এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • উচ্ছিষ্ট মানুষ 

    Uttam Kr Purkait লেখকের গ্রাহক হোন
    ০৯ মে ২০২১ | ১৫৩৩ বার পঠিত
  • বাস থেকে নামতেই চারপাশটা গুমোট দেখায়। কী যে ভীমরতি চাপে আকাশটার। সুন্দরী বউয়ের গুঁতো খেলে অনেক পুরুষকে এমন দেখায়। কুশলের বড্ড ভয় করে।
    আজ সাধনাদের বাড়ি যেতে হলো। ক'দিন মেয়েটা অফিস যাচ্ছে না। জ্বর। খবরটা শুনে কুশল স্বস্তিতে ছিল না। বুকে একটা চিনচিনে ব্যথা। অনেকবার চেষ্টা করেও মোবাইলে পাওয়া গেল না। টেনশানে নিজের রুমে অনেকক্ষণ পায়চারি করল সে। কলিগরা কী বুঝল কে জানে! আড়ালে-আবডালে হাসে। সুযোগ পেলে দু-একটা চুটকি ঝাড়ে। কুশল অবশ্য এসব গায়ে মাখে না। সবাই কী না ভাবে! তবু সাধনা ছাড়া চলে না। ক্লার্ক হয়েও তার অনেক অসুবিধায় পাশে আসে মেয়েটা। বড় চৌখস। বোকা কুশলের দুর্বলতা বোঝে। অফিসিয়াল কাজে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে অপদস্থ হওয়া থেকে কতবার বাঁচিয়ে দিয়েছে। কাজটা দায়িত্বের সঙ্গে চটপট করে মেয়েটা। আর এভাবে দয়াময়ীর মতো তার জীবনে ঢুকে গেছে সাধনা। সাত-পাঁচ এগোনোর আগে কুশলকে তার বুদ্ধি নিতেই হয়। কোনো টিপ্পনীকে গ্রাহ্য করে না সে। তার একটাই ভয়। কোনোদিন বাড়িতে না পৌঁছায় খবরটা।
    প্রমোশন নিয়ে কলকাতায় ট্রান্সফার হয়ে আসার পর যেন যত বিপত্তি। একদিকে সাধনা, আরেকদিকে রুনা। ছেলেটার জন্য আজকাল প্রায় কাঁদে মেয়েটা। অনেক অনুযোগ করে। তাই এখন তাকে সপ্তাহে বাড়ি ফিরতে হয়। রবিবার বাড়ি কাটিয়ে সোমবার ভোরে তাকে রওনা দিতে হয়। বিয়ের পর থেকে রুনা কোনোদিন তাকে বোঝেনি। আত্মীয়-পরিজন ছেড়ে মেসে থাকার এই কষ্টকর জীবনে সাধনা একমাত্র তার জীবনে বসন্তের ঝিরঝিরে হাওয়া।

    আজ টিফিন টাইমে অফিস থেকে বেরিয়েছে কুশল। সাধনার বাড়ি হয়ে ফিরতে সন্ধ্যা। গ্রামে ঢুকতেই পশ্চিম দিকটা সিং তাড়া মোষের মতো ফুঁসিয়ে ওঠে। সেই সঙ্গে উদমবসনা ঝড়। পড়ি কি মরি করে গ্রামের বাচ্চাগুলো ছুটছে। মনটা ভরে যায় কুশলের। বৃষ্টির কয়েকটা ফোঁটায় বেশ আরাম লাগে। একটু দাঁড়ায়। চারপাশটা দেখে। সামনের বারান্দায় হারা বুড়োর বিধবা। বিন্দি। এক কালের বিন্দি এখন নোংরা শতচ্ছিন্ন কাপড়ের ঢুলঢুলে বুড়ি। যখন বাড়ি ফেরে, এভাবে লাঠি হাতে বসে থাকতে দেখে। দু'চোখ কানা। বেচারা।
    কুশল চোখ ফিরিয়ে দ্রুত হাঁটে। চারপাশে তাকায়। গ্রামটাকে দেখলে আজকাল এই বুড়িটা তার ভাবের ঘরে চলে আসে! অথচ আগে গ্রামটা বিন্দিটার মতো এমন শতচ্ছিন্ন ছিল না। বেশ গাছগাছালি, পুকুর-ডোবাতে ভরা ছায়াকুঞ্জ ছিল। এখন ম্যাড়মেড়ে। মাটির সঙ্গে যেন গাছপালার সম্পর্ক নেই। যেমন সম্পর্ক নেই বিন্দি বুড়ির সঙ্গে তার দামড়া ছেলের।
    বিন্দি বুড়ির ভাবনায় কখন যেন চলে আসে রুনা। আধুনিকা গরবিনীদের মতো আর চকচকে দেখায় না বউটাকে। কোথায় যেন একটা বদল ঘটেছে।
    অস্বস্তি এড়াতে চোখ মেলে উপরে তাকায় কুশল। টিপটিপ ফোঁটায় জীবনের গ্লানি যদি দূর হত। সাধনাটা তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে যাক। বড় ভালো মনের মেয়ে। কেন যে ওর বর ওকে ডিভোর্স দিয়েছিল!
    বাড়িতে ঢুকতেই রুনা মন খারাপের চোখে তাকায়। কুশল হাসার চেষ্টা করে। রুনা স্থির চোখে চেয়ে থাকে। একটু পরে বলে, আজকাল এত দেরি হয় কেন?
    কোনো জবাব দেয় না কুশল। রুনা কি সন্দেহ করে? সাধনার ব্যাপারে কি কেউ ইনফর্ম করতে পারে? ঘরে ঢুকে জামাপ্যান্ট ছেড়ে গামছাটা কোমরে গুঁজে নেয়। বাথরুমে ঢোকে। ছ'দিন মেসে থাকার কষ্টকর জীবন কাটিয়ে ঘরে ফিরলেও বউয়ের সন্দেহে সে ভুল দেখে না। তাই কোনো অজুহাত খাড়া করার মিথ্যা চেষ্টায় সে থাকে না। ধরা পড়লে একদিন হয়তো গড়গড় করে বলে দেবে সব। বড় বোকা সে।
    গা-হাত ধুয়ে ঘরে ঢুকে আলনা থেকে চুপচাপ লুঙ্গিটা খুঁজে নেয় কুশল। চেয়ারে বসে। টেবিলের উপর থেকে চায়ের কাপটা নেয়।
    রুনা এসে ঘরে ঢোকে। জানলার দিকে চোখ ফিরিয়ে নিস্পৃহ কুশল একাকী বলে, বাবাইকে দেখছি না যে?
    বন্ধুর দিদির বিয়ে, আজ ফিরবে না।
    ছেলেটা বড় হয়েছে। খুব তাড়াতাড়ি ফুর্তির মগডালে পৌঁছে গেছে। কুশল তার আঠারোতে এমন জীবন পায়নি। তাই এই পঁয়তাল্লিশেও তার হাহাকার। কেউ বুঝল না মনের কাঙালপনা।
    ছেলেটাকে ভীষণ প্রশ্রয় দিয়েছে রুনা। যখন যা চেয়েছে মায়ের কাছ থেকে তাই পেয়েছে। কুশল আপত্তি করলে তাকে হাঁকিয়ে দিয়েছে। এখন মনে হয়, ছেলেটা একটু কষ্টে মানুষ হলে ভালো হত। জীবনে দাঁড়ানোর লড়াইটা রপ্ত করতে পারত।
    কুশলের ভয় হয়। সে কোনোদিন ছেলেটার খুব কাছে পৌঁছাতে পারেনি। ছেলেটাও শেখেনি কাছে আসা। আসলেও কত যেন দূরে। মাঝে বিরাট নদী। কোনো সেতু নেই। রুনা চায়নি সেই সেতুর নির্মাণ।
    হীনমন্যতায় ভোগে কুশল। কবে যে তার বয়স হয়েছে, সবার অপছন্দের হয়েছে, বুঝতেই পারেনি। যেদিন প্রথম জানল রুনা তার কলেজ জীবনের সহপাঠী অমিত দাসকে নিয়ে দীঘায়, সেদিন নিজেকে দেখল সে।
    রুনাকে দোষারোপ করতে গিয়ে মনের মধ্যে সতর্ক হয় কুশল। আর মুহূর্তে একটা অবৈধ গোপন আনন্দে ভিতরটা শিরশির করে। সাধনা যেন চিরকাল অপ্রকাশিত থাকে। রুনার দৃষ্টি যে বড় অন্তর্ভেদী, এমনকি ছেলের। অমিত দাসের কথা সে-ই তো বলেছে বাবাকে।
    ছেলের জন্য চিন্তা হয় বড়। পড়াশোনা করে না। শুধু ঘোরাঘুরি। দুদিন পরে দার্জিলিং প্রোগ্রাম। তিন হাজার টাকা চেয়েছে।
    কুশল চমকায়। তার কিছু বলার নেই। ছেলের প্রতি মায়ের প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় সে টের পায়। কিছু বললেই কথা কাটবে, তারপর তুলকালামে পৌঁছাবে। শেষমেশ কুশলের পৌরুষে ঘা দেবে।
    চায়ের কাপে চুমুক দিলেও বুকের ভিতরটা ক্রমশ পাথর হতে থাকে। কার জন্য এই অপছন্দের ঘেরাটোপে আসতে হয় কুশলকে। সপ্তাহে অন্তত একদিন সে বউটার সান্নিধ্য পেতে চেয়েছিল, ছেলেটারও। কিছুই পাওয়া হয়নি। অথচ তাকে আসতে হয়। না পাওয়ার অভ্যাসটাকে রপ্ত করতে হয়।
    জানলার পর্দাগুলো নামিয়ে দিয়ে রুনা বেরিয়ে যায়। কুশল চেয়ে থাকে চলমান দুর্বোধ্য ছায়াটার দিকে। বড় হতাশ লাগে। দারিদ্র্যের গণ্ডি থেকে বের হতে গিয়ে সে টাকা টাকা করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কী পেল? ভাবলে শিউরে ওঠে। তার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে অনেকটা টাকা আছে। সবটা ছেলেকে ভেবে। একটা মাত্র ছেলে। লড়াইয়ে ঠেলে দেওয়ার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু আজ বোঝে ছেলেটাকে বাঁচার বিপ্লবে ঠেলে দিলে তার বুকটা গর্বে ভরে যেত। ও যদি অপদার্থ হয় রুনার সঙ্গে কুশলও দায়ী।
    চায়ের কাপ শেষ করে উপরে অপলক চেয়ে থাকে। সিলিংয়ে ঝুলে থাকা টিকটিকিটার দিকে চোখ পড়তেই ঝিম মেরে যায়। উত্তরাধিকারীর একটাই উত্তরাধিকার থাকলে কি হত না? মানুষ হওয়া। ওই সুখ, আরাম ভূতেদের জন্য।
    মনটা কিছুতেই স্থির হয় না। উঠে দাঁড়ায় কুশল। বাইরে এখন কুলকুল গর্জন। জানলার কাছে যায়। পর্দা সরিয়ে দুটো হাত বাড়াতে শীতল হয় ভিতরটা। নিকষ কালো অন্ধকারে দুটো হাতের চৌম্বকীয় টানে ভিজতে থাকে তার অন্তঃপুর। সাধনার চোখের জলে যেভাবে ভেজে আজকাল।
    কুশল হাত দুটো টেনে নেয়। টিউব লাইটের আলোয় দেখে বিন্দু বিন্দু ফোঁটা। মুখে মাখে। মুহূর্তে বিদ্যুতের আলোয় ঝলসে যায়। কেঁপে ওঠে কুশল। বয়সটা আর থামার নয়। আশ্রয় নেওয়ার সময় হয়ে আসছে। সসম্মানে। কিন্তু কার কাছে? সাধনা? রুনা? না একমাত্র সন্তান বাবাই?
    ব্যাঙগুলো ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর ডেকে যায়। টিকটিকিটা অনেকক্ষণ পরে টিক টিক করে। টাকা কম নয় কুশলের। বেঁচে থাকার পক্ষে যথেষ্ট। কিন্তু সম্মান, প্রেম-ভালোবাসা, মর্যাদা কি টাকার গন্ধে লেজ নাড়তে নাড়তে চলে আসে? অক্ষম মানুষকে কে দেবে এসব? না দিলেই বা কী করার আছে? ভিতরটা বাইরের ঝড়ের মতো আছাড়ি-পিছাড়ি খায়।
    টিউব লাইটের আলোটা নিভে যায়। গাঢ় অন্ধকার ছেঁকে ধরে কুশলকে। নিভৃতে চলে আসে সাধনা। পরকীয় টানে কুশল উথালপাতাল। বিদ্যুতের চমক। সারাটা আকাশ সাধনার গভীরতর চোখের মতো হৃদয়কে এফোঁড়-ওফোঁড় করে। মাথাটা দুলতে থাকে।
    ঠিক কাঁটায় কাঁটায় খাওয়ার ডাক পড়ে। কাজের মেয়েটা ডেকে যায়। কুশল গ্রাহ্য করে না। বৃষ্টি ভেজা মন এখন বিমোহিত বাইরের কুলকুল শব্দে। ওপার থেকে আবার ডাক আসে। শূন্যেন্দ্রিয় কুশল নিষ্প্রাণ যন্ত্রের মতো এগিয়ে চলে। ডিনারের টেবিলে আজকাল কেউ অপেক্ষা করে না। তবু কাজের লোকের গলায় ডাকটা ভাসে।
    জীবনে দাঁড়ানোর দিনগুলো খারাপ ছিল না। মাটির রান্নাঘরের পিছনে মানকচুর ডগায় বৃষ্টির টিপটিপ ডাক। তালপাতার আসনে বসে আলুসেদ্ধ, গরম ভাত। আজ অনেক কিছুই অস্পৃশ্য। চাকরি পাওয়ার পর যখন তার টাকা হলো, পাকা বাড়ি হলো, বাড়িতে সুন্দরী বউ এল, তখন থেকেই মাটির গন্ধটা তার থেকে দূরে সরে গেল।
    কী হয়েছে বলো তো, যন্ত্রের মতো বসে আছ? রুনার মৃদু ধমকে বৃষ্টির কল কল উচ্ছ্বাস ছলাৎ শব্দে ভাঙচুর। প্লেট থেকে একটা রুটি নিয়ে মুখে তোলে কুশল। দাঁতে ছেঁড়ে। রুনা খাওয়া শেষ করে উঠে যায়।

    রাত বারোটা। বিছানায় পড়ে থাকে কুশল। ঘুম আসে না। এক সপ্তাহ পরেও ছেলেটাকে খাওয়ার টেবিলে পাওয়া গেল না। খাওয়ার কি রুচি থাকে?
    চকিতে খুট করে আওয়াজ হয়। কুশল চমকায়। রুনা। ভয় পায় সে। অনেকদিন পরে কী উদ্দেশ্যে এ-ঘরে এসেছে মেয়েটা!
    রুনা দরজা বন্ধ করে। কুশলের শরীরের সব রক্তকণা বরফের মতো জমাট বাঁধে। মেয়েটা এসময়ে অনেকদিন এ-ঘরে ঢোকে না। কী হলো? পাঁশটে মুখে কুশল চেয়ে থাকে। পারফিউমের গন্ধ ভেসে আসে। হতবিহ্বল কুশল দিশেহারা। শিকারির মতো লালায়িত চোখে ফাঁদ ঘেঁষে বসে রুনা। সুন্দরী অথচ নিষ্ঠুর। অস্ফুটে সে বলে, কী ব্যাপার?
    দেখতে পাচ্ছ না? কাট-কাট কথাগুলো বলে মিষ্টি করে হাসার চেষ্টা করে রুনা। দু'চোখে মায়াবী রোশনাই। আদুরে বেড়ালের মতো গা ঘেঁষে।
    কতদিন তুমি আমার কাছে আসো না। কতদিন আমাদের...
    কুশল দীর্ঘশ্বাস ফেলে। রুনার সঙ্গে কুশলের ভালোবাসা অথবা পাগলামি এখন যুগান্তরের। তাই মেয়েটা আড়ষ্ট। উচ্চারণে অনেক কিছুই উহ্য।
    তবু তার বুক ঢিব-ঢিব করে। কী করা উচিত? রুনাকে তাড়ানোর সাধ্য তো তার নেই।
    রুনা দু'হাতে টেনে নেয় তাকে। কুশলের সারাটা শরীর অবশ হয়ে যায়। বাইরে ব্যাঙের ডাক। বৃষ্টির ফোঁটা বেসুরো লাগতে থাকে। তড়িতে রুনা খাট থেকে নামে। নখের স্পর্শে ছপাছপ খুলে ফেলে অন্তর্বাস। প্রায় দেড় দশক পরে সম্পূর্ণ নগ্ন এক নারী। কত বয়স! রক্ত চোখে চেয়ে থেকে কুশল। সাঁইত্রিশ। অমিত দাস কি নেই আর?
    পেখম পেখম শরীর নিয়ে খাটে উঠে আসে রুনা। এখনো দেহের কানায় চোখ ধাঁধানো রূপ। কুশল কি পাল্টি খাবে?
    রুনা কুশলকে চেপে ধরে। বন্য সিংহীর মতো। দু'চোখে আগুন। কুশলের স্নায়ুতন্ত্রীতে মোচড় দিতে তার অসুবিধা হয় না। তাকে নিরাবরণ করে। নরম শরীরে জাপ্টে ধরে। সুডৌল দুই স্তন ঢেউয়ে ঢেউয়ে নেচে ওঠে। বরবুক কুশলকে খেলায় রুনা। সরীসৃপের মতো আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধে। উত্তাল নদীর মতো ওলটপালট করে দেয়। তৃপ্তির ফোয়ারায় নিজেকে ভিজিয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। উদ্ধত শরীরে কাপড়টা পেঁচিয়ে বেরিয়ে পড়ে রুনা।
    কুশলের মনে হয় সে রুনার কাছে ধর্ষিত হয়েছে চিরকাল। থিতিয়ে যাওয়া শরীরটা ঘেন্নায় রি-রি করে। সিগারেটের প্যাকেট খোঁজে।
    ঘুম ভাঙে ঠিক সকাল আটটায়। নাইলনের মশারী ফুটে সকালের সোনা। অপলক চেয়ে থাকে। একঘেয়ে জীবনে নতুন করে কি ছন্দ আসবে সকালের সূর্যের মতো?
    দরজায় দাঁড়িয়েছে রুনা। তৃপ্ত, গর্বিত নারীকে কেন যে সুন্দর লাগে না কুশলের! পুত্রস্নেহে আচ্ছন্ন মেয়েটা হঠাৎ কেন যে স্বামী-সান্নিধ্য চাইল কাল! ভেবে মনটা পাথর হয়ে যায়।
    উলটপুরাণ চোখে তাকায় রুনা, উঠবে না?
    মায়াবী চোখের দুই মণির কাছে হার মানে কুশল। উঠে বসে। রুনার দুই চোখ থেকে দৃষ্টি নামায়। সাধনার কথা রুনা জানতে পারলে প্রলয় বইবে না তো?
    বাথরুম সেরে, সকালের চা খেয়ে বালতি আর কোদাল হাতে পুকুরপাড়ের শখের বাগানে যায় কুশল। তার সাধের বাড়িতে আভিজাত্যের রং এলেও নিজেকে সেই মোড়ক থেকে প্রাণপণে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছে সে। ছুটির দিনগুলোতে এইভাবে সে নিজেকে ভুলে থাকতে চায়। ফুলবাগান বড় প্রিয় তার। নির্মল করে দেয় সব বাসি, পচা, দুর্গন্ধকে।
    কোদাল দিয়ে সে গাছগুলোর গোড়া খোসে। পুকুর থেকে জল তুলে যত্ন করে গোড়ায় দেয়। তাদের শরীর ভেজায়। এভাবে ঘন্টাখানেক খেলায় মত্ত হয়।
    বাড়ি ফিরে কী মনে হতেই পোশাক বদলায় কুশল। প্যান্ট-শার্ট পরে রুনাকে ডাকে।
    রুনা সামনে এসে দাঁড়ায়। একটু অবাক হয়।
    আজ বাজারে যাব।
    অলীক চোখে তাকায় রুনা। একটু যেন করুণা ঝরে। ছুটির দিনেও ফাঁক নেই মানুষটার। অফিসের ফাইল বাড়ি বয়ে আনে। হাট-বাজার করার সময় পায় না। আজ কী হলো কে জানে!
    ব্যাগটা দাও তো।
    রুনা তাকিয়ে থাকে। লজ্জা পায় কুশল।অনেকদিন পর তার যেন বয়স কমল।
    একটু মাছ পট্টিতে যাব। ব্যাপারিটা তো সবসময় এক মাছ দিয়ে যায়। কী আনব বলো।
    বিস্ময়ে চেয়ে থাকে রুনা। যেন অনেকদিন পর একটা মরা মানুষ আশ্চর্য এক জাদুবলে মর্গের বাইরে বেরিয়ে সটান তার সামনে।
    কুশল হাসে, তাছাড়া অনেকদিন এখানকার হাটে যাইনি। চেনা মানুষগুলোর মুখ অভ্যাসে রাখা ভালো। রিটায়ারমেন্টের পর তো বেরোতে হবে। তার আগে চেনাজানা পরিবেশটা নষ্ট হওয়া কি ভালো?
    রুনার চোখের পাতা তিরতির করে কাঁপে। অনেকদিন পরে তাকে যেন নতুন দেখায়। একটা মেয়েলি অভিমানে থম।
    তুমি দিন দিন পাল্টে যাচ্ছ। অন্যের কষ্টকে বুঝতে ভুলে যাচ্ছ, জানো না একা-একা আমার সময় কেমন কাটে!
    খাঁচা বন্দি পাখিটার মতো মেয়েটা হঠাৎ ছটফটিয়ে ওঠে। বুকের কষ্ট চেপে বলে, আমার কেউ নেই, ছেলেটারও পাখা হয়েছে।
    সোফায় বসে কুশল। রুনাকে কোনোদিন এত বোকা দেখায়নি। নিজের বদল কি টের পাচ্ছে? বরবুক হয়ে যায় কুশল। ভয় করে। রুনা কি কোথাও অবহেলা টের পাচ্ছে?
    বাজারের ব্যাগ নিয়ে সে বেরিয়ে পড়ে। কিছুটা হেঁটে ক্লান্ত লাগে। সাধনার কী হবে? রুনার থেকে এবার কি পালাতে চাইবে? জানে না।
    পুকুরের ওপারে ঘিঞ্জি বস্তি দিয়ে বিশ্রী ভাষায় গালমন্দ ভেসে আসে। বিন্দি বুড়ির বউ। শাশুড়ির উদ্দেশ্যে বলছে, খানকি, এখান থেকে বেরো বলছি। খাবে আর পাড়াময় ছেলে-বউয়ের নামে সাতকাহন করবে। ভাত দেব না তোকে। কোন নাঙের কাছে যাবি যা।
    ছেলেটা টেনে-হেঁচড়ে মাকে নিচের উঠানে ফেলে। কুশল থমকে যায়। বিন্দির ছেলে অসীম তাদেরই বয়সি। ছেলের বউয়ের জন্য মা পেটাচ্ছে।
    বদমাশ বুড়ি পুকুরে পড়ে মরতে পারে না। কতবার বলেছি, দেখতে পাস না, কোথাও বেরুবি না। না লাঠি ধরে পথ হাঁচা করে কানি ঠিক যাবে। ঘরের কথা পরের কানে তুলবে।
    অসীমের বউও পাড়া ফাটায়, কানা হলে কী হবে, এখনও বদ-বুদ্ধি যায়নি, নিজে যে পথে ছিল নাতবউকে সেই পথে পাঠাতে চায়। শরীর দেইখে টাকা ইনকাম। ছেঁচড়া মেয়েমানুষ।
    যে ভাতারদের সঙ্গে এদ্দিন ছিলি, তাদের বেটা-বউয়ের কাছে যা।
    কুশলের লজ্জা হয়। বিন্দির ছেলে অসীম ক্লাস ফোর পর্যন্ত তাদের সঙ্গে পড়েছিল। আর পড়েনি। সেই ছেলে আজ মায়ের সামনে মর্দানি করছে।
    বিন্দির জন্য বড় কষ্ট তার। কিশোর বয়সে বিন্দির রূপ দেখেছে। সেই শরীর এত পলকা! সেই শরীরে আজ এত কান্না!
    কুশলের হৃদপিণ্ড কাঁপতে থাকে। পা চালায়। রুনা কি আজ নতুন কিছু উপলব্ধি করল! আবছা কোনো ছায়া টের পেল!
    ঠেলাঠেলি করে মাছ-পট্টিতে ঢুকল বটে, কিন্তু মাছ কিনতে ইচ্ছে হলো না। মনটা খিঁচড়ে গেছে। ছেলের হাতে মার খেল বিন্দি বুড়ি! ছেলের বউয়ের হাতে! এই বয়সে কঙ্কালসার চেহারা নিয়ে কোথায় যাবে কানা বুড়িটা? কয়েক বছর আগে ছেলে-বউয়ের হাতে ভাত না পেয়ে গলায় দড়ি দিয়েছিল বিন্দির স্বামী হারা। বিন্দিকে কি সেই পথ দেখতে হবে?
    মাছ কেনা হলো না। পছন্দের সব মাছ ফুরোতেই একটা ফুলের দোকানের সামনে এসে অনেকক্ষন দাঁড়িয়ে রইল। ঘরমুখো অজস্র মানুষের সামনে নিজের অজান্তে এক পাগলামি করে বসল। ফুলের ঝুড়ি থেকে এক মুঠো গাঁদা তুলে কুচিকুচি করে দিল। দোকানি ঘাবড়ে গিয়ে চকিতে তার হাতটা ধরল, পাগলা হয়ে গেলে নাকি?
    চেনামতো একটা মানুষ সামনে দাঁড়াল, কী করছ এসব?
    ছিটেল হাসি হেসে কুশল একটা লম্বা নোট বাড়িয়ে দিল। দোকানদার মানুষটা লালায়িত চোখে নোটটা হাতাতেই কুশল হন হন করে পালাল। গলিটা পেরিয়ে তিন মাথার মোড়ে এসে দাঁড়াল।
    এখন কী করবে? কোথায় যাবে? একটুও ভালো লাগে না। বিপিনের চায়ের দোকানে ঢোকে। এই ছেলেটাও এককালে সতীর্থ ছিল।
    শালা ভুল করে এখানে ঢুকলে!
    বিপিনটা এখনো তেঁদড়। পাবলিক প্লেসেও তাকে অফিসারের মর্যাদা দেয় না। তবু না ঢুকে সে পারল না।
    অনেকদিন ঢুকিনি। তাই লোভ হলো ভাই।
    ওর দিকে বড়ো চোখে তাকিয়ে খরিদ্দারকে চায়ের কাপটা এগিয়ে দিতেই কিছুটা চা ছলকে পড়ে।
    বিপিন হাসে। আবার কাপটা ভরে দেয়। কুশলের দিকে মনোযোগ দিয়ে বলে, মনটা যেন খিচুড়ি হয়ে আছে।
    একটা চা দে।
    চতুর বিপিন আর বিশেষ ঘাঁটায় না। চট করে কিছু বুঝে চেপে যায়। কেটলি থেকে কাঁচের গ্লাসে চা ঢালতে ঢালতে আড়চোখে তাকায়, সবজিওয়ালা বাড়িতে যায়, মাছওয়ালাও, তবু বাজারে কেন?
    শূন্য ব্যাগটার দিকে কুশলের দৃষ্টি যায়। নিজেকে ভিক্ষুক মনে হয়। বিপিন আবার কী প্রশ্ন ছুঁড়বে কে জানে! মনের তন্ত্রীতে ঘা পড়ে। চা-টা এগিয়ে দিয়ে বিপিন আর কথা বাড়াবার ফুরসৎ পেল না। কয়েকটা খরিদ্দার এসে পড়তেই ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
    গ্লাস রেখে দাম মিটিয়ে দাঁড়াল কুশল।
    উঠলে যে? অনেকদিন পরে যাহোক পায়ের ধুলো পড়ল। একটু বোসো।
    কুশল হাসে, জীবন থেকে সময় হারিয়ে গেছে রে ভাই, চললাম।
    অনেকক্ষণ হাঁটে কুশল। উদভ্রান্তের মতো। কোনোদিন তো এত ধীরে হাঁটে না সে। পথ ফুরোনোর তো এখন অনেক দেরি। তার আগে ক্লান্তিতে সে খসে পড়ছে কেন! করুণ মুখগুলো পরপর মনের পটে ভেসে ওঠে। বিন্দি বুড়ি, সাধনা, রুনা, কুশল...
    সাধনার জন্য এই মুহূর্তে আর উত্তাল মাতলামি নেই। রুনার জন্য একটু একটু করে বুঝি থিতিয়ে পড়ছে নদীটা। বাবাই যদি শেষ জীবনে আশ্রয় না দেয় মেয়েটা সইতে পারবে তো? হাজার হোক নাড়ি ছেঁড়া রক্ত। কান্না পায় তার।
    অথচ বিন্দির আকাঙ্ক্ষার সুতোটা একদিন কি শক্তপোক্ত ছিল না? কখনো কি টের পেয়েছিল শরীর দিয়ে কারো জীবনে গিঁট ফেলে যায় না, সবকিছু আলগা, পলকা।
    সাধনার অবৈধ চাহনিটা ফিকে হয়ে আসে। রুনার কামিনী শরীর পাণ্ডুর হয়ে যায়। শুধু বিন্দি বুড়ির মুখ ভাসে। অন্ধ, ভোঁতা। যে শরীরে লড়াই করার রসদ ছিল, বাজি ধরার দেমাক ছিল, আজ মাটিতে লাট খাচ্ছে।
    নতুন প্রজন্মের বাবাইটা নজরের আড়ালে কেমন বাড়ছে সে জানে না। দামড়া অসীমের মতো কোনোদিন মাকে বলবে না তো, তুমি একটা নোংরা, চরিত্রহীন মহিলা।
    বাপের দিকে চোখ ঠারবে না তো?
    ইলেকট্রিক পোস্টের পাশে সে দাঁড়ায়। অতিকষ্টে সোজা হয়। উচ্ছিষ্টের খাতায় নাম উঠে যাচ্ছে না তো? ভিতরে ভূমিকম্পের রেশ পায় কুশল।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। মন শক্ত করে মতামত দিন