ঘোর বর্ষা। ঘোর কলমভার। ঘোর কলমবাজি। খাতা থেকে আকাশ মুখ তুলতে পারছে না। আকাশ ধূসর, আকাশে নীল নেই - শেষ বিকেলের অস্তরাগটুকুও ছিলনা। অফিসফেরতা এই এক রোখ চেপে বসে। দিনের সব তাপ শুষে নিতে চায় কবিতায়। মুখ তুলছে না। চোখ বুজছে না। খাতার কাছে সে অসীমান্তিক। খাঁ খাঁ ঘরে কলম পেষাইয়ের শব্দ। বাকি সব শব্দ জব্দ। শব্দে ভয়। শব্দ মনোরোগ। শব্দ জীবনবিতৃষ্ণা। সব শব্দ খাতায় পুরে কোন ইমারত তুলবে?
ইত্যবসরে ঘরে ঢুকছে কেউ। ইঁদুরের মতো চুপিচুপি। দরজার বাইরে হাই হিল সন্তর্পনে খুলে রাখলো। বর্ষাতি ছিল না, ছিল ছাতি। টুক করে দেওয়ালে হেলান পেল সে। ইতস্ততঃ করছে। সেঁধোবে কি সেঁধোবে না ... খানিক ভেবে নিচ্ছে। ফিরে যেতে তো আর দুপুরের ট্রেনে চেপে বসেনি! কোথায় আগরতলা আর কোথায় ধর্মনগর। অঙ্গ বঙ্গ কলিঙ্গ পেরিয়ে তবে না ধর্মনগর! দক্ষিণের বিলোনীয়া থেকে উত্তর পশ্চিমে রাজধানী আগরতলা। এতটুকুই ছিল দৌড়। ভাবেওনি যে আরো উত্তরমুখী হয়ে ধর্মনগর আসতে হবে। আসলে সুতো ছাড়তে ছাড়তে যে আজ এই অবস্থা হবে কে জানত! আজ তাই সশরীরে জানান দিতে হচ্ছে। না এসে উপায় ছিল না। মনসিজ ক্রমশ: পিছলে যাচ্ছিল।
গলা খাঁকারি খুব সিনেম্যাটিক। ও পথে যাবে না অলি। হুট করে উল্টোদিকের সোফায় বসে পড়লেই হয়! মনসিজ তো সিগারেট ভাঁজছে আর মুখ গুজে আছে খাতায়, উটের মতো। বাহ্যজ্ঞানলুপ্ত। ঘরের অবস্থা " বোতল গড়ায়, গেলাস গড়ায় "। এর মাঝে এক চিঙারি আগরতলার অলি। মানাচ্ছে না এ ঘরে। এ ঘরে ওকে মানাবে না। দাঁড়াও বাবু, বিয়েটা হয়ে নিক, নোনাধরা দেওয়ালের এ ঘরে তোমাকে থাকাচ্ছি!
ঘরে আছে তৃতীয় একজন। মানে, অলির সাথেই তার এ ঘরে প্রবেশ। তিনি কনের ঘরের মাসি, বরের ঘরের পিসি। একাধারে মনসিজের পেয়ারের অনন্তবাবু, অন্যধারে অলির ডাকাতুতো দাদা। অলি ধর্মনগর এসে উঠেছে অনন্তর ঘরেই। দাদা'রা কত'না কাজে লাগে! রক্তের আত্মীয় না হোক, তাতে কী! আত্মার আত্মীয় হয়ে উঠতে কতক্ষণ!
গলা খাঁকারিটা তৃতীয় জনই দিল। মাথা তুলল না মনসিজ। বাহ্যজ্ঞানলুপ্ত।
- আচ্ছা মনসিজবাবু, অলি এসেছে আপনার সাথে দেখা করতে।
চোখে কুয়াশা। মনসিজ মাথা নাড়ছে। কবিতার কোল থেকে সমূলে উৎপাটিত হওয়ার বিহ্বলতা তার চোখে মুখে। সম্বিত ফিরে পেল। বহুযুগের ওপার থেকে কেউ যেন ডাক দিয়েছে।
- অলি, অলি, তুমি? আগরতলা থেকে? কীভাবে? কখন?
- এত উৎকন্ঠিত হয়ো না। আমার কি হাত পা নেই? আসতে পারিনা নাকি? বেড়াতে এলাম।
- এমা, এমা, করেছো কী! মাসিমা মেসো জানতে পারলে কী ভাববেন! এখানে তো তোমার কেউ নেই!
- কেন? তুমি আছ। না তুমিও নেই?
গুছিয়ে বসল অলি। কী আশ্চর্য, এ ঘরে একটা সিঙ্গেল সোফা আছে। অবশ্য তার চেহারা যুগান্তকারী। তবুও সোফা তো! গুছিয়ে বসল অলি। তুমুল ঝগড়া হবে আজ। তার আগে গুছিয়ে বসা দরকার।
এবার অনন্ত কী করে। কবাবের মধ্যে সে নিতান্ত এক হাড্ডি। মহাকালের রথের চাকা ঘুরতে ঘুরতে অনন্তে এসে ঠোক্কর খাচ্ছে। কিন্তু অনন্ত ঘোড়েল মাল। কোনো এক ওপেন ইউনিভার্সিটি থেকে এম বি এ। বলিয়ে কইয়ে মানুষ। কোনো পরিস্থিতিতে পার্শ্বচরিত্রের পাঠ করতে সে নারাজ। উপুর্যুপুরি সিনেম্যাটিক গলা খাঁকারি দিয়ে অনন্ত হাত থেকে বেরিয়ে যাওয়া পরিস্থিতির হাত ধরলো।
- না, অলি দেখা করতে এসেছে এত দূর থেকে। আমার বাসায়ই উঠেছে। বেচারি তো এখানকার কিছু চেনে না! বিশাখার সাথে তো ওর বেশ সখ্যও গড়ে উঠেছে এই অল্প সময়ে। বিশাখা তো ছাড়তেই চাইছিলো না। বলে কয়ে বুঝিয়ে নিয়ে এসেছি। অলি বলছিল আপনাদের মধ্যে কী যেন ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। হতে পারি আমি আপনার অধস্তন কর্মচারী। কিন্তু অলির দাদা তো বটে! সেই সুবাদে আপনারও দাদা। আমার বয়েসটাকে অন্তত মান্যি করে আপনি ব্যাপারটা খোলসা করে বলুন তো দিকিনি মনসিজবাবু! সমস্যাটা কী?
- না কোথায়! কোনো সমস্যা নেই, কোনো সমস্যা নেই!
স্বগতোক্তির মতো। নিজেকেই শোনাতে চাইল যেন।
- সমস্যা সব চুকেবুকে গেছে, চুকেবুকে গেছে।
- ঠিক আছে, আস্বস্ত হলাম, তাহলে অলি এখানে থাকুক, আপনারা গল্প করুন, আমি ঘন্টাদুয়েক পর এসে নাহয় অলিকে নিয়ে যাব। ততক্ষণে সেরে নিন।
চোখ মটকে বেরিয়ে গেল অনন্ত। সমাজের যা দস্তুর, পৃথিবীর যা দস্তুর। চোখ মটকাতে হয়। পৃথিবী চেনে চোখ মটকানোর ভাষা। যে পৃথিবীতে প্রদীপের সলতে থাকে, তেলও থাকে, কিন্তু অগ্নিসংযোগের জন্য লাগে অনন্তর মতো দুর্দান্ত পুরুষ, যারা খস করে এক স্ট্রোকে দেশলাই কাঠি জ্বালতে পারে।
এবার হলো কী, এক যুবক ও যুবতী উত্তর ত্রিপুরার ধর্মনগরে মোটামুটি সম্ভ্রান্ত এক পাড়ায় বন্ধ এক ঘরে একে অপরের দিকে তাকিয়ে উশখুশ করছে। মুখে বাক্যি নেই। এক কবি ও তার প্রেমিকা।
- কিছু খাবে? চা করি? আমিও খাবো।
- আমি করছি। আমাকে দেখিয়ে দাও।
চামচে টুংটাং উঠল, পেয়ালা পিরিচে আলিঙ্গন হলো, বর্ষার আকাশে আরেকটু মেঘ জমলো ধূমায়িত চায়ের কাপ থেকে।
- ঘরে একটা বিস্কুটের প্যাকেটও নেই, কাপের যা অবস্থা, তোমার ঠোঁটের দাগ স্টিকার হয়ে বসে গেছে। ঘরে একটা ফার্ণিচার নেই এই নড়বড়ে খাট আর এই ভাঙা সোফা ছাড়া। বিছানাপত্রের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। বোতল আর সিগারেট প্যাকের স্তুপ। তোমাকে যত ভ্যাগাবন্ড ভেবেছিলাম, তুমি তার চেয়ে দশগুণ ভ্যাগাবন্ড, যত নোংরা ভেবেছিলাম, তুমি তার চেয়েও বিশগুণ নোংরা। জীবনযাপনে নোংরা, ব্যবহারে নোংরা, ভাবনায় নোংরা। তুমি বেঁচে আছ মনসিজ? এটাকে বেঁচে থাকা বলে?
- এই কথা বলতে এসেছ? এত দূর থেকে? ফোনে বলতে পারতে!
- ফোন? সেটাও তো ধরছ না ইদানিং। সমস্যাটা কী তোমার? জীবনবিমুখতারওতো একটা সীমা থাকে। তুমি সব সীমা ছাড়িয়ে অসীম হতে চাইছ?
স্মিতহাসি ফুটে ওঠে মনসিজের ঠোঁটে। অনেকে হাসি পেলে হাসে, অনেকে রাগ করলে হাসে। মনসিজের হাসি উঠছে করুণায়। অলির সাজানো বাগান তছনছ হয়ে যাচ্ছে। একটা সুখ আসছে মনে। অলির সুখস্বপ্নগুলো কাগজ পোড়া ছাইয়ের মতো কুকড়ে যাচ্ছে। আত্মপ্রসাদের রাংতামোড়া খামে কে যেন সবুজ চিঠি লিখছে মুক্তজীবনের।
- তুমি পাষণ্ড নও আমি জানি। মেয়েরা চোখ চেনে। তোমার চোখ লোভী নয়। তুমি শুধু হেরে গেছ। সময় তোমাকে হারিয়ে দিয়েছে। তুমি পড়ে গেছ। আর আমি টেনে তুলবই।
- তোমরা যাকে পড়ে যাওয়া বলো, তা আসলে এক অতি উচ্চাঙ্গে অবস্থান। স্বয়ং ভগবানও যার নাগাল পান না। অবশেষে নারী রূপে অবতীর্ণ হতে হয় টেনে নামানোর জন্য। সেম লেভেল না হলে ভগবানেরও অসুবিধা হয়। বর্ণাশ্রম গভীরে প্রোথিত তো!
- ফালতু কথা একদম বলবে না। আমি এসেছি হেস্তনেস্ত করতে। বাবা রাজী নেই। আমি ঠিক করেছি পালাবো। তুমি আমাকে ইলোপ করবে। তার আগে ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের অফিসে ছোট্ট একটা সই। সাক্ষী আমার তৈরী আছে। ওসব তোমার ভাবতে হবে না। বিয়ের পর আমার ঘরটাও চেঞ্জ করতে হবে। ওপাড়ায় আমি মুখ দেখাতে পারবো না। আর তোমার ঘরটাও চেঞ্জ করতে হবে। চাকরিটা আমি ছাড়বো না। মাঝে মাঝে আসবো তো। এই ঘরে থাকতে পারবো না। অবশ্য ছয় মাস। এর মধ্যেই তোমার আগরতলা ট্রান্সফার হচ্ছে। বিল্টুদার সাথে কথা হয়ে গেছে। সব ব্যবস্থা পাকা হয়ে গেছে। তুমি শুধু একটু সহযোগিতা করো।
বাঁধ উপচানো নদী হয়ে গেছে অলি। খড়কুটো দূর থাক, বটগাছ বা অট্টালিকা, কিছুই মানবে না। সব ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। আর অপরপক্ষ?
ফস করে সিগারেট জ্বালে মনসিজ। মুখ চোঙা করে ধোঁয়ার রিং বানাচ্ছে। যেন এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ পৃথিবীতে এই মুহূর্তে আর কিছু নেই।
-2-
সিগারেট একটা জ্বলছে বাইরেও। ল্যাম্পপোষ্টের নিচে। বৃষ্টি থেমেছে। আষাঢ় আকাশে মেঘ কেটে মৃদু জোছনা খেলছে। ভিজে ন্যাতা হয়ে আছে শহরটা। অধিভৌতিক একটা লাল বিন্দু জ্বলছে ল্যাম্পপোষ্টের নিচে। ঠিক মনসিজের জানালার নিচেই। অনন্ত। কোথাও যায়নি। ঠায় দাঁড়িয়ে ছিল। দাদা তো শুধু নিছক এক সম্বোধন নয়, দায়িত্বও থাকে। তাছাড়া, মেয়েটা শুধুমাত্র ওরই ভরসায় এতদূর এসেছে। নজর রেখেছে জানালার দিকে। জানালার ঝাপসা কাচে দেখেছে নারীপুরুষের যুগল অবয়ব। তাদের হাসিকান্না, বাকবিতণ্ডা, মানভঞ্জন।
প্রবল দ্বন্দ্বে আছে অনন্ত। মনসিজের অধীনেই চাকরি করে। মনসিজকে কাছ থেকে দেখেছে। সাদা মনের মানুষ, ঘোরপ্যাঁচ নেই। কিন্তু ... একটা কিন্তু আছেই। নিজের বোনের বিয়ে মনসিজের মতো ছেলের সাথে দিতোনা অনন্ত, যতই সরকারি এ ক্লাস অফিসার হোক না কেন। মনসিজের ওপর প্রবল টান অনন্তর। কিন্তু সত্য সত্যই। অন্যদিকে অলি! মিষ্টি একটা মেয়ে। একদম ঘর আলো করার মতো। রোখ চেপে বসেছে মনসিজকে পথে আনবেই। নইলে কত ছেলে ওর পিছে হন্যে হয়ে ঘুরছে! কিন্তু অলি পাত্তা দিলে তো! তার মনসিজকেই চাই। একলা মেয়ে আগরতলা ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে। চাকরি করে। মা বাবা তো সেই বিলোনীয়া। এমন একটা সোনার টুকরো মেয়ের মনে যে কী রঙ লাগালো মনসিজ! আসলে কবি তো! কবিরা পারে।
আজকের সন্ধ্যাটা দুজনের জীবনেই এক বিশেষ সন্ধ্যা। এই সম্পর্কের দিকনির্দেশ করবে এই সন্ধ্যা। অনন্তও জুড়ে থাকল। একেই কি যুগসন্ধিক্ষণ বলে?
মনসিজকে পইপই করে বুঝিয়েছে অনন্ত। অলি একটি ব্যতিক্রমী মেয়ে। এ যুগে এমন মেয়ে পাওয়া দুষ্কর। মনসিজের সৌভাগ্য যে অলির মতো মেয়ে যেচে এই সম্পর্কে আসতে চাইছে। ঘর বাঁধতে চাইছে। আর স্বার্থহীন ভালোবাসা পাওয়া এ সময়ে ভগবান পাওয়ার মতো ব্যাপার। বিয়ে যখন করতেই হবে, আর মনসিজের নিজস্ব অন্য কোনো পছন্দ যখন নেই, তখন যে ভালোবাসে কোনো পূর্বাপর চিন্তা না করে, তাকেই জীবনসঙ্গী করাটা কী বুদ্ধিমানের কাজ নয়? বিশেষত : মনসিজের এই বিশেষ পরিস্থিতিতে! অন্যদিকে অলির কানেও মন্ত্র ঢেলে গেছে অনন্ত। মনসিজের জীবনযাপনের প্রতিটি খুঁত যত্নসহকারে ও যুক্তিসহকারে পেশ করেছে অলির কাছে প্রতিনিয়ত। অলির যাতে মন বদলায়। অলি যাতে এ সম্পর্ক থেকে বেড়িয়ে আসতে পারে। নিজের চোখেই তো দেখতে পাচ্ছে, প্রাণোচ্ছল অলি একটা ভুল সম্পর্কে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিজেও মনোবিকলনের শিকার হয়ে উঠছে। তার ভালোবাসাটাও মাঝে মাঝে অবসেশনের মতো ঠেকে অনন্তর। কিন্তু ভবি ভোলাবে কে! অলির ভালোবাসা মনসিজের লাগে গলার ফাঁসের মতো, তো অলি বুঝতে পারেনা মনসিজের মতো একদা ব্রাইট ছেলে কেন জীবনবিমুখ হয়ে যায়! তার আত্মসম্মানে প্রবল ঘা লাগে যখন নিরন্তর প্রত্যাখান মেলে মনসিজের কাছ থেকে।
আর এই সম্পর্কের টানাপোড়েনে জড়িয়ে প্রবল দ্বন্দ্বে পড়ে থাকে অনন্ত। বুঝতে পারেনা কোনটা সঠিক সমাধান। দুজনেই তার স্নেহাস্পদ। দুজনেই প্রিয়পাত্র।
অনন্তর চিন্তাসূত্র ছিন্ন হয় হঠাৎ। ঝড়ের মতো কোলাপসিবল গেট খুলে বেড়িয়ে আসছে অলি। ঘনসন্নিবদ্ধ তার চোয়াল। চোখে আগুণ বর্ষিয়ে সর্পিনীর মতো হিসহিসিয়ে উঠল -
- ও নাকি সাইকো প্যারেন্ট হতে চায় না! মহত্ত্বের অবতার একপিস! আমিও বীজ নিয়ে এসেছি। দেখি এবার আমাকে কীভাবে রোধে!