বিজেপি কি সত্যিই হেরেছে ? হ্যাঁ, পশ্চিমবাংলার কথাই বলছি।
আজ প্রধান বিরোধী দল বিজেপি। এখনো জানিনা ঠিক কতো আসন পাবে বিজেপি। তর্কের খতিরে ধরে নিচ্ছি ৯০এর ঘরে। সেটা কি কিছু কম ? সরকার বিরোধী যে কোন পরিসর বিজেপি দখল করে নিলো। এটা কি কম বিপদ ? বাম বা এখন থেকে বাম না বলে সিপিএমই বলবো, সেই সিপিএম কি রাস্তায় নামার মতো অবস্থায় আছে ? সরকার বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেবার মতো জায়গায় আছে ? সরকার মানে শুধু তো রাজ্য সরকার নয়, কেন্দ্র সরকার বলেও তো বিরোধীতার একটা বস্তু আছে ! এনআরসি/সিএএ, কৃষিবিল, শ্রম বিল, বিলগ্নীকরণ, শিক্ষা, কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক এসব নিয়ে তৃণমূল একাই বলবে ? তা তো নয়ই, এমনকি কিছু কিছু বিষয়ে, অন্তত; বিলগ্নীকরণের মতো অর্থনৈতিক বিষয়ে তৃণমূল তো কংগ্রেসী ঘরাণারই। ধর্মের প্রশ্নে, তৃণমূল তো কংগ্রেসের মতোই “নরম হিন্দুত্বে” বিশ্বাসী। তার বেলা ?
আমার মনে হয়। #বিজেপিকেএকটিভোটওনয় আন্দোলন হিসাবে যথেষ্ট সম্ভাবনা দেখিয়েছে। সেই যৌথ মঞ্চ এই বিরোধী পরিসরটিকে দখল করুক। বিজেপি তার মতো করে রাজ্য সরকার বিরোধী আন্দোলন করবে। বিষয়টি যদি যৌক্তিক হয়, তাহলেও ঐ মঞ্চ তার আলাদা স্বর খুঁজে নিক। যা ঐ বিষয়ে বিরোধীতা করবে কিন্তু আলাদা ভাষায়, আলাদা আঙ্গিকে। উল্টোদিকে কেন্দ্র সরকারের নানা কাজের বিরোধীতাতেও একই কৌশল নিতে হবে। ক্ষেত্র বিশেষে স্বাতন্ত্র বজায় রেখে যৌথ কর্মসূচী হতে পারে। তবে তার সম্ভাবনা কম। কারন রাজ্যের সরকারী দলের দাম্ভিকতা তাতে বাদ সাধবে।
কিন্তু বন্ধু ফ্যাসীবাদের কি হবে !
পশ্চিমবাংলায় নাহয় বিজেপি হারলো, নাহয় কেন্দ্র থেকেও কাল বিদায় নিলো বিজেপি, তাতেই কি ফ্যাসীবাদ মুছে যাবে ?
এটা সত্যি যে ফ্যাসীবাদের ইতিহাস বলছে জার্মানী বা ইতালীর ফ্যাসীবাদকে হঠাতে সোভিয়েৎ, আমেরিকা, বৃটেন, ফ্রান্সের মিলিত রাষ্ট্র শক্তির হামলা চালাতে হয়েছে। কোন গণতান্ত্রিক উপায়ে হঠানো যায় নি। তেমনি এটাও সত্যি যে আজকের ভারতীয় ফ্যাসীবাদের সাথে জার্মানী বা ইতালীর ফ্যাসীবাদের বাহ্যিক মিল থাকা সত্ত্বেও রাষ্ট্র চরিত্রের জায়গা থেকে আজকের ভারত আর সেদিনের ইতালী বা জার্মানীর কোন মিলই নেই। সেসময় দুটোই ছিলো উন্নত ধণতান্ত্রিক রাষ্ট্র যাদের একাধিক উপনিবেশ ছিলো, সংকটের বোঝা চালান করার জন্য। আজকের বিশ্ব পরিস্থিতি একেবারেই আলাদা। আজ উত্তর ঔপনিবেশীক যুগে নয়া উপনিবেশবাদ উত্তীর্ণ হয়েছে বিশ্বায়নের নতুন কায়দায়, যা পুরনো উপনিবেশের অর্থনীতিকে ফিরিয়ে এনেছে নতুন মোড়কে। ফলে গণতান্ত্রিক উপায়ে ফ্যাসীবাদের লক্ষণযুক্ত দলটিকে পরাজিত হয়তো বা করা যাবে, কিন্তু ফ্যাসীবাদ একটা চিন্তার ধারা হিসাবে থেকেই যাবে, যতদিন না ঐ চিন্তার সাথে লড়াইটা জেতা যাচ্ছে। দলটিকে নির্বাচনে হারানো সেই লড়াইয়ের একটা অংশমাত্র । এই লড়াইটি দীর্ঘস্থায়ী ও মূলতঃ সাংস্কৃতিক। আমরা এক জটিল সময়ের মধ্যে বিরাজ করি, যেখনে অশুভ-সামন্ততান্ত্রিক চিন্তা ও ধণতন্ত্র হাত ধরে চলে। যেহেতু ধণতন্ত্রের কাছে সামন্ততন্ত্র আজ আর কোন বিপদ নয়, তাই ধণতন্ত্র বিরোধী লড়াইকে দুর্বল করার জন্য অশুভ-সামন্ততান্ত্রিক চিন্তার সাহায্য নিচ্ছে পুঁজি। কৃষিবিল বিরোধী লড়াইকে হিন্দু-মুসলমান বা জাঠ-পাঞ্জাবী আর অজাঠ-অপাঞ্জাবীতে লড়িয়ে দিতে পারলে সেটাই করবে পুঁজি। কাজেই লড়াইটা আজকে বহুস্তরের। নির্বাচনে হারানোটাই শেষ কথা নয়। মাঠে-ঘাটে-রাস্তায়-আড্ডায়-চায়ের দোকানে-যে কোন জনপরিসরে ধর্ম, জাতপাত, লিঙ্গ, ভাষা-পরিচয় নিয়ে বৈষম্যমূলক কথার প্রতিবাদকে অভ্যাসে পরিণত করুন। ঠান্ডা মাথায় মানুষকে যুক্তি দিয়ে বোঝান। প্রতিবাদ মানেই ক্রোধ নয়, প্রতিবাদ মানে যুক্তি। শারিরীকভাবে আক্রান্ত হলে তবেই পাল্টা আক্রমন, তার আগে নয়।
আর এই কাজ করতে পারে #বিজেপিকেএকটিভোটওনয় আন্দোলনের যৌথ মঞ্চ। এই মঞ্চকে এগিয়ে এসে পশ্চিমবংলার বাম আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে হবে। দল থাকুক, থাকুক স্বাধীন বাম শক্তি ও ব্যক্তিবর্গ। আজকের আন্তর্জাল প্রযুক্তির যুগে ডব্লিউটিও বিরোধী আন্তর্জাতিক আন্দোলনটির কথা মাথায় রাখুন। এটিও নানান দল, স্বাধীন গোষ্ঠী ও ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা মঞ্চ, যার কোন পদাধীকারী নেই, আহ্বায়ক ছাড়া। ফোনে, সমাজমাধ্যমে কথা হয়, তর্ক হয়, কাজের পরিকল্পনা ও কাজ হয়। জমায়েৎ হয়, মিছিল হয়, বিক্ষোভ হয়। যে যার নিজের স্বত্তা নিয়ে আসে। একসাথে লড়াই করতে।
এটি আমাদের দেশে লড়াইয়ের নতুন সংস্কৃতি, যার জন্ম হয়ে গেছে কৃষিবিল বিরোধী আন্দোলনের জঠরে।
আমরাও সেখান থেকে শিখি।
কথা হোক।