প্রয়াত শিক্ষকের সমাধির সামনে হাঁটু গেড়ে বসে আছেন একজন হাতজোড় করে। দু চোখে বইছে অশ্রুধারা।
ভিয়েনার এই বিশাল সমাধি ক্ষেত্রে একা বসে যিনি কাঁদছেন তাঁর নাম ইউসেবিও, ফুটবলের প্রবাদ পুরুষ। ১৯৬৬ সালে পরতুগালকে বিশ্ব কাপের কোয়ার্টার ফাইনালে নিয়ে যাবেন।
ইউসেবিও আজ কেবলমাত্র প্রণাম জানাতে আসেন নি। তিনি এসেছেন তাঁর প্রয়াত শিক্ষকের কাছে করুণা ভিক্ষা করতে। ভগ্ন কণ্ঠে তিনি অনুরোধ করছেন আমার প্রনম্য ফুটবল গুরু, ফিরিয়ে নাও তোমার অভিশাপ। আগামী কাল তোমার পুরনো দল বেনফিকা ইউরোপিয়ান কাপ ফাইনাল খেলবে মিলানের বিরুদ্ধে। শাপ নয়, আশীর্বাদ কর যেন বেনফিকা এ খেলায় জেতে।
পরের দিন ইউরোপিয়ান কাপ ফাইনালে বেনফিকা ১-০ গোলে হেরে গেল মিলানের কাছে। ১৯৬৫।
বেলা গুটমান ক্ষমা করেন নি। তাঁর শাপে বেনফিকা কখনো ইউরোপিয়ান কাপ জিতবে না।
বেলা গুটমান বুদাপেশটের এক ইহুদি পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন ১৮৯৯ সালে। বাবা মা দুজনেই নৃত্য শিক্ষায় খ্যাতি অর্জন করেছেন। বেলা সেটাই শিখলেন প্রথমে কিন্তু পরে মন গেলো ফুটবলে। এম টি কে হুঙ্গারিয়া দলের হয়ে খেলে দু বার লীগ জেতার সম্মান পেলেন। গেলেন ভিয়েনা। সেখানে লীগ জিতলেন হাকয়া নামের একটি ইহুদি দলের পক্ষে খেলে। ১৯২৪ সালে হাঙ্গেরির জাতীয় দলের জার্সি পরে খেললেন প্যারিস অলিম্পিকে। কখনো চুপ চাপ থাকার মানুষ ছিলেন না। বেলা গুটমান অভিযোগ জানালেন। প্যারিসে খেলোয়াড়ের চেয়ে বেশি কর্মকর্তা এসেছেন। সে রকম একজন কর্মকর্তার ঘরের সামনে মরা ইঁদুর ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন। কিছু দিন নিউইয়র্কে খেলেছেন। তারপর হাঙ্গেরিতে ফিরে কোচিং। সালটা ১৯৩৯। ইহুদি নিধন শুরু হয়েছে কিন্তু হাঙ্গেরিতে কিছু হয় নি। ১৯৪৪ সালে জার্মানরা হাঙ্গেরি দখল করে। গুটমান ধরা পড়লেন। অতএব কনসেনট্রেশান ক্যাম্প। বাকি পরিবার আউশউইতসের অগ্নিকুণ্ডে বলি। তিনি কোনমতে প্রাণটা বাঁচিয়ে আধমরা হয়ে ফিরলেন। যুদ্ধের পরে আবার হাঙ্গেরিতে কোচিং। সেটা ছেড়ে গেলেন রোমানিয়া কারণ তারা কোচের বেতন টাকায় নয়, খাবারে দিতেন। পায়ের তলায় চাকা। কোচিং করতে গেলেন ইতালি। এ সি মিলান ১৯টি ম্যাচ জেতার পরেও তাঁকে বরখাস্ত করা হয় প্রেসকে বেলা বলেন, কারণটা আমার জানা নেই। আমি ক্রিমিনাল নই। ব্রাজিল গেলেন। তারপর পর্তুগাল - প্রথমে পোরতো তারপর বেনফিকা।
পরের পর পর্তুগিজ লীগ জেতে বেনফিকা। ইউরোপিয়ান কাপ (আজকের চ্যাম্পিয়ন্স লীগের পিতামহ) পর পর দুবার ১৯৬১ সালে বেনফিকা হারাল বার্সেলোনাকে ১৯৬২ তে রিয়াল মাদ্রিদকে রিয়াল মাদ্রিদ তখন ইউরোপীয় ফুটবলের শীর্ষে হেরে যাওয়ার পরে প্রবাদ পুরুষ ৩৪ বছরের ফেরেঞ্চ পুসকাস তাঁর মাদ্রিদ জার্সি খুলে বেনফিকার বিশ বছর বয়েসি মোজাম্বিকান খেলোয়াড় ইউসেবিওকে পড়িয়ে দিয়ে বলেন "বেনফিকার এবং তোমার দিন আগত ওই আমরা অস্তাচলের সূর্য"।
পরপর দুবার ইউরোপিয়ান কাপ জিতে বেলা গুটমান তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে গেলেন বেনফিকা বোর্ডের সামনে। ঠিক কত টাকা বেতন বা বোনাস বৃদ্ধি দাবী করেছিলেন সেটা জানা যায় নি। তবে বোর্ডকে বলেছিলেন "আমার কথা শুনলেন না। এরপর একশ বছর কেটে যাবে বেনফিকা কোনোদিন ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ন হবে না"।
বেলা গুটমান দুর্বিনীত চঞ্চল, পরিব্রাজক অভদ্র অনেক কিছু নামে আখ্যাত হয়েছেন। কিন্তু আজকের ফারগুসন ভেঙ্গার মউরিনিও গারদিওলারা কোচ হিসেবে যে সম্মান পান তার পুরোধা বেলা গুটমান। কর্মকর্তা বা বোর্ড নয়, কোচ এক ফুটবলের টিমের ম্যাজিশিয়ান। ইউরোপীয় ফুটবল ইতিহাসে বেলা গুটমান এক অনমিত নাম।
অভিশাপের কি ফল হল?
এর তালিকাটি নিম্নরূপঃ
১৯৬১ ইউরোপিয়ান কাপ বিজয়ী বেনফিকা ৩-২ বারসেলোনা
১৯৬২ ইউরোপিয়ান কাপ বিজয়ী বেনফিকা ৫-৩ রিয়াল মাদ্রিদ
১৯৬৩ ইউরোপিয়ান কাপ বিজয়ী মিলান ২-১ বেনফিকা
১৯৬৫ ইউরোপিয়ান কাপ বিজয়ী মিলান ১-০ বেনফিকা
১৯৬৮ ইউরোপিয়ান কাপ বিজয়ী ম্যান ইউ ৪-১ বেনফিকা
১৯৮৩ ইউএফা কাপ বিজয়ী আন্দারলেখত ২-১ বেনফিকা
১৯৮৮ ইউরোপিয়ান কাপ বিজয়ীআইনডহোভেন ৬-৫ বেনফিকা
১৯৯০ ইউরোপিয়ান কাপ বিজয়ী মিলান ১-০ বেনফিকা
২০১৩ ইউরোপা লীগ বিজয়ী চেলসি ২-১ বেনফিকা
২০১৪ ইউরোপা লীগ বিজয় সেভিলা ৪-২ বেনফিকা
১৯৬২ সালে বেনফিকাকে যে শাপ দিয়েছিলেন বেলা গুটমান সেটা কাটতে ৪১ বছর বাকি।
বাঃ