কিছুদিন পরে আজ সন্ধ্যায় ব্যোমকেশ পড়তে বসেছিলাম একটু ফাঁকা পেয়ে। প্রথমদিকের গল্পগুলো পড়তে পড়তে কয়েকটা প্রশ্ন পেল। কিছু আগেও মনে হয়েছে, কিছু এখন মনে হল। এখানেই বলি। দেখুন তো, আমি কোথাও গুলিয়ে ফেলছি, নাকি এগুলো আপনাদেরও মনে হয়েছে? অতিরিক্ত সন্দেহ করছি কিনা, সেটাও বিচার্য।
সত্যান্বেষী
যে রাতে অশ্বিনীবাবু নিহত হলেন, তার সন্ধ্যায় তিনি অনুকূল ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করেন। ডাক্তার যখন ভাটিয়া এজেন্টকে খুন করেন, অশ্বিনীবাবু সেটা জানালা থেকে দেখতে পান। সেই কথাই বলতে যান। তার উত্তরে ডাক্তার জানান, 'আপনি বড় উত্তেজিত হয়েছেন। ওটা আপনার দৃষ্টি-বিভ্রম ছাড়া আর কিছু নয়। ঘুমের ঘোরে মাঝে মাঝে অমন হয়। আমি ওষুধ দিচ্ছি, খেয়ে শুয়ে পড়ুন গিয়ে। কাল সকালে উঠে যদি আপনার ঐ বিশ্বাস থাকে, তখন যা হয় করবেন।"
এই কথা ওপরের তলায় ব্যোমকেশের পাশে শোয়ার পর অজিত শুনতে পায়। তার অনেক আগে থেকে ব্যোমকেশ সেখানে শুয়ে। সেই সময়ের মধ্যে অজিত ঘরে ঢুকেছে, আলতোভাবে পায়চারি করেছে, বেরিয়ে অশ্বিনীবাবুর ঘরে ঢুকে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়েছে, নিচে ডাক্তারের দরজা অব্দি গেছে, আবার ফিরে এসেছে। অশ্বিনীবাবু খুব বেশিক্ষণ নিশ্চয় কথা বলেন নি। বেশিরভাগ সম্ভাবনা ব্যোমকেশ পুরোটাই শুনেছে। অশ্বিনীবাবু খুব আতঙ্কে ডেলিরিয়াস ছিলেন, এমন কোনো সঙ্কেত নেই, একটু আগেই দরজায় কান পেতে ধরা পড়ে স্মার্টলি ডজ করেছেন। ব্যোমকেশ ঘুমিয়ে পড়েছিল, ওঁদের কথায় চটকা ভেঙে গেছে বলেছিল। সেটা কথার শুরুতেই হওয়ার কথা, অশ্বিনীবাবু উত্তেজিত ছিলেন। ব্যোমকেশও বাস্তবে সারাদিন চাকরি খুঁজে ক্লান্ত ছিল না, যে নিঃসাড়ে ঘুমোবে। অস্যার্থ, অশ্বিনীবাবুর সে রাতে জীবন সংশয়, ব্যোমকেশের আন্দাজ করার কথা। ডাক্তার অলরেডি সন্দেহের তালিকায় এসে গেছেন, হাজার টাকার নোটের খবরে চোখেমুখে লোভ দেখিয়ে দিয়ে। সুতরাং সজাগ থাকলে সেই রাতেই রেড হ্যান্ডেড ধরার সুযোগ ছিল, এবং একটা খুন কম হওয়ার।
সীমন্ত হীরা
একটাই কৌতূহল মেটে নি। ব্যোমকেশের বাড়ি থেকে নটরাজ পুতুল পাল্টে নিতে বিকেলে কি স্যর দিগিন নিজেই এসেছিলেন, নাকি তাঁর কোনো এজেন্ট? সেই সময়ে ব্যোমকেশরা ও বাড়ি গিয়ে জেনেছিল যে কর্তা বাড়ি নেই। এবং শেষে ব্যোমকেশ জানায়, "তারপর আর একটা ঠিক ওই রকম মূর্তি তৈরি করে কাল সন্ধ্যেবেলা গিয়ে আসলটার সঙ্গে বদল করে এনেছিল।" অর্থাৎ স্যর দিগিন নিজেই। তো, ব্যোমকেশ যেহেতু নিজের বাড়িতেই বুঝে যায় যে মূর্তি বদল হয়েছে, চাকরকে একবারও জিজ্ঞেস করা হবে না আগন্তুকের চেহারার বিবরণ? স্যর দিগিনের যা বর্ণনা, ও চেহারা মিস করা অসম্ভব। গল্প তো ওখানেই নিশ্চিত হয়ে যায়, শেষে 'শাস্ত্রের অনুমান-খণ্ডটা একেবারে মিথ্যা' বলার প্রয়োজনই পড়ে না।
অর্থমনর্থম
১, মৃতদেহের পাশে রাখা অনাস্বাদিত চা। ব্যোমকেশ অনেকক্ষণ দেখে তারপর তা হাতে তুলে চুমুক দিল। খুব বিপজ্জনক এবং অ্যামেচার কাজ হয়ে গেল না? ফরেন্সিক তদন্ত সেযুগে কলকাতা পুলিশ পুরোদমে করছে অলরেডি।
২, ফণী একজন পাকা গ্রন্থকীট। সব বই-ই দাগ দিয়ে পড়ে। বিভিন্ন স্থানেই দাগ দেয়। গ্রে অ্যানাটমি বইয়ে শুধুমাত্র একটি স্থানেই দাগ দেয়। ব্যোমকেশ আবার সুকুমারকে প্রশ্ন করতে করতেই আলগোছে দেখতে থাকে এবং খুঁজে পায় যে সারা বইতে মাত্র ওই কয়টি লাইনেই দাগ দেওয়া। গ্রে অ্যানাটমি বইয়ের যা অতিকায় ভলিউম, এই কাজটাই যথেষ্ট কঠিন।
চোরাবালি
১, যে স্থানে চোরাবালি, তার খুব কাছেই জঙ্গল ও ঘাসজমি। সেখানে রাখাল ছেলেরা নিয়মিত গরু চরাতে আসে, হিমাংশুবাবু শিকারে আসেন, আরো দশজন আসতেই পারে। এবং এককালে কোনো সদাশয় জমিদার তাকে ঘিরে বাঁধও বানিয়েছেন, যা নাকি সবাই ভুলে গেছে। শুধু সেটা আবিষ্কার করতে পারেন কুটীরবাসী কাপালিক আর শিকারে হঠাৎ আসা অজিত-ব্যোমকেশ। এমনকি দিনরাত শিকার করে বেড়ানো জমিদারের গুলি লেগে কোনো পাখি সে বালিতে পড়ে না।
২, জমিদারের তালুক মুলুক বন্ধক দিয়ে মহাজনের কাছে টাকা নেন, সে তমসুক মহাজন কালীগতি দেওয়ানকে রেজিস্ট্রি করে বিক্রি করেন। অর্থাৎ, রেজিস্ট্রি অফিসে কিন্তু কালীগতির নামেই রয়েছে। এবং কালীগতির স্ত্রী আছেন দেশের বাড়িতে, তিনিই ওয়ারিশ। এমতাবস্থায় ব্যোমকেশের পরামর্শ: "ওগুলো এখন ছিঁড়ে ফেলতে পারেন, কারণ কালীগতি আর আপনার কাছ থেকে টাকা আদায় করতে আসবেন না।" অ্যামেচার সাজেশন।
উপসংহার
এটা ঠিক গোয়েন্দার প্রতি খটকা না, অপরাধীর প্রতি। অনুকূল ডাক্তার ব্যোমকেশের মেসে এসে উঠেছিলেন চিঠি পেয়ে ব্যোমকেশের মুখভাব দেখে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে। যথেষ্ট ঝুঁকি নিয়েছেন। অথচ দেখা করার আগেই, চিঠি ব্যোমকেশের হাতে আসার আগেই ট্রামে দেশলাই বদলে দিয়েছেন। ব্যোমকেশ যদি ট্রাম থেকে নেমেই সিগারেট ধরাত সেই কালান্তক কাঠিটি বের করে? হাবুল আর রেখার ক্ষেত্রে কিন্তু প্রথম কাঠিটিই ছিল মৃত্যুবাণ। প্রতিহিংসার আনন্দ পেতে যে পরিমাণ কাঠখড় পোড়ানো হয়েছিল, তাতেই অনুকূলবাবু ধরা পড়েন। অথচ প্রতিহিংসার আনন্দ নাও পেতে পারেন, এমন প্ল্যান ছিল অনুকূলবাবুর।
সত্যান্বেষীতে অশ্বিনীবাবুর আতঙ্কটা ভালই ফোটান হয়েছিল। যেটা "স্মার্টলি ডজ" বলা হয়েছে, সেটা তো আমার খুবই এমেচারিশ, অপ্রস্তুত ডজ মনে হয়েছে, যেটা উদভ্রান্ত লোকেরা করে থাকে।
সীমন্ত হীরায় স্যার দিগিনের লোক এসেছিল। ইঙ্গিত আছে না বর্ণনা থেকে আমি ধরে নিয়েছি, মনে নেই।
শেষের অনুকূলবাবুর খটকাটা বুঝলাম না। বাকিগুলো ঠিকই মনে হল।