“বিজেপিকে একটিও ভোট নয়” বলবার অধিকার কি অ্যামেরিকাপ্রবাসী একজন ভারতীয়র আছে? এমন বললে কি ভারতের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক গলান হবে? রিহানা, গ্রেটার নাক গলানোর অধিকার থাকুক বা না থাকুক, প্রতিটি ভারতীয়-জন্মদ্ভুত নাগরিক-অনাগরিকদেরই সেই অধিকার আছে। এটা তাদের জন্মগত অধিকার। তাই “বিজেপি কে একটাও ভোট নয়” বলার সম্পূর্ণ অধিকার আমার আছে। তাই আবার বলি, বিজেপিকে একটিও ভোট দেবেন না। কেন দেবেনা? একটাই কারণ, না আসলে দুটো কারণ; সিএএ আর এনারসি। বাকি কারণগুলো তুচ্ছ যা সব রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধেই প্রয়োগ করা যায়। বাজে বিল বানানো, বাজে বাজেট বানানো; এগুলো চিরন্তন রাজনীতি। পৃথিবীতে এমন কোন গণতন্ত্র নেই যেখানে সব বিল, সব বাজেট নিখুঁত। কাকে ভোট দিয়ে জেতালেন তার ওপর নির্ভর করে কি বিল, কি বাজেট চান। পছন্দ না হলে পরের ভোটে সেই দলকে তাড়িয়ে দিতে পারেন। এটাই গণতন্ত্র। কিন্তু এমন যদি হয় যে আপনার ভোটাধিকারই কেড়ে নেওয়া হল বা কৌশল করে, সবার নয়, বেছে বেছে তাদের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হল যারা ভোট দিলে গণতন্ত্র শক্তিশালী হয়ে যাবে। তখন কি করবেন? সিএএ আর এনারসির লক্ষ্য ঠিক তাই। সিএএ আর এনারসি হল অ্যামেরিকার “ভোটার সাপ্রেসনের” ভারতীয় সংস্করণ। দুটোর একটাই উদ্দেশ্য: ভোটাধিকার হনন এবং হরণ। প্রতিটি ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক দল সর্বগ্রাসীতা চাপিয়ে দেওয়ার জন্য গণতন্ত্রকে দুর্বল করতে আর বহুত্ববাদকে ধ্বংস করতে ভোটাধিকার হননের নানান ফাঁদ পাতে। সিএএ আর এনারসি হল এমনই এক ফাঁদ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, রিপাবলিকান পার্টি কৃষ্ণাঙ্গ এবং ল্যাটিনো ভোট দমন করতে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা প্রয়োগ করে। নিখুঁত গবেষণার ভিত্তিতে তৈরি করা হয় সেসব আইন যার লক্ষ্য প্রান্তিক সম্প্রদায়ের মৌলিক অধিকার হনন, যেমন ভোটাধিকার। এই আইনগুলি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নিষ্প্রভ বলে মনে হয়। কখনো কখনো সর্বজনীন বলেও মনে হয়। উদাহরণস্বরূপ "ভোটার পরিচয়পত্র"। গড় আমেরিকানদের কাছে বা যে কোন নাগরিকের কাছে, বিশেষ করে প্রভাবশালী সম্প্রদায়ের মানুষদের কাছে, এটা যুক্তিযুক্ত মনে হবে। তারা বলবে, হ্যাঁ, ভোট দেওয়ার জন্য অবশ্যই কোনও পরিচয়পত্র থাকা উচিত, না হলে তো যে কেউ ভোট দিয়ে দিতে পারে। কিন্তু বাস্তব তা মোটেই নয়। বিধায়করা জানেন যে জনগণের নির্দিষ্ট অংশের পক্ষে, বিশেষ করে নিগৃহীত সম্প্রদায়ের নাগরিকদের পক্ষে পরিচয়পত্র জোগাড় করা অত্যন্ত কঠিন কারণ তাদের বেশিরভাগেরই নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য যথাযথ দলিল নেই। অনেক প্রভাবশালী সম্প্রদায়ের মানুষদের কাছেও নেই, কিন্তু তাদের সামাজিক প্রভাবই তাদের পরিচয়পত্র। বিধায়করা এটাও জানেন যে নিগৃহীত জনগোষ্ঠী স্বাভাবিক কারণেই সর্বগ্রাসী ফ্যাসিস্ট উচ্চাকাঙ্ক্ষার বিরোধী। তাই এদের ভোটাধিকার লঙ্ঘন করতে পারলেই ফ্যাসিস্ট রাজনৈতিক দলের বিপুল জয়। আধুনিক তুরস্ক আর রাশিয়ার দিকে নজর দিলেই দেখা যায় গণতন্ত্রের অবয়বে কেমন করে ফাসিজমের প্রতিপত্তি ঘটে থাকে।
সিএএ, এনারসি ইত্যাদি অসাংবিধানিক। তবু ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের কেন্দ্রীকরণ হয়নি বলে (বহু ভাল কারণে), রাজ্য সরকারের মদতে কিছু রাজ্যে সিএএ-এনারসি কার্যকর করা সহজ, যেমন হয়েছে আসামে। “আমরা-ওরা”র ঘৃণা ভারতীয় সমাজে নতুন কিছু নয়। কিন্তু সেই ঘৃণা রাজনৈতিক পন্থায় ভারতীয় সিস্টেমে প্রবর্তন করার ঘৃণ্য প্রয়াস ভারতে এই প্রথম। সিএএ-এনারসি একবার সিস্টেমে প্রবেশ করলে “আমরা-ওরা”র ঘৃণ্য এবং সম্পূর্ণ অ-ভারতীয় রাজনীতি থেকে দেশবাসীর মুক্তি প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠবে। সামাজিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই করা সহজ নয়, কিন্তু সিস্টেমিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই তার চেয়েও কঠিন। সিস্টেমিক নিপীড়ন প্রতিটি নাগরিকের জীবন দুর্বিষহ করে না, করে সেইসকল নাগরিকদের যাদের জীবনের ওপর সামাজিক এবং রাজনৈতিক দৌরাত্ম্য প্রজন্মগত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এর প্রধান উদাহরণ যেখানে সিস্টেমিক নিপীড়ন প্রায় 200 বছর আগে চালু হয়েছিল যার সংশোধনের কাজ এখনও দুরস্ত।
এখন প্রশ্ন হল এই সিস্টেমিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই কীভাবে সম্ভব? বিজেপির সর্বগ্রাসী ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে, সিএএ-এনারসির বিরুদ্ধে, নাগরিক অধিকার হরণের প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে, প্রবল পরাক্রমি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ লড়বে কি শক্তি নিয়ে? সর্বগ্রাসী শক্তিকে পরাজিত করার সফল মডেল যে একেবারে অস্তিত্বহীন তা নয়। ভারতের ইতিহাসেই আছে তার অধিষ্ঠান: গান্ধী মডেল। আর আছে সদ্য জয়ী জর্জিয়ার স্টেসি আব্রাম মডেল যা গান্ধীর মডেলের আনুগত্যে যত্ন করে গড়া মডেল যা ট্রাম্পের ফ্যাসিবাদ ধুলন্ঠিত করেছে। ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে মানুষকে শিক্ষিত করার মতো সময় এখন আর নেই। ফ্যাসিবাদ পশ্চিমবাংলার দোরগোড়ায়। যারা এতদিনেও ফ্যাসিবাদ কি জানেন না, তারা কখনই জানবেন না। তাই এই মুহূর্তে কাজ একটাই। ফ্যাসিবাদের জবাব ব্যালট বক্সে। কোন দল "কম খারাপ" আর কোন দল "বেশি" এই নিয়ে বাজে তর্ক করার সময়ও আর নেই। এনারসি-সিএএর ফ্যাসিবাদী চক্রান্তের আর বিজেপির আগ্রাসনের একমাত্র প্রতিষেধক পূর্ণশক্তি প্রয়োগ করে ব্যালট বাক্সে বিজেপির গোসন্তানদের গো-হারান হারানো। বিজেপি কে একটিও ভোট নয়।