উদায়ন পণ্ডিত যতই পাঠশালা চালু রাখতে চান না কেন, হীরক রাজা মনে করেন, "লেখাপড়া করে যে, অনাহারে মরে সে"। করোনা আবহে বঙ্গের শিক্ষাব্যবস্থাও এখন সেই পর্যায়ে পৌঁছেছে। স্কুল-কলেজ খোলা না থাকুক, বিকল্প পথে পড়াশুনা চালু রাখা যেতেই পারত। কিন্তু সরকারের অনীহা বাধ সেধেছে তাতে। প্রত্যন্ত গ্রামের স্কুলের মাধ্য়মিক বা উচ্চ মাধ্য়মিক পরীক্ষার্থীটি কোন ভরসায় পরীক্ষা দেবে, ভাবলে শিহরিত হতে হয়। গত বছর লকডাউন হওয়ার পর টানা স্কুল বন্ধ। গরমের ছুটি, পুজোর ছুটি মিলেমিশে একাকার। এখন শুধুই ছুটি। শহরের কিছু স্কুলে চক্ষু লজ্জার খাতিরে অনলাইন ক্লাস করিয়েছেন শিক্ষকরা। তবে, তাঁরা মেনে নিয়েছেন, ক্লাসের মোট ছাত্র-ছাত্রীর মাত্র ২০ শতাংশকে শিক্ষাদান করা সম্ভব হয়েছে। তাও সব পাঠক্রম সম্পূর্ণ হয়নি। আর এই হার যদি গ্রামের কোনও স্কুলে ধরা হয়, বেআব্রু হয়ে পড়বে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা।
একজন মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী কী প্রস্তুতি নিয়ে পরীক্ষা হলে যাবে? প্রথম লকডাউনে স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকা দরুন বেশ কিছুদিন পড়ুশুনা হয়নি ছাত্র-ছাত্রীদের। এরপর শিক্ষা দফতরের নির্দেশিকা আসে, অনলাইনের মাধ্যমে ক্লাস নেওয়া হবে। অনলাইনে ক্লাস মানে তো ইন্টারনেট থাকা জরুরি! সবার বাড়িতে কি ইন্টারনেট সংযোগ রয়েছে? 'ডিজিটাল ইন্ডিয়া' বলে যে হিড়িক তুলি, তা বলে কি আমরা সবাই ডিজিটাল হতে পেরেছি। জিও-র এক জিবি ইন্টারনেটে ওই ফেসবুক, ইউটিউব কিংবা জি বাংলার সিরিয়াল দেখা ছাড়া আর কি বা করা যায়?ইন্টারনেট আর অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল যাদের আছে, তাদের দিয়েই শুরু হয় অনলাইন ক্লাস। বাকিদের ক্ষেত্রে সরকার নিশ্চুপ। এরপর নির্বাচন এসে পড়ে। তড়িঘড়ি সরকারের ঘোষণা, প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীকে ট্যাব দেওয়া হবে। শেষমেশ ট্যাবের জোগান করতে না পারায় নগদ টাকা দেওয়ার ঘোষণা করা হয়। তাতেও বিপত্তি। কত জনের ঘরে সে টাকা পৌঁছেছে, সন্দেহ রয়েছে। আর যারা টাকা পেয়েছে, করোনা মহামারীতে পেটের ভাত চুরি হওয়া সন্তানরা সেই টাকা দিয়ে ট্যাব কিনবে না পেটের ক্ষিদে মেটাবে, প্রশ্ন থাকছেই। অর্থাৎ টাকা দিয়ে ক্ষান্ত হয়ে গেল সরকার। শিক্ষা যে মৌলিক অধিকার, তা সুনিশ্চিত করার দায় সরকারের ঘাড়ে বর্তাল না। আমাদের শিক্ষামন্ত্রীকে কেউ প্রশ্নও করলেন না, ওদের শিক্ষা কে দেবে? প্রাইভেট টিউটর?
নাম না করে এক বেসরকারি ইস্কুলের উদাহরণ টানছি। অভিজাত স্কুল। সাধারণত বিত্তশালী পরিবারের সন্তানরাই পড়াশুনা করে সেখানে। লকডাউন হওয়ার পর শিক্ষক-শিক্ষিকাদেরও তৎপরতা দেখা যায়। গুগল মিট বা মাইক্রোসফ্ট টিমে অনলাইন ক্লাস প্রশিক্ষণ হয় তাঁদের। নিয়ম করে প্রতিদিন ক্লাস করেছেন। এমনকী নাচ-গান, আঁকা, পিকনিক, সব আয়োজনই হয় অনলাইনের মাধ্যমে। আসলে এই উদাহরণ টেনে বলার একটাই কথা, ওই স্কুলে শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং কর্তৃপক্ষের যে উৎসাহ ও ইচ্ছাশক্তি প্রশংসনীয়। কিন্তু সরকারি স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে যেমন মাথাব্যাথা নেই সরকারের, তেমন অধিকাংশ শিক্ষক-শিক্ষিকাদের। মাইনে বাড়ানোর জন্য মাসের পর মাস শিক্ষক-শিক্ষিকারা অনশন করতে পারেন, কিন্তু না পড়িয়ে মাসের পর মাস মাইনে নিতে কুণ্ঠাবোধ হয় না। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের বিরুদ্ধে এমন কথা বলতে রুচিতে বাধলেও বাস্তবে তা সত্যি।
লকডাউন হওয়ার পর সরকার কিছুটা সময় পেয়েছিল ধাতস্থ হওয়ার। একদিকে বিপুল সংখ্যার পরিযায়ী শ্রমিকের ঘরে ফেরা, অন্যদিকে বাড়ন্ত করোনার প্রকোপ কমানো- এই দুই পরিস্থিতি মোকাবিলা করা সরকারের কাছে যথেষ্ট চ্যালেঞ্জ ছিল। তা বলে রাষ্ট্র একমুখী হতে পারে। তাকে ভাবতে হয় পরিবারের সব সদস্যের কথা। কঙ্কালসার স্বাস্থ্যব্যবস্থার তালিতাপ্পা দিতে গিয়ে অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো শিক্ষাব্যবস্থাও অবহেলিত হয়ে পড়েছে। বলা ভাল, তলানিতে ঠেকেছে। ছাত্র-ছাত্রীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে এভাবে ছিনিমিনি খেলা এই গণতন্ত্র পরিকাঠামোয় রাষ্ট্রের আদৌ অধিকার আছে কিনা প্রশ্ন ওঠে। করোনা মহামারী মোকাবিলা করা স্বাস্থ্য দফতরের কাজ। যার মাথার উপর রয়েছেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী। বাকি বিষয় সামলানোর জন্য তো আরও অন্যান্য দফতর রয়েছে। তার মন্ত্রীও রয়েছে। প্রতি বছর যে মন্ত্রী এসএসসি পরীক্ষা সঠিকভাবে করাতে পারেন না, এমন অভাবনীয় সময়ে এই অভূতপর্ব কাজটা তাঁর পক্ষে করা সম্ভব নয়। গত পাঁচ বছরে নিজেই তার প্রমাণ দিয়েছেন।