বিভ্রান্ত করতে চারিদিকে বাজী পটকা ফাটাতেন। সেই অজস্র ঝলকানি আর আওয়াজের মধ্যে কোনটি কামানের সেটা আর ফরাসীরা বুঝতে পারতো না।

    ফরাসীরা নাপাম ফেলেও খুব সুবিধা করতে পারছিলো না। দুর্ভেদ্য ঘন জংগল, নীচে কাদা মাটী আর প্রায়ই বৃষ্টিতে ভেজা ঘন জংগল নাপামের পক্ষে সুবিধাজনক ছিলো না। তারা একবার প্ল্যানও শুরু করেছিলেন যদি লাওস থেকে একটি সাহায্যকারী সৈন্যদলকে পাঠানো হয় দিয়েন বিয়েন ফুকে মুক্ত করতে। কিন্তু কিছু পরেই বুঝতে পারেন ওটি একেবারেই খোয়াব মাত্র। তবে নিয়মিত ভাবেই প্যারাট্রুপার সেনারা আকাশ পথে আসতেন অবরুদ্ধ সেনাদের সাথে যোগ দিতে।

    মার্চের শেষদিন থেকে গিয়াপ আবার বড়সড়ো হামলা শুরু করলেন। বেশ কয়েকবার হাত বদলের পর আরো কয়েকটি ঘাঁটি ভিয়েতমিনদের হাতে এলো। কিন্তু হতাহতের সংখ্যা দেখে গিয়াপ এরপর থেকে আবার যতোটা সম্ভব ট্রেঞ্চ খুঁড়ে, সুরংগ বানিয়ে ঘাঁটিগুলির খুব কাছ থেকে নাগাড়ে ছোটো ছোটো হামলা চালাতে শুরু করলেন। ৬ই মে থেকে গিয়াপের ভাঁড়ারে আরেকটা নতুন অস্ত্র হাতে এলো। সেটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কিংবদন্তী রকেট লঞ্চার - রাশিয়ান ক্যাটুসা (Katyusha)। আর গিয়াপও আবার একবার সর্বাত্মক লড়াই শুরু করলেন। ফরাসীরা কিন্তু আত্মসমর্পনের চেষ্টাও করে নি, যদিও গিয়াপের বাহিনী ক্রমাগতঃই মাইক বাজিয়ে ফরাসীদের যুদ্ধ শেষ করবার আহ্বান জানাচ্ছিলেন - ফরাসী,জার্মান আর আরবী ভাষায়। সেই অবধারিত মৃত্য, আহত বা যুদ্ধবন্দী হওয়া - এটা নিশ্চিত জেনেও - তখনও ফরাসী প্যারাট্রুপার সেনারা দিয়েন বিয়েন ফুতে আসছিলেন। ৪ মে প্রায় পাঁচশো জন প্যারা সেনারা ঐ মৃত্যুকূপে ঝাঁপ দিলেন। ওটাই শেষ। যদিও আরো সেনা প্রস্তুত ছিলো কিন্তু তখন দিয়েন বিয়েন ফুর পেরিমিটার এতোই সংকুচিত হয়ে পড়েছে সেই আকাশপথে ও আর রণাংগনে পৌঁছানো সম্ভব ছিলো না।

    ফরাসী হাই কম্যান্ডের নির্দেশ ছিলো যতক্ষন পারো লড়াই করে যাও। সাদা পতাকা তুলে আনুষ্ঠানিক ভাবে আত্মসমর্পন করা যাবে না। দিয়েন বিয়েন ফুর সেনারা লড়াইএর শেষ পর্যন্ত্য সেই নির্দেশ মেনে চলেছিলেন।

    অবশেষে ৭ই মে, ফরাসীরা যুদ্ধ ক্ষান্ত দিলেন। তবে শেষদিন ও শেষ সময় পর্যন্ত্য ফরাসীরা অশেষ বীরত্বের সাথেই যুদ্ধ চালিয়ে গেছিলেন। ৭ই মে', যুদ্ধ যেদিন শেষ হল, সেটাও কিন্তু আত্মসমর্পনের মধ্য দিয়ে ঘটে নি। ভিয়েতমিনেরা যাস্ট দখল করে নিয়েছিলো।

    শেষের পরে

    এই যুদ্ধে প্রায় বারো হাজার ফরাসী সেনা বন্দী হন - এদের মধ্যে সাড়ে চার হাজারই ছিলেন আহত। অনেকেই গুরুতর আহত। এর মধ্যে ছিলো প্রায় হাজার খানেক পলাতক সেনা। প্রায় আশিজন সেনা গ্যারিসন ছেড়ে জংগলের পথ ধরে লাওসে পৌঁছেছিলেন।

    বছর শেষ হওয়ার আগেই হাজার চারেক (৪৩%) বিদেশী সেনাদের ফেরৎ দেয় ভিয়েতমিনেরা।

    যেদিন থেকে ভিয়েতমিন আর ফরাসীদের যুদ্ধ শুরু হয়েছিলো, মানে সেই ৪৬ সাল থেকেই - সেই যুদ্ধে প্রায় চৌদ্দহাজার ভিয়েতনামী ফরাসীদের পক্ষে লড়াই করে বন্দী হন ভিয়েতমিনদের হাতে। তাঁদের ভাগ্য অতো ভালো ছিলো না। মাত্র ১০% প্রাণ নিয়ে ফিরেছিলেন। আর ভিয়েতমিনদের হতাহতের সংখ্যা এই এতো বছর পরেও সরকারী ভাবে জানায় নি ভিয়েতনাম। বেসরকারী মতে প্রায় ৮০০০ নিহত আর পনেরো হাজার আহত হন।

    না, দিয়েন বিয়েন ফু ই ফরাসীদের শেষ লড়াই নয়। আরো কিছু সংঘর্ষ হবে। উল্লেখযোগ্য হচ্ছে মাঙ্গ ইয়াঙ্গ পাসের (Mang Yang pass)লড়াই। ভিয়েতনামের মধ্যভাগে পাহাড়ী অঞ্চলে দিয়েন বিয়েন ফু'র মতনই একটি বিচ্ছিন্ন গ্যারিসন ছিলো আন খে (An Khe)অঞ্চলে। দিয়েন বিয়েন ফুর বিপর্য্যয়ের পর নির্দেশ দেওয়া হলো ঐ বিচ্ছিন্ন দুর্গ ছেড়ে দিয়ে ৮০ কিলো মিটার দূরে সুরক্ষিত অঞ্চলে চলে আসতে। কিন্তু রাস্তা তো একটাই। ভিয়েতমিন সেনারা বারবার অ্যামবুশ চালিয়ে একেবারে বিধ্বস্ত করে দিয়েছিলো ঐ কনভয়। ঐ ৮০ কিলো মিটার যেতেই কনভয়ের সময় লেগেছিলো পাঁচদিন। পথেও প্রায় সমস্ত যান বাহন, আর্টিলারি ধ্বংস হয়, নিহত'ও হন প্রায় ৫০% ফরাসী সেনা।

    আর জেনিভার শান্তি বৈঠকে দক্ষিন ও উত্তর দুই ভিয়েতনামের প্রতিনিধি - অবশ্যই হো চি মিন এবং দক্ষিন ভিয়েতনামের প্রধানমন্ত্রী নগো দিন দিয়েম - দুজনেই অখন্ড ভিয়েতমানের দাবী জানাচ্ছিলেন। দুজনেই চাইছিলেন অখন্ড ভিয়েতনাম ও তাদের নিরঙ্কুশ নেতৃত্ব। কোন সাহসে দিয়েম এই দাবী করছিলেন বোঝা মুশকিল। ফ্রেঞ্চ আর আমেরিকান সাপোর্ট ছাড়া একদিনও টিঁকে থাকার ক্ষমতা ছিলো তার?

    যাহোক, রাশিয়া আর চীন - দুই দেশই হো চি মিনকে প্রচুর চাপ দিয়ে শান্তি প্রস্তাবে রাজী করান। তিনি অবশেষে রাজী হলেন। তার ধারনা ছিলো রাষ্ট্রপুঞ্জের নির্দেশ অনুযায়ী দুই ভিয়েতনাম মিলে গনভোট হলে তিনিই জিতবেন। তবে ভিয়েতমিনেরা এটাও বলেছিলেন চৌ এন লাই আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন।

    দিয়েমকে কিছুটা হুমকি দিয়েই রাজী করানো হলো। ১৭ দ্রাঘিমায় ভাগ হবে। কারন একে তো ওটা মোটামুটিভাবে দুই ভিয়েতনামের মধ্যস্থান, তায় ঐ অঞ্চলটা মুর্গির গলার মতনই সরু। ফলে আন্তর্জাতিক বাহিনীর পক্ষে নজরদারিও সহজে হবে।

    সেই ৫৪ সালের ৯ অক্টোবরেই শেষ ফরাসী সেনারা দেশের পথে ফিরলেন। যাওয়ার আগেও তারা যতোটুকু পেরেছিলেন ভিয়েতনামে তাদের তৈরী যা কিছু ছিলো ভেঙে চূড়ে দিয়ে গিয়েছিলেন।

    পয়ষট্টি হাজার আহত ছাড়াও ফরাসীরা রেখে গেলেন প্রায় ৭৬০০০ নিহত, যাদের মধ্যে ২০৫২৪ জন ফরাসী নাগরিক, বাকীরা হয় ফরেন লিজিয়ন বা তাদের কলোনিয়াল সেনা ও সহযোগী সেনা মানে মরোক্কো, আলজেরিয়া, সেনেগাল আর থাই সেনা। এবং প্রায় ষাঠ হাজার দক্ষিন ভিয়েতনামী সেনা। উত্তর ভিয়েতমানের হতাহতের সংখ্যা এর বেশীই ছিলো। সিভিলিয়ান হতাহতের একটা আন্দাজ মতন সংখ্যা হলো লাখ চারেক। এটা অবশ্যই গত আঠেরো বছর ধরে ফরাসী ও ভিয়েতমিনদের একটানা লড়াইএর একটা হিসেব।

    আনুষ্ঠানিক ভাবে দুই ভিয়েতনাম আলাদা রাষ্ট্র হওয়ার সময় প্রায় এক মাস উন্মুক্ত ছিলো সীমান্ত। যাতে দুই দেশ থেকেই নাগরিকেরা তাদের ইচ্ছা মতন দেশ যেতে পারেন। প্রায় সম্পুর্ণ একতরফা এই দেশবদলুরা ছিলেন উত্তর থেকে দক্ষিনগামী। প্রায় দশ লক্ষ মানুষ।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Sudip Gupta | ২১ জুন ২০২১ ০৭:৫১495148
  • @ LCM


    Troop লিখতে পারি নি, Radical লিখতে পারি নি। আরো কতগুলি যুক্তাক্ষর - এখন সব কটা মনে পড়ছে না। 


    এই ভাবে যুদ্ধ চলে ?  

  • শঙ্খ | 203.99.***.*** | ২১ জুন ২০২১ ১৫:০৯495165
  • দারুণ লাগলো।

  • | ২১ জুন ২০২১ ১৮:৪৫495171
  • ক্যানো এই তো ট্র্প  র‌্যাডিক্যাল। 

  • Amit | 120.22.***.*** | ২২ জুন ২০২১ ০৬:২৪495189
  • দারুন হয়েছে লেখাটা। এর পরের পর্ব আরো আসবে নিশ্চয়. কিভাবে এরপর আমেরিকান রা ভিয়েতনাম এ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লো। একটু পাশের লাওস বা কাম্বোডিয়া ছুঁয়ে গেলে আরো ভালো.

  • উচ্চারণ | 2405:8100:8000:5ca1::361:***:*** | ২২ জুন ২০২১ ১০:১২495196
  • লেখা ভালো হয়েছে। গুগল ট্র্যান্সলেটরে গিয়ে মাইক আইকনে চাপ দিয়ে উচ্চারণগুলো শুনে নেবেন একটু । https://translate.google.com/

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। সুচিন্তিত মতামত দিন