জনপ্রিয় এই গান টি শোনেননি এমন বাঙালি পাবেন না। "এই পথ যদি না শেষ হয় তবে কেমন হতো তুমি বোলো তো" সুন্দর এই পৃথিবীতে, মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে, যারা লম্বা হাঁটতে ভালোবাসেন বা যারা ট্রেকিংই যান, তাদের উত্তর যে "ভালোই হতো" হবে এটা বলাই বাহুল্য। সুগস্পিৎজে ট্রেকিং এর শুরুতে আমাদের ও ঠিক তাই মনে হয়েছিল কিন্তু পরের দিকে আমাদের দলের মধ্যে কারো কারো হয়তো মনে হচ্ছিলো "কতদূর আর কতদূর বলো মা"।
আসুন দলের সাথে পরিচয় টা আগে করে দি, চার জনের টীম, চারমূর্তি। আমি, আমার স্ত্রী, আমাদের পুত্র ও কন্যা। এমনিতে বছরে দু থেকে তিনবার আমরা এদিক ওদিক বেরিয়ে পড়ি, যার মধ্যে ছোট খাটো হলেও একটা ট্রেকিং রুট থাকে। ট্রেকিং টা একটা নেশার মতো হয়ে গেছিলো। গতবছর শুরুর দিকে কোরোনার বিধিনিষেধ এর জন্য বাইরে বেরোনোর মতো পরিস্থিতি ছিল না, আর মানসিক ভাবেও তৈরী ছিলাম না, কিন্তু সামার ভ্যাকেশন এর সময় থেকে বিধিনিষেধ, কড়াকড়ি একটু আধটু যখন শিথিল হলো তখন আমার কন্যা মুন্নি ট্রেকিং এ যাবার প্রস্তাব নিয়ে এলো, আমি শোনা মাত্র না করে দিয়েছিলাম। কিন্তু তারপর ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করে দেখলাম, আমরা তবুও প্রতিদিন অফিস এ যাচ্ছি, কিন্তু ওরা প্রায় ছয় মাস ঘরবন্দি, ইউনিভার্সিটি বন্ধ, বন্ধু-বান্ধবদের সাথেও কোনো দেখা সাক্ষাৎ নেই।কতদিনে যে পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে তাও কেউ জানে না। তাই ওদের কথা ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম যাবো কিন্তু বেশি ভিড় হয় এমন রুটে যাবো না। মুন্নি অনেক খুঁজে সুগস্পিৎজে ট্রেকিং রুট বার করলো যেখানে ভিড় অন্য রুট এর তুলনায় কম কিন্তু ২৯৬২ মিটার এই রুটে ট্রেকিং করা বেশ শক্ত, শুধু মাত্র ট্রেনড ট্রেকার আর পর্বতারোহীদের জন্য এই ট্রেকিং রুট প্রস্তাবিত। মনের মধ্যে সংশয় থাকলেও আলপাইন প্রাকৃতিক দৃশ্যের রোম্যান্স উপভোগ করার এক অজানা আনন্দে, এই রুটেই যাবার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম।
২৯৬২ মিটার সুগস্পিৎজ জার্মানির সর্বোচ্চ পর্বত, আল্পসের অন্যতম বিখ্যাত পর্বতস্থান। বাভেরিয়ান (মিউনিখ) শহর "গার্মিশ-পার্টেনকির্চেন" থেকে সুগস্পিৎজ-ট্রেন এ করে "আইব সে" অব্দি এসে তারপর "আইব সে" থেকে কেবেল কার এ করে সহজেই সুগস্পিৎজ আরোহণ করা যায়। এই রুটে আমরা আগে দু বার সুগস্পিৎজ গিয়েছিলাম, এই রুটের আলপাইন প্রাকৃতিক দৃশ্য এতোই সুন্দর, যে সেই সুন্দরকে বর্ণনা করার জন্য লেখার ভাষা আমার নেই। তাই যেদিন এই রুটে ট্রেকিং করতে যাবার সিদ্ধান্ত পাকা হলো সেদিন থেকে মনের মধ্যে একটা আলাদা উত্তেজনা তৈরি হলো, অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষিত দিনটির অপেক্ষায় রইলাম।
সুগস্পিৎজ যাওয়ার প্ল্যান তো হলো, এবার খুব তাড়াতাড়ি সমস্ত বুকিং গুলো করে ফেলতে হবে, এমনিতেই সামার এর সময় হোটেল/গেস্টহাউস এ জায়গা পাওয়া বেশ মুশকিল, তার ওপর কোভিড ১৯ এর কারণে অনেক হোটেল বন্ধ। বাস বা ট্রেনের বুকিং এর ঝামেলা নেই কারণ গাড়িতে যাবো, দূরত্ব ৬৫০ কিলোমিটার এর মতো। ট্রেকিং এর প্ল্যান ছিল সেপ্টেম্বর এর ১০ তারিখ, আমরা একদিন আগে ৯ই থেকে ১১ ই সেপ্টেম্বর অব্দি বাভারিয়ার ফুজেন শহরে একটা হোটেল বুক করলাম। ফুজেন শহর থেকে গার্মিশ-পার্টেনকির্চেন, যেখান থেকে আমরা ট্রেকিং শুরু করবো তার দূরত্ব ৬০ কিলোমিটার কিন্তু আমরা ইচ্ছা করেই ট্রেকিং এর আগের দিনের সন্ধ্যে টা ফুজেন শহরে কাটাবো ঠিক করেছিলাম।
ফ্রান্সের দক্ষিণে অস্ট্রিয়া সীমান্তবর্তী আল্পসের কোলে বাভারিয়ার একটি ছোট্ট শহর ফুজেন। এমনিতেই বাভারিয়ার রাজ্যের প্রত্যেকটি শহর ছবির মতো সাজানো, সুন্দর কিন্তু ফুজেন যেন তাদের মধ্যে অপরূপা, এক অনন্যা সুন্দরী, বিশেষ করে রাতের আলোর স্নিগ্ধতা তার সৌন্দর্য কে আরো মোহময়ী করে তোলে।
এবার আমাদের ট্রেকিং রুট টার ব্যাপারে একটু বলে নি। আমাদের স্টার্টিং পয়েন্ট গার্মিশ-পার্টেনকির্চেন শহরের পার্টনাচক্লাম, আর এন্ড পয়েন্ট সুগস্পিৎজ সামিট। মোট ২১ কিলোমিটার ট্রেকিং রুট, খুব ট্রেনড হাইকার দের জন্য ৯ থেকে ১০ ঘন্টা সময় ধরা হয়। এই রুটের মধ্যে এমনি কোনো দোকানদানি বা গ্রাম নেই কিন্তু মোট তিনটি লজ বা সরাইখানা পড়বে যেগুলোর নাম ব্লকহুইটে, রাইনটাল আঙ্গারহুইটে এবং কনরহুইটে। এই পাহাড়ি লজ গুলোকে জার্মানি তে হুইটে বল। এই হুইটেগুলো গ্রামের দিকের ছোট হোটেল এর মতো। এখানে খাবার, পানীয় পাওয়া যায়, টয়লেট আর স্নান করার জায়গা আছে, রেস্ট নেওয়া যায় আবার রাত্রিতে থাকার ও ব্যবস্থা আছে। আর একটা খুব দরকারি পয়েন্ট হলো এন্ড পয়েন্ট এ অবশ্যই বিকাল ৪ টের মধ্যে পৌঁছতে হবে, তবেই সুগস্পিৎজ থেকে শেষ কেবেল কার ধরে নিচে গার্মিশ-পার্টেনকির্চেন এ নামা যাবে।
যেহেতু আমরা একদিনে ট্রেকিং শেষ করতে পারবো না তাই রুটের মাঝামাঝি রাইনটাল-আঙ্গারহুইটে তে রাত্রিতে থাকার জন্য ঘরের সন্ধান করলাম (৯০% হাইকার রা এটাই করেন)। ভাগ্য কিছুটা ভালো থাকায় ডবল বেড রুম না পেলেও ডর্মিটরি তে চার জনের শোবার জায়গা তখনও খালি ছিল, একটুও দেরি না করে অনলাইন এ ডর্মিটরি তে চারটি শোবার জায়গা বুকিং করে ফেললাম। রাইনটাল-আঙ্গারহুইটে অনলাইন বুকিং সাইট https://www.alpenverein-muenchen-oberland.de/huetten/alpenvereinshuetten/reintalangerhuette
বুকিং গুলো কমপ্লিট করে স্বস্তির নিঃশাস ফেললাম, এবার যাওয়া তাহলে হচ্ছেই হচ্ছে। দেখতে দেখতে ৫ ই সেপ্টেম্বর এসে গেলো। লিস্ট আগে থেকে তৈরি ছিল। লিস্ট দেখে ড্রাই ফুড যা কেনার ছিল কিনে নিলাম, গাড়ি ক্লিন করে, ওয়াশিং করে, পেট্রল ফুল লোড করে নিলাম। সেলার থেকে সবার ট্রেকিং সু, স্লিপিং ব্যাগ আর ট্রেকিং স্টিক গুলো নিয়ে গাড়িতে রাখলাম। ৮ ই সেপ্টেম্বর রাত্রি তে যে যার রুকসাক এ রেইন-জ্যাকেট, ট্রেকিং প্যান্ট (বাতাস প্রবাহিত হবে কিন্তু বৃষ্টি তে ভিজবে না), গরম মোজা, ঠান্ডার টুপি, হাত মোজা, মাফলার, ছোট কম্বল, টর্চলাইট, সামান্য জামাকাপড় আর কিছু টুকিটাকি জিনিস যেগুলো প্রতিদিন লাগে সেসব গুছিয়ে নিলাম।
পরের দিন ৯ ই সেপ্টেম্বর ঠিক ভোর ৫ টায় আমরা ফুজেন এর উদ্যেশ্যে রওনা দিলাম। আমরা যে শহরে থাকি সেখানে সেপ্টেম্বর মাসে টেম্পারেচার ১১ - ১৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস এর মধ্যে ঘোরাফেরা করে কিন্তু সুগস্পিৎজ এর মতো পাহাড়ি জায়গায় ঠান্ডা টা এই সময় বেশি অনুভব করা যায় তার ওপর যদি বৃষ্টি হয় তাহলে ঠান্ডার সাথে শীতল বাতাস বইতে থাকে। তাই এই ট্রেকিং রুটে গেলে ঠান্ডা আর বৃষ্টির জন্য পুরোপুরি তৈরি হয়ে যাওয়া ভালো।
৩০০ কিলোমিটার গাড়ি চালানোর পর হাইডেলবার্গ শহরে একটা ব্রেক নিলাম। হাইডেলবার্গ আমার খুব প্রিয় শহরের মধ্যে একটা। এই শহরের কেল্লা টা ভীষণ সুন্দর। ১৬০০ শতাব্দীর রোমান সভ্যতার এক অনবদ্য স্থাপত্ব। এই কেল্লার মধ্যে প্রায় দুই ঘন্টা কাটালাম। লুচি, আলুরদম খাওয়া হলো, একটা বড়ো কাপের এক কাপ কফি পান করে গন্তব্যের দিকে আবার যাত্রা শুরু করলাম।
ঠিক আড়াই টার সময় ফুজেন এ পৌঁছলাম। আল্পস পাহাড়ে ঘেরা এই ছোট্ট শহরটায় ঢুকলেই মনটা এক অনাবিল আনন্দে ভোরে ওঠে। গাড়ি পার্ক করে, তিন টের সময় হোটেল এ চেক-ইন করলাম। হোটেলে লাগেজ রেখে, ঘন্টা দুয়েক রেস্ট নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। শহরটা আমাদের চেনা, আমাদের আগে থেকেই ঠিক করা ছিল আমরা বাকি দিনটা লেচ নদীর ধারে কাটাবো। হিসাব মতোই লেচ নদীর তীরে পৌঁছে এক মনোরম পরিবেশে কম্বল পেতে বসে পরলাম। আমাদের ঠিক সামনেই নদীর আর এক দিকে প্রতিবেশী দেশ অস্ট্রিয়া, যা পায়ে হেঁটে অনায়াসেই চলে যাওয়া যায়, বর্ডার বলে কিছু নেই, নেই কোনো চেকপোস্টও।
আস্তে আস্তে সূর্যের পড়ন্ত আলোয় আল্পস পাহাড়ের মাথাগুলো যখন সোনার মতো চকচক করছিলো আর তার পূর্ণ প্রকাশ পড়েছিল লেচ এর জলে, হঠাৎ আমার মন টা চলে গেলো ২২ বছর আগের ঠিক এরকম ই এক গোধূলি বেলায়। সেদিন বসেছিলাম কেদারনাথ যাওয়ার পথে রুদ্রপ্রয়াগে, হিমালয়ের পাদদেশে, মন্দাকিনীর পাশে। হিমালয়ের মাথায় ও সেদিন সোনার রঙে রেঙে উঠেছিল। আজ যেন আল্পস-হিমালয় সব মিলেমিশে একাকার হয়ে গেলো। এই অনুভূতি সত্যি ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব, এ শুধু আমার হৃদয়ের গভীরের আনন্দের স্পন্দন।
চলবে .....
অজয় মিত্র