একদিকে কালী আর অপরদিকে বিবেকানন্দের ছবি রাখা তাঁর ঘরে। তিনি বরাবর ধারণ করেছেন বিবেকানন্দের আদর্শ, মনে করিয়েছেন সহযোদ্ধাদের। তিনি চট্টলায় বসে ছক কষছেন বিপ্লবের। বলছেন মা কালীর পূজা, গীতাপাঠ আর স্বামীজির কর্মযোগের বাণী পঠন সকলের কর্তব্য হওয়া প্রয়োজন। তিনি হলেন মাস্টারদা। মাস্টারদা সূর্য সেন।
এরপর থেকে নিয়মিত সকলের ঘরে মা-কালীর ফ্রেমে বাঁধানো ছবি, স্বামী বিবেকানন্দের বই ও একখান গীতা থাকত। মাস্টারদা নিয়মিত উৎসাহিত করতেন গীতার মর্মকথা, স্বামী বিবেকানন্দের উদ্দীপনামূলক বক্তৃতাবলী পড়ার জন্য। যুবসমাজের আত্মবিশ্বাস গড়ার কারিগর স্বামীজি। সেই আত্মশক্তির ফল চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন।
'কেবল খাইয়া পরিয়া মূর্খের মতো জীবন-যাপন অপেক্ষা মৃত্যুও শ্রেয়ঃ; পরাজয়ের জীবন-যাপন অপেক্ষা যুদ্ধক্ষেত্রে মরা শ্রেয়ঃ'। আজ ১২ জানুয়ারি। যিনি এই উক্তি করেছেন সেই নরেনের আজ জন্মক্ষণ। আর যিনি এই উক্তি জীবনপথে সূর্যের মতো সত্য বলে মেনেছেন, সেই সূর্য সেনের প্রয়ানক্ষণ।
'মানুষের জন্য কাজ (যা পুজোরই সামিল) করে করে তোরা শেষ হয়ে যা, এটাই আমার আশীর্বাদ।', স্বামীজির এই উক্তি বিপুল প্রভাব ফেলেছিল স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ওপর। বিবেকানন্দের বৈপ্লবিক চরিত্র দেশপ্রেমিক, জাতীয়তাবাদীর চেহারাতেই দেখে এসেছেন সকল সংগ্রামীরা। তিনি বলতেন, 'বেপরোয়া হয়ে কাজ করতে হবে।... পড়লে পড়ুক আমার বুকে গুলি। আমেরিকা, ইউরোপ কীরকম কেঁপে উঠবে। তখন বুঝবে বিবেকানন্দ কি জিনিস!'
আনন্দমঠ, দেবী চৌধুরানী, রমেশ দত্তের Victorian Age এবং বিবেকানন্দের লেখা বই চরমপন্থীরা গীতার মতোই গ্রহণ করেছিলেন। সূর্য সেনের সহকর্মী রামকৃষ্ণ বিশ্বাস বলেছেন, 'blind belief জিনিসটা পছন্দ করে না কেউ। কিন্তু বিবেকানন্দের বেলায় ওঁর প্রত্যেকটি কথা বিনাবিচারে মেনে নেওয়া চলে।'
মাস্টারদার ফাঁসির দিনে সূর্যের তেজ প্রখর তো হবেই। যতই ফাঁসির আগে আসুরিক অত্যাচার চালায় ব্রিটিশ, ততই দৃপ্ত হয়েছে কণ্ঠ। নৃশংসভাবে হাতুড়ি দিয়ে দাঁত, নখ ভাঙ্গা হয়েছে। গোটা শরীরের সমস্ত হাড় পাঁজর টুকরো টুকরো করেছে। ১৯৩৪ সালে তাঁকে শেষ করেও দেশজোড়া বিদ্রোহের আগুন নেভাতে পারেনি সরকার। এমন সূর্য-রা নিভে যায় না কোনোদিন, বিবেক তাঁদের জ্বালানি!