আমরা একজন নিভৃত নীরব শিল্পীর জন্মশতবর্ষ তারই স্বভাবপ্রকৃতির মতো নিঃশব্দে পেরিয়ে এলাম। অতিমারি আমাদের কতকিছু ভুলিয়ে দেওয়ার মতো এমন একটি সঙ্গীতসাধকের জন্মশতবর্ষও ভুলিয়ে দিল, এটা ভাবতেই একজন সঙ্গীতানুরাগী মানুষ হয়ে অন্তর্দহনে দগ্ধ হতেই হচ্ছে। জানিনা, আর কতদিনই বা আমরা এমনই আত্মবিস্মৃত থাকবো।
এই অসামান্য নিভৃত সঙ্গীতসাধকের জন্ম ১৯২০ সালের ২০ অক্টোবর। তার আদি বাড়ি নদিয়ার রানাঘাট আর বড় হওয়া চাকদার মামাবাড়িতে। মামা কালিদাস গুহ-র জন্যেই সঙ্গীতের প্রতি ঝোঁক, একনিষ্ঠতা। কয়েক বছর পর, কলকাতার ভবানীপুরে চলে আসা। সেখান থেকেই শিল্পী হয়ে ওঠার সূচনা। প্রথম সঙ্গীতশিক্ষক মামা কালিদাস গুহ। কলকাতায় এসে তালিম পেলেন একে একে নিরাপদ মুখোপাধ্যায়, সঙ্গীতাচার্য তারাপদ চক্রবর্তী, পণ্ডিত চিন্ময় লাহিড়ীর মতো গুণিজনদের কাছে। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে গভীর দক্ষতা অর্জন করার জন্যই হয়তোবা, পরিবেশনায় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত তাঁর ছায়াসঙ্গীই হয়ে রইলো, সেভাবে প্রকাশ পেল না। কিন্তু, তাতে কি, নিজস্ব গায়কীতে বাংলা আধুনিক গানে তিনি হয়ে উঠলেন অনন্য।
কলকাতা বেতারে গান গাওয়া দিয়ে (১৯৪৪-৪৫) শুরু হয় তার সঙ্গীতযাত্রা। ১৯৪৭-এ প্রথম রেকর্ড। সন্তোষ মুখোপাধ্যায়ের সুরে গানদু’টি — ‘একটি কুসুম যবে’ এবং ‘আমার কাননে ফুটেছিল ফুল’। প্রথমটির গীতিকার অখিলবন্ধু নিজেই, দ্বিতীয়টি ব্যোমকেশ লাহিড়ীর লেখা। এর পর কয়েকটি রেকর্ড পেরিয়ে ছ’নম্বর রেকর্ডে (১৯৫৩) উজ্জ্বল হয়ে উঠলেন তিনি। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায় গাইলেন, ‘মায়ামৃগ সম’ এবং ‘কেন প্রহর না যেতে’, সুরকার যথাক্রমে দুর্গা সেন ও দিলীপ সরকার। এই রেকর্ড থেকেই তার প্রতিভার জাত চেনালেন শিল্পী।
‘শিপ্রা নদীর তীরে’, ‘কবে আছি কবে নেই’, ‘এমনি দিনে মা যে আমার’, ‘তোমার ভুবনে ফুলের মেলা, আমি কাঁদি সাহারায়’... প্রতিটি জনপ্রিয় গানই তাঁর নিজের সুর করা। কয়েকটি গানের সুরনির্মাণ ও গায়কিতে এমনই এক অভিনবত্ব এনেছিলেনন, যা তাঁর আধুনিকমনস্কতা ও স্বকীয়তার পরিচায়ক। যেমন— ‘পিয়ালশাখার ফাঁকে ওঠে’, ‘ওই যে আকাশের গায়’, ‘যেন কিছু মনে কোরো না’ (সুর: দীপালি ঘোষ)।
বাংলা রাগপ্রধানের জগতে অন্যতম এক নক্ষত্রও ছিলেন তিনি। ‘আজি চাঁদিনি রাতি গো’ (কেদার), ‘জাগো জাগো প্রিয়’ (ভাটিয়ার), ‘বরষার মেঘ ভেসে যায়’ (সুরদাসী মল্লার), ‘আমার সহেলী ঘুমায়’ (মারু বেহাগ)— এমন আরও অনেক রাগপ্রধান গান হয়ে উঠেছিল অনেকের গান।
শুধুমাত্র ‘শ্রীতুলসীদাস’ (১৯৫০), ‘মেঘমুক্তি’ (১৯৫২) ও ‘বৃন্দাবনলীলা’ (১৯৫৮) ছবিতে তার নেপথ্য কণ্ঠ শোনা গেছে, যে ছবিগুলির সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন যথাক্রমে অনুপম ঘটক, উমাপতি শীল ও রথীন ঘোষ।
চিরকালই ছিলেন প্রচারবিমুখ, আত্মমগ্ন এক সঙ্গীতসাধক। ধ্যানমগ্ন সাধকের মতো চোখ বন্ধ করেই গান গাইতেন। সঙ্গীতজীবনে প্রাপ্য সম্মান, মর্যাদার প্রায় কিছুই তিনি পাননি। সে কারণেই হয়তো তাঁর ‘সারাটি জীবন কী যে পেলাম, এই মায়াভরা পৃথিবীতে' তারই নিভৃত অভিমানের আত্মপ্রকাশ। অখিলবন্ধু ঘোষের জন্মশতবর্ষেও আমরা তাকে ভুলে রইলাম কীকরে, এটাই সবচেয়ে বড় বিস্ময়, যা তার জীবন, সঙ্গীত, সাধনা, আত্মনিবেদন সবকিছুকেই ছাপিয়ে গেছে।
হয়তো কোনওদিন, কোনও বিনম্র নিবেদনের সন্ধ্যায়, ছায়াবৃত অখিলবন্ধুও গ্রীনরুমে, আপনমনে, নীরবে, নিভৃতে, স্বভাবসুলভ অভিমানে গেয়ে উঠবেনই 'যেন কিছু মনে কোরোনা, কেউ যদি কিছু বলে, কত কি যে সয়ে যেতে হয়, ভালোবাসা হলে'- সঙ্গীতকে ভালোবাসার প্রতিদান হয়তো এভাবেই দিতে হয়, তা না হলে যে, অখিলবন্ধু হওয়া যায়না।
সশ্রদ্ধ নমস্কার ও প্রণাম তার জন্মশতবর্ষে। তিনি আমাদের হৃদয়েই থাকবেন, শিল্পী, অজাতশত্রু-অখিলবন্ধুই হয়ে, চিরদিন, চিরজীবন।
(তথ্যঃ সংগৃহীত)।