গৃহবন্দী এবং কয়েকটি মুখোশ,
মুখোশ -
না মুখোশ দেখে ভাববেন না যে আমি সরকারি হাসপাতালের সমস্ত কর্মীদের মুখে বাঁধা একফালি ন্যাকড়ার কথা বলছি অথবা মুখ্যমন্ত্রী এবং তাঁর সঙ্গী সাথীদের মুখে বাঁধা, N 95 লেখা মুখোশের কথা বলছি।
এ অন্য মুখোশ,
তার কথা পরে হবে, আগে খুব ছোটবেলায় পড়া একটি গল্প শুনুন। গল্পটা মজার।
ধরা যাক সেটা আঠারোশো শতাব্দীর ইংল্যান্ড অথবা ইউরোপের যে কোন শহর হতে পারে।
চার যুবক বন্ধু এক সরাইখানায় আড্ডা দিচ্ছে। হাতে পানীয়ের পাত্র। চার বন্ধুর আর্থিক অবস্থায় তারতম্য আছে। একজন অর্থনৈতিক ভাবে যথেষ্ট দুর্বল, আর একজন ধনী ব্যবসায়ী পুত্র। বিস্তর অর্থের মালিক। বিত্ত বৈভবে সে সকলকে টেক্কা দিতে পারে। আচরণেও তার বেশ ভালোরকম প্রকাশ আছে।
অন্য দুই বন্ধুর আমাদের গল্পে তেমন কিছু ভূমিকা নেই, সুতরাং তাদের কথা বিবেচ্য নয়।
বিভিন্ন দিক ঘুরে, শেষ পর্যন্ত আলোচনা পৌঁছুলো, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অথবা মৃত্যুদন্ড, কোনটা বেশি কাম্য।
বড়লোক বন্ধুটি বললো, সে দুটোর মধ্যে মৃত্যুদন্ডটিকেই পছন্দ করবে।
গরীব বন্ধুটি যাবজ্জীবনের পক্ষে।
পেটে পানীয়ের প্রভাব, উত্তেজিত মস্তিষ্ক, হিতাহিত জ্ঞান রহিত, অবশেষে বাজির পর্যায়ে পৌঁছে গেল।
বড়লোক বন্ধুটি, গরীব বন্ধুকে আহ্বান জানালো, বাজি ধরা যাক।
রাজি থাকলে, গরীব বন্ধুকে দশবছর গৃহবন্দী থাকতে হবে, বেঁচে থাকলে সে দশ হাজার পাউন্ড গরীব বন্ধুকে দেবে। ঠিক হলো, বড়লোক বন্ধুটির নির্জন জঙ্গল ঘেরা এক বাগান বাড়িতে এই দশ বছর কাটাতে হবে। এই সময়ে কেবলমাত্র একজন মানুষ দুবেলা জানালার ফোঁকল গলে খাবার দিয়ে যাবে। এই দশ বছরে সে কারোর মুখ পর্যন্ত দেখতে পাবে না। তবে তার চাহিদা মোতাবেক, প্রয়োজনীয় সবকিছু বড়লোক বন্ধুটি দিতে বাধ্য থাকবে।
যে কথা সেই কাজ, তৎক্ষণাৎ একজন আইন বিশেষজ্ঞ এলেন, লেখা পড়া হলো। দুজনের স্বাক্ষরের পর অন্য দুই বন্ধু সাক্ষী হিসেবে সইসাবুদ করলেন। তার দুটো কপি হলো, রইলো দুজনের কাছে।
শুরু হলো গৃহবন্দী দশা।
প্রথম বছর, ছেলেটির চাহিদা মোতাবেক কেবল উত্তেজক বইপত্র দেওয়া হলো।
দ্বিতীয় বছর, ছেলেটির মাতৃভাষায় যতরকম ধর্মগ্রন্থ।
তৃতীয় বছর, কিছুই না।
চতুর্থ, পঞ্চম এবং ষষ্ঠ বছরে চাহিদা দেখা গেল বিভিন্ন ভাষা শিক্ষার বই।
সপ্তম বছরের চাহিদা কেবলমাত্র সব ভাষার দর্শনের বই।
অষ্টম বছরও তাই।
নবম বছর কেবলমাত্র রাজনীতি বিষয়ক বই।
এভাবেই একসময় দশম বছর এসে গেল।
ততদিনে বাইরের পৃথিবীর অনেক পরিবর্তন হয়েছে। বড়লোক বন্ধুটি পিতৃহারা হয়েছে। তার ব্যবসার অবস্থা শোচনীয়। এখন তাকে দশ হাজার পাউন্ড দিতে গেলে নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করতে হবে। তার আর মাথার ঠিক রইলো না। পাগল পাগল অবস্থা।
যখন দশ বছর পূর্ণ হতে আর কয়েকদিন বাকি, সে ঠিক করলো, চুপিসারে ওই বাগান বাড়ি যাবে। গিয়ে ওই বন্ধুকে খুন করবে। তারপর মৃতদেহটিকে দড়ি বেঁধে ঝুলিয়ে, আত্মহত্যা প্রমাণ করবে।
দশবছর পূর্ণ হতে আর ঠিক তিন দিন বাকি--
একদা বড়লোক বন্ধু, সেই বাগান বাড়িতে উপস্থিত হলো, জঙ্গলে, আগাছায় পরিপূর্ণ বাড়িতে ঢুকবার আবছা মতো একটি পায়ে চলা পথের রেখা, দুবেলা খাবার পৌঁছে দেওয়া ভৃত্যের চরণচিহ্ন। জঙ্গল ঠেলে সে পৌঁছে গেল দরজার কাছে। তালায় জং ধরেছে, চাবি খুলছে না। বহু কষ্টে, আওয়াজ করে দরজা খুলে গেল।
দেখা গেল, ভিতরে সেই বন্ধুটি টেবিলে মাথা রেখে মৃতের মতো নিশ্চুপে পরে আছে।
না, মারা যায় নি, ঘুমিয়ে পড়েছে। দীর্ঘ দশ বছর তাকে স্থিতধী, ধৈর্যশীল করে তুলেছে। দরজা খোলার আওয়াজ, তার স্থৈয্যের ব্যাঘাত ঘটায় নি।
ধীরে ধীরে একদা বড়লোক বন্ধুটি এগিয়ে গেল, টেবিলের উপর একটি কাগজ, খোলা কলম। কিছু একটা লিখছিল। কৌতুহলী বন্ধুটি, আস্তে আস্তে কাগজটি তুলে নিল, পড়ে দেখলো--
লেখা আছে, 'এই দীর্ঘ দশ বছরে আমি শিখেছি, নিজের অর্জিত যা, তাই আমার প্রাপ্য। দীর্ঘ একাকীত্ব আমাকে লোভ জয় করতে সাহায্য করেছে, বন্ধু কাকে বলে, শিখিয়েছে। আমার আর বন্ধুর অর্থে লোভ নেই। দশ বছর পূর্ণ হওয়ার একদিন আগে আমি এই ঘর ছেড়ে চলে যাব। বন্ধুকে ধন্যবাদ।'
একদা বড়লোক বন্ধুটি, যাকে খুন করতে এসেছিল, দীর্ঘ শ্মশ্রুমণ্ডিত অচেনা চেহারার দিকে চেয়ে তার দুচোখ বেয়ে জলের ধারা নেমে এলো। এ সে কি করতে এসেছিল, কাকে মারতে এসেছিল ! একে সে চেনেনা। সম্পূর্ণ অজানা একজন মানুষ।
ধীরে ধীরে কাগজটি টেবিলে নামিয়ে রাখল। দরজায় তালা দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলোনা।
বন্ধুকে একা রেখে, নিঃশব্দে বেড়িয়ে গেল ঘর ছেড়ে।
গল্পটির আর একটু বাকি ছিল, কিন্তু আমি এখানেই ছেড়ে দিলাম।
আমাদের গৃহবন্দী দশা চলছে। তাও মাত্র দিন কয়েকের জন্য।
ইতিমধ্যেই অনেকের ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙেছে। মুখোশ খুলে গেছে।
সত্তর দশক চলে গেছে বহুদিন। সে সময় কিছু ছেলেমেয়ে, নিজেদের ভবিষ্যতের ভাবনাকে জলাঞ্জলি দিয়ে সমাজটাকে পাল্টানোর জন্য এক অসম যুদ্ধে নেমেছিল। পরাক্রমশালী রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গে তারা পেরে ওঠেনি। সে সময়ের কিছু শ্লোগান, তাদের রাজনীতি, কার্যপদ্ধতি আমরা বিশ্বাস নাও করতে পারি, সেটা দোষের কিছু নয়। অথচ আমাদের, অর্থাৎ জীবনে রাজনীতি এড়িয়ে যাওয়া, বাবা কাকা দাদা ধরা অথবা রাষ্ট্রের কিছু সুবিধা পাওয়া, নিরুপদ্রবে জীবন কাটিয়ে দেওয়া আমরা, কথায় কথায় এখনো তাদেরকে ছোট করতে পিছপা হই না।
আমরা তাদের সমালোচনায় মুখর,
একসময় পরাধীন দেশের স্বাধীনতাকামী কিছু মানুষ সশস্ত্র লড়াইয়ে নেমেছিলেন।
ইংরেজ শাসকদের ভাষায়, তারা ছিলেন সন্ত্রাসবাদী।
নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, সূর্য সেন, বিনয়, বাদল, দীনেশ, ভগৎ সিং, এমনই সব মানুষ।
তাঁরাও কি তবে সন্ত্রাসবাদী ?
যে দেশভাগে, দেশের মানুষের কোন ভূমিকা ছিল না, এতদিন পর তাদের নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
এবং কি আশ্চর্য, চিরকাল নির্বাচনে অংশ নেওয়া এই বাংলার বেশ কিছু মানুষও তাকে সমর্থন করছে।
অথচ কোন একনায়কের সমালোচনা আমাদের মুখে আসে না। আমাদের ভক্তিভাব এতটাই প্রবল, খবরের কাগজে বেরুনো বিভিন্ন দুর্নীতির খবর নজর এড়িয়ে যায়। যখন দেখা যায় কোন ঘনিষ্ঠ পশ্চিমি শিল্পপতি বাজারের চাইতে বহুগুণ বেশি দামে, সরকারি নিয়ম অগ্রাহ্য করে করোনা পরীক্ষার কিট সরবরাহের বরাত পায়, মুখে রা কাটে না।
ডাক্তার নার্স চিকিৎসা সহায়ক কর্মীরা উপযুক্ত সুরক্ষা ব্যবস্থা ছাড়াই ভয়ঙ্কর রোগের মোকাবেলা করে, আমরা চুপটি করে বসে থাকি। মুখে রা কাটি না।
আমাদের অনেকেরই মুখোশ খুলে গেছে।
প্রভাস চন্দ্র রায়