এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • ১৬ নাম্বার গলি!   

    Bijoy Hansda লেখকের গ্রাহক হোন
    ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১ | ৮৫৩ বার পঠিত
  • সকাল দশটা বাজলেই কলকাতা শহরটা যেন ছুটোছুটি শুরু করে। বিভিন্ন রকমের মানুষের ও গাড়ির আওয়াজ। অফিস আদালত যাওয়া মানুষের ব্যস্ততা। ধাবমান বাস-অটোকে ধরার জন্য বৃথা প্রচেষ্টা প্রতি ক্ষণে ক্ষণে ঘটছে। এমন সময় একজন কুম্ভ মেলার মত মানুষের ভিড় সরিয়ে ধাবমান অটোর উদ্দেশ্যে বলল -

    “অটো অটো আটো -ও -ও -ও ...।”

    না! এটাও ধরতে পারলাম না! ধ‍্যাৎ! লাভের মধ্যে জুতোর ফিতেটাই ছিঁড়ে গেল। কিছুক্ষণ পর ভিড় কমলো। এমন সময় পিছনের দিক থেকে কেউ ডেকে উঠলো – “কাজল! কাজল!”। আরে এই দিকে। এই দিকে রাস্তার বিপরীত দিকে। চোখ পড়ল প্রবীরের উপর।

    প্রবীর - “রাস্তার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কী ভাবছিস? আর হাতে ওটা কী? জুতো? হাতে নিয়েছিস কেন?”
    কাজল- “অটো ধরতে গিয়ে জুতোর ফিতে ছিঁড়ে গেছে। তাই পাশের দোকান যাওয়া পর্যন্ত ফিতেটা কোন মতে লাগাবার চেষ্টা করছি। তাই অগত‍্য হাতে নিতে হল। গলায় কী ওটা? পরিচয় পত্র?”
    প্রবীর “হ‍্যাঁ”।
    কাজল –“দেখি দেখি। বাহ্! P. K. Banerjee অর্থাৎ প্রবীর কুমার ব্যানার্জি”, Mukherjee and Mukherjee Steel Company Private Limited.”
    প্রবীর - “কোথায় যাওয়া হচ্ছে আজ?”
    কাজল – “কাজের ব্যাপারে মামাকে কাগজপত্র দিতে যাচ্ছি”।
    প্রবীর - “বেশ! বিকেল চারটের সময় এখানে দেখা হবে আমি চললাম অটো আসছে”।
    কাজল - “আচ্ছা”।

    কাজল মামার বাড়ি থেকে ফেরার পথে হন্যে হয়ে কাজের খোঁজে এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াতে লাগলো। পরে ঠিক বিকেল চারটার সময় উপস্থিত হল নির্ধারিত জায়গায়।

    কাজল - “প্রবীর একশো টাকা দিবি? খুব খিদে পেয়েছে। ধার চাইছি। পরে দিয়ে দেব। কাজের জন্য এখানে ওখানে টাকা দিতে দিতে পকেট ফাঁকা হয়েছে।”

    পাশের দোকান থেকে এক ঠোঙা মুড়ি কিনে খেতে খেতে বহুবিধ আলোচনা হতে লাগল দুজনের মধ্যে। হঠাৎ প্রবীর বলে উঠলো “দেখ! পূর্ব-পশ্চিম কোণে মেঘ উঠেছে, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, বৃষ্টি হবেই হবে”। যথারীতি কিছুক্ষন পরে বাস এবং মেঘ ভাঙ্গা বৃষ্টি দুটোই এলো।

    প্রবীর - “চল চল! এটা ধরতে না পারলে একেবারে আটটা পঁয়তাল্লিশ।”

    বাসে ওঠার কিছুক্ষণ পরেই প্রবীর আমাশয় ধরা মুরগির মতো ঘুমে ঝিমোতে লাগলো। বাস কন্ড্রাকটার একের পর এক বাস স্টপের নাম ধরে হাঁক দিয়ে চলল - গৌরীতলা, মুখার্জী লেন, পটল ডাঙ্গা, ষোলো নাম্বার গলি।

    কাজল – “প্রবীর! প্রবীর! ষোলো নাম্বার গুলির সম্বন্ধে কিছু জানিস”।

    প্রবীর চোখ দুটো রসগোল্লোর মতো গোল গোল করে পাকিয়ে একথার উত্তর দিল “না”।

    প্রবীর - “না। তবে শুনেছি জায়গাটা ভালো না”।

    ষোলো নাম্বার গলির নাম শুনতেই একজন ভদ্রলোকের একটি সাদা মৃত চোখকে নিয়ে গোটা একশো একটি চোখ আমার দিকে কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল কোন যাত্রী ওই বাস স্টপেজে নামল না। জায়গাটার সম্বন্ধে কৌতুহল জাগলো মনের মধ্যে।

    কাজল - “প্রবীর ওঠ তোর বাড়ি পৌঁছে গেছে। কাল আবার দেখা হবে”।

    প্রায় পঞ্চাশ মিনিট পর বাস থেকে নেমে পড়লাম। ল্যাম্পপোস্টের আলো তখনো মিটমিট করে জ্বলছে। রাস্তার কুকুরগুলো রাস্তার মধ্যে ইতস্তত ভাবে আনাগোনা করছে। আর অচেনা মানুষকে দেখলেই ঘেউ ঘেউ করে ডাকছে। রাত্রির ন’টার সময় বাড়ি পৌঁছলাম। ভেতর থেকে মা ডেকে ওঠলো “খোকা বাড়ি এলি। বিশ্রাম নিয়ে বিকাশ জ‍্যেঠুর সঙ্গে দেখা করেন নিস”। বিশ্রাম নিয়ে উপস্থিত হলাম জ‍্যেঠুর বাড়িতে। বেশ বড় বাড়ি। ব‍্যাঙ্কের চাকরির টাকায় বাড়ি করেছেন।

    বিকাশ জ‍্যেঠু – “বাবা কাজল কাজের কোন খোঁজ নিচ্ছো? চেষ্টা করে যাও নিশ্চয়ই সফল হবে।”

    কাজল – “হ‍্যাঁ জ‍্যেঠু। চেষ্টার কোন ত্রুটি রাখছি না”।

    কথা চলল কিছুক্ষণ।

    কাজল - “জ‍্যেঠু আজ আসছি বড্ড ক্লান্ত লাগছে”।

    বিকাশজ‍্যেঠু – “বেশ বেশ”।

    পরে বেশ কয়েকদিন ধরে যাতায়াত করছি ষোলো নাম্বার গলির পাশ দিয়ে কিন্তু কোনো যাত্রী নামছে না। রহস্য বাড়িয়ে তুলল এই ব‍্যাপারটা। প্রশ্ন জাগল মনে কী হয় ষোলো নাম্বার গলির ভেতরে? দুই তিন বার গলিতে নামার চেষ্টা করলাম কিন্তু পারলাম না। প্রবীরকে এ বিষয়ে জানাতে প্রবীর বলল, “ষোলো নাম্বার গলির সম্পর্কে এতো তোর কৌতূহল কেন?”

    কাজল – “আমাকে রহস্য ভেদ করতে হবে যে ষোলো নাম্বার গলির”।
    অনেক জোরাজুরি করতে প্রবীর রাজি হলো ভেতরের রহস‍্যটাকে উন্মোচনের সঙ্গী হতে।

    শনিবার বিকেল বেলা যথাসময়ে বাসের সহযাত্রীদের নিরাশ করে নেমে পড়লাম ষোলো নাম্বার গলির রাস্তায়। তার আগে আমরা নিজেদের চোখ-মুখ-নাক-কান আচ্ছাদনে ঢেকে নিয়েছি যাতে না কেউ চিনতে পারে। গলির ল্যাম্পপোস্টের আলো টিমটিম করে জ্বলছে আর রাস্তার ধারে পুরুষের আনাগোনা অনবরত বেড়েই চলছে। কিছুদূর এগিয়ে যেতেই বুঝতে পারলাম আমরা কোথায় এসেছি। রাস্তার ধারে মধ্য-বয়স্ক – কুড়ি একুশ বয়সের মেয়েরা হাত নেড়ে নেড়ে ডাকছে। মেয়েগুলোর শাড়ি হাঁটু পর্যন্ত তোলা, কাঁচুলিটি বুকের থেকে সরিয়ে দোলা পাকিয়ে হাঁটু আর শায়ার মাঝখানে রাখা, স্তন যুগলের অর্ধেকাংশ বাইরে বেরিয়ে। চোখে যেন নেশা ধারা। আর বলছে – “এই ছোকরা এই দিকে, এই দিকে।” একবার প্রবীরের হাত কোনো একজন মধ্যবয়সী মহিলা টেনে বলল “আয় নারে ছোকরা, আয় না”।

    — “না না দিদি আমি ওই ধরনের ছেলে নই”।

    — “শালা বাঞ্চৎ ওই ধরনের ছেলে নয়তো এসেছিস কেন এখানে? এটা শুধু ভোগের জায়গা। মাঝে কোনো দিদি বোনের সম্পর্ক আনবি না”।

    প্রবীর - “কাজল বাঁচা আমাকে”। জোরপূর্বক প্রবীরের হাত ছাড়িয়ে এগিয়ে চললাম আরও গলির ভেতরের দিকে।

    প্রবীর – “এই তাহলে ষোলো নম্বর গলির রহস্য? আমি আর এক মুহূর্ত থাকতে চাই না এখানে। চল বাড়ি ফিরে যাই”‌।

    সামান্য একটু দূরে ল্যাম্পোস্টের নিচে একটি ষোলো বছরের মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কাছে যেতেই বলল, “আমাকে কিছু টাকা দিন। তার বিনিময়ে আমার শরীর ভোগ করুন। গত দুই তিন দিন ধরে আমি কিছুই খাইনি। দয়া করুন আমাকে।”।

    প্রবীর – “কাজল আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। গলির ভেতরে আর এক মুহূর্ত থাকতে চাই না”।

    মেয়েটির চোখেটি টানটান কাজল কালো হরিণী চোখের মতো। মায়া হল চোখের দিকে তাকিয়ে। দু’শো টাকা বাড়িয়ে দিলাম। টাকা দিয়ে অন্য রাস্তায় এগিয়ে যেতেই মেয়েটি বলল, “বাবু যার জন্য টাকা দিলেন সেই কাজটি না করেই চলে যাচ্ছেন। দান নিব না।”

    কাজল – “রেখে দাও”।

    কয়েক মুহুর্ত পরেই গলির পিছনের দিক থেকে তিন-চারটে যুবক দৌড়ে আসছে। পেছনে ভারি বুটের আওয়াজ ভেসে আসছে।

    প্রবীর - “কাজল পালা। পুলিশ”।

    বলেই দৌড় শুরু করলো। তার পেছন পেছন আমিও দৌড়ালাম। এক দৌড়ে পৌঁছলাম ষোল নাম্বর গলির বাসস্টপে।

    প্রবীর - “তোর ষোলো নম্বর গলির রহস্য ভেদ হয়ে গেছে আর কক্ষনো এ গলির দিকে পা মাড়াস না”।

    কাজল - “সময়?”

    প্রবীর - “এগারোটা দশ”

    ঐদিন রাতে কোনরকমে এতো রাত পর্যন্ত বাড়ির বাইরে থাকার ব্যাপারটি মাকে এটা ওটা বলে বুঝিয়ে দিয়েছিলাম। রাত্রে ঘুমাতে গেলে মনে পড়তো টানটান কালো কাজল চোখ অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দুটো টাকার আশায়।

    তার কয়েকদিন পর থেকেই লোক-চক্ষুর আড়াল হয়ে বিকেলবেলা আবার হাজির হতাম ষোলো নম্বর গলিতে। আর একদিন মেয়েটিকে বললাম, “তুমি আর কখনো এই গলিতে দাঁড়াবে না। তোমার প্রতিদিনের খরচ বাবদ দুশো টাকা করে আমি দিয়ে যাবো। কিন্তু তুমি এই গলিতে আর দাঁড়াবে না।”

    — আপনার নাম কী?
    — কাজল। আর তোমার নাম?
    — আপনার আগে কোনো খদ্দের কেউ তো কক্ষনো নাম জিজ্ঞাসা করে নাই। শুধু রাতের মত অন্ধকারে শরীরের চাহিদা মিটিয়ে চলে যায়। আপনি নাম জেনে কি করবেন বাবু?
    — আমি তো খোদ্দের নয়।
    — আমার নাম মালতি। মা নেই। বাবা অন্ধ। পোড়া পেটের জ্বালায় গ্রামের একজন মামা আমাকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে বলেছিল এখানে নাকি টাকা ওড়ে! শুধু ধরতে পারলেই হয়। তাই আমিও টাকা ধরার চেষ্টা কচ্ছি। আর আপনি আমার খোঁজ খবর লিয়ে কী করবেন? আপনি সভ্য সমাজের মানুষ আর আমি এই গলির অন্ধকারের মানুষ। একটি বেশ‍্যা মাইয়ার প্রতি আপনার এত দয়া কেনে?
    — জানি না।
    — কেন রে বাবু তুই কি আমার সঙ্গে পিরিত করবি ? মনে রাখবি বাবু বেশ‍্যার সঙ্গে শরীরের পিরিত হয়। মনের পিরিত হয় না। আর বিহা? সে তো অনেক দূরের কতা। আমাকে তোদের মত ভদ্র সমাজের মানুষ ঘিণা করে। আর যাই হোক বাড়ির বউ করে লিয়ে যাবে না।
    — আজ আসি কাল আবার আসবো। আর তুমি চোখে কাজল আঁকবে। বেশ মানাবে তোমার চোখে। আমি এনে দেব।

    এইভাবে দু’মাস আসা যাওয়া শুরু হলো। তার সঙ্গে সঙ্গে আমারও টাকার সংকট দেখা দিতে শুরু করল। যা হোক হবে তবুও মালতিকে ওই গলিতে আর দাঁড়াতে দেব না। জন্মদিনে মায়ের দেওয়া সোনার হারটা বিক্রি হল টাকার অভাবে। তার পিছু পিছু বাবার দেওয়া হাত ঘড়িটাও চলে গেল। তবুও কোন রকমে দিন কাটতে থাকলো।

    একদিন হঠাৎ দেখলাম বিকাশ জ‍্যেঠু গলির রাস্তা ধরে হাঁটছেন! একটু এগিয়ে একটি বাড়িতে প্রবেশ করল আর আলোটা নিভে গেল। ভাবতেই পারলাম না বাইরের চাকচিক্যের জৌলুসে ভেতরের ঝিঙে বিচির মতো কালো ঘুটঘুটে একটি অন্ধকারের জগৎ আছে।

    রবিবার দিন দুপুর থেকেই মেঘ করে আছে চাপা চাপা ভাব যেন। বহুদিনের ভাঙা ছাতাটা নিতে ভুল হলনা। বিকেল বেলা বাসস্ট্যান্ডে প্রবীরের সাথে হঠাৎ দেখা। পেছন থেকে প্রবীর পিঠ চাপড়ে বলল – “কাজল কোথায় থাকিস? দেখতে পাচ্ছি না কয়েকদিন ধরে”।

    — (আমতা আমতা করে) না ওই এখানে! ওই যে ওই! কাজের খোঁজে ঘুরে বেড়াচ্ছি।
    — পরিষ্কার করে কিছু বলছিস না কেন ভাই। কী হয়েছে বল?
    — চল রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে বলছি। আমি গত কয়েক মাস ধরে ষোলো নম্বর গলিতে যাতায়াত করছি।

    কথাটা শোনামাত্র প্রবীরের মুখটা কেমন যেন সারা রাতে একটু একটু বাতাস বেরোনো বেলুনের মতো চুপসে গেল। চোখের দৃষ্টিতে ঘৃণা ঝরে পড়ছে মনে হল। অনেক্ষণ পর প্রবীর বলল, “তুই একজন সৎ ভদ্র বাড়ির সন্তান। ওখানে যাওয়া তোর মানায় না। সমাজ তোর দিকে ছিঃ ছিঃ বলে আঙুল তুলবে।”

    — সমাজ! সৎ ব‍্যক্তি! আজ দেখলাম বিকাশ জ‍্যেঠুকে গলির রাস্তার।
    — বলিস কী?
    — হ‍্যাঁ। ওই জ‍্যেঠুই আবার গীতার শ্লোক আউড়ে আমাকে জ্ঞান দিয়ে বলে ‘সৎ ব‍্যক্তি হও, অসৎ কর্ম করিও না'।
    — অতসব জানি না আমার মনে হয় তোর ওখানে আর যাওয়া উচিত হবে না। কেন যাস ওখানে?
    — ওর হাসি দেখতে। ওর হাসিটা একেবারে বুকের মাঝখান দিয়ে এসে হৃদয়ে শেলের মতো বিঁধে। আমি ভেবে পাই না শত কষ্টের মধ্যেও ওই পবিত্র হাসি কোথা থেকে আসে?
    — কী নাম ওর ভাই?
    — মেয়েটির নাম মালতী। জানিস ভাই, ও বড় অসহায়, বড় ভালো মেয়ে। পরিস্থিতি ওকে রাস্তায় দাঁড় করিয়েছে।
    — একটা সত্যি কথা বলত ভাই, তুই কি ভালোবাসিস ওকে?
    — ভালোবাসি কিনা জানি না? তবে ওকে বলেছি গলিতে আর না দাঁড়াতে। কেন জানিনা বড় কষ্ট হয় আমার যখন রাত্রির অন্ধকারে রক্তচোষা বাদুড়ের মতো কামার্ত মানুষ গুলো মালতির শরীর চুষে খাচ্ছে এই কথা ভাবা হয়ে যায়। তাই ওকে সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনার জন‍্য চেষ্টা করছি। তাই ওকে দু’শো টাকা করে দিই প্রতিদিন।
    — তুই তাহলে ওর দায়িত্ব নিয়েছিস বল!
    — না।
    — বুঝতে পারছি ভাই তোর মনে টানাপোড়েন চলছে।
    — জানি না আর কত দিন ওকে টাকা দিয়ে সাহায্য করতে পারবো। না আজ আসি। মেঘ করেছে বোধহয় বৃষ্টি হবে।

    আজ সাতটা বেজে গেছে ভাই আজ না হলে আর যাস না। মুষলধারায় বৃষ্টি হতে পারে বলে মনে হচ্ছে। মেঘ তো দুপুর থেকেই আছে। কিন্তু আমাকে যেতেই হবে ভাই। আমার জন্য হয়তো মালতি অধীর আগ্রহে পথ চেয়ে বসে আছে। আমি না গেলে ওদের ঘরে হাঁড়ি চড়বে না।

    — ঠিক আছে তবে। সাবধানে যাস।

    মুষলধারায় বৃষ্টি নেমেছে কাজল মাথায় পুরনো একটা সিক ভাঙ্গা ছাতা নিয়ে হাতে পলিথিনে মোড়া চালের ব‍্যাগ। মালতি চালের ব‍্যাগ হাতে নিয়ে বলল, “আজ না এলেই পারতে”।

    — কথা দিয়েছে যে, না এসে থাকতে পারি?

    ভেতরে ঢুকে দেখি চাল ভেদ করে আসা বৃষ্টির জল আটকে রাখার জন্য ঘরের মধ্যে তিনটি পাত্র বসানো আছে। একটি মাত্র লম্ফতে আলোর ব্যবস্থা তাও যেন কেরোসিনের প্রত্যাশী, নিবু নিবু প্রায়। এরই মধ্যে একটু শুকনো জায়গা দেখে একটি বস্তার বান্ডিলের উপরে বসতে দিয়ে মালতি ভাতের হাঁড়িতে জল দিতে দিতে বলল, “বাবু আর এখানে আসবেন না। আপনাকে লোকে খারাপ বলবে”।

    — আমাকে নাম ধরে ডাকবে। আমার নাম কাজল। লম্ফের আলোতে চোখ পড়ল মালতির চোখের দিকে। জিজ্ঞাসা করলাম চোখে কাজল নেই কেন?
    — কাজল পরা ছেড়ে দিয়াছি। চোখের কাজল তো আমার সামনে।
    — অনেক রাত্রি হল আজ আসি। আবার কাল আসবে।
    — আপনাকে একটা কথা বলার ছিল।
    — না আজ থাক। কাল শুনবো।

    কথাট শুনেই মালতির মুখটি লম্ফের আলতেও কেমন যেন নীল মনে হল।
    মালতি শুধু বলল “আচ্ছা”।

    মালতির থেকে বিদায় নিয়ে রাত্রি দশটার সময় বাড়ি ফিরলাম। বাড়ি প্রবেশ করতেই মা বললেন “কোথায় ছিলি এই মুষলধারা বৃষ্টির মধ্যে? তোর মামা ফোন করেছিল। তোর জন্য কী একটা কাজের বন্দোবস্ত করেছে। কালকে যেতে হবে বিলাসপুর।

    — কালকেই যেতে হবে মা?
    — হ‍্যাঁ কালকেই যেতে হবে। আজকে জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখিস আর প্রবীরকে ডেকে নিস স্টেশন পর্যন্ত ছেড়ে দিয়ে আসবে।

    সকাল দশটার সময় প্রবীর বাড়িতে উপস্থিত। আসামাত্রই আমাকে তাড়াতাড়ির তাগাদা দিতে শুরু করল। সে বলল, “আর কত সময় নিবি। দেরি করলে আর দু’ঘণ্টা দেরি হবে।“
    — আমি তৈরি। দুই মিনিট ...।
    বাবা মায়ের আর্শীবাদ নিয়ে স্টেশনের দিকে রওনা দিলাম।

    অটো থেকে নেমেই স্টেশনে ঢোকার সিঁড়িতে দাঁড়িয়েই কাজল বলল, “প্রবীর! প্রবীর! আমার একটা কাজ করে বাকি আছে তুই সেটা করে দিতে পারবি? শুধু কাজ নয় এটা গুরু দায়িত্ব বলতে পারিস। মালতি আজও হয়তো আমার পথ চেয়ে বসে থাকবে। তুই এই এক হাজার টাকা মালতির হাতে দিয়ে বলিস কথা রাখতে পারেনি কাজল। আমাকে যেন ক্ষমা করে দেয়।“

    — তুই আমাকে ওই নরকে যেত বলছিস? অন্য কেউ বললে যেতাম না। নেহাত তুই আমার বন্ধু তাই না করতে পারবো না। ঠিক আছে বলে দেব। ওই ট্রেন আসছে। যা যা পৌঁছে আমাকে একটা Text বা ফোন করেদিস।

    ট্রেনের জানলার ধারে সিটে বসলাম। গার্ডের হুইসেল বুকের ভেতর নাড়িয়ে দিল। ট্রেন চলতে শুরু করল আর আস্তে আস্তে আমার পরিচিত শহরটা নীল আকাশের কোলে হারিয়ে গেল।শুধু মনে পড়তে থাকলো মালতির মুখ আর অকৃত্রিম হাসিটা। আজও কি আমার জন্য মালতি পথ চেয়ে বসে থাকবে? আমার জন্য কি চোখের কোণে এক অশ্রু বিন্দু দেখা দেবে? যদিও বা অশ্রু বিন্দু আসে মুছে দেবে কে? চোখের অশ্রু বিন্দু চোখেই শুকিয়ে যাবে। মালতি কী কথা বলতে চেয়েছিল আমাকে? শোনা হল না তার শেষ কথা। এক হাজার টাকা কত দিন চলবে? দুই দিন-তিন দিন। তারপর? সৎ ভাবে বেঁচে ওঠা হয়ে উঠবে না। আবার পচা দুর্গন্ধ যুক্ত পাঁকে ডুবে যাবে। ফিরে যাবে ষোলো নাম্বার গলির রাস্তায়! পোড়া পেট আর নিবু নিবু সংসারের বাতির জন্য দা়ঁড়াবে ল্যাম্পোস্টের নিচে দেহবিক্রি করে একটু আলোর খোঁজে। দুটো টাকার জন্য। কিংবা...

    ট্রেনের শব্দের মাঝে সে যেন শুনতে পাচ্ছে আবার মিলিয়ে যাচ্ছে, ‘গত দুই-তিন দিন...... কিছুই খাইনি...। আমাকে কিছু টাকা দিন... বিনিময়ে আমার শরীর ভোগ...'

    ----
    *** গল্পের কেন্দ্রীয় স্থান বাস্তব শুধু নাম পরিবর্তিত তৎসঙ্গে কেন্দ্রীয় চরিত্রও (কাজল, প্রবীর) বাস্তব কোনো কল্পনা প্রসূত নয়। শুধু নাম পরিবর্তিত।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঝপাঝপ প্রতিক্রিয়া দিন