সে প্রায় একশো বছর আগেকার কথা। জাপানের সমুদ্র নিকট বর্তী গ্রামে এক মৎসজীবি পরিবারের মেয়ে চিয়ো সাকামোটো। দেখতে অপূর্ব সুন্দরী – কিন্তু তাদের পরিবার ছিল বেজায় গরীব। চিয়ো এবং তার বোন সাৎসু বাবাকে সাহায্য করত টুক টাক কাজে – মাছ ধরে ফিরলে ইত্যাদি। কিন্তু তা সত্ত্বেও দিন গুজরাণ করতে হিমশিম খাচ্ছিল তারা।
এমন অবস্থায় চিয়ো-র বাবা তাই করল যে গল্প আমাদের খুব চেনা। চিয়ো এবং সাৎসু-কে তার বাবা নিয়ে গিয়ে কিয়োটো শহরে ‘বেচে’ দিয়ে এল এক গেশিয়া বাড়িতে। চিয়ো খুবই সুন্দরী ছিল বলে সেই গেশিয়া বাড়ির পরিচালিকা তাকে সাদরে নিজের কাছে রেখে দিল। কিন্তু সাৎসু-র ভাগ্য ভালো ছিল না – তাকে দেখতে অতটা ভালো ছিল না বলে সেই পরিচালিকা তাকে পাঠিয়ে দিল কাছের এক পতিতালয়ে।
গেশিয়া হয়ে ওঠা কিন্তু অত সহজ নয় – বহু বছরের প্রশিক্ষণের মধ্যে দিয়ে যেতে হয় এবং সবাই যে সফলতা লাভ করে এমন নয়। চিয়ো যখন কিয়োটো শহরের সেই গেইশা-বাড়ির মালকিনের কাছে ট্রেনিং শুরু করল তখন সেখানকার সবচেয়ে সুন্দরী ট্রেনি ছিল হাৎসুমোমো। চিয়ো-র মধ্যে হাৎসুমোমো দেখতে পেল তাকে ছাড়িয়ে যাবার ভয় – সেই থেকে হিংসা করতে শুরু করল তাকে। ওদিকে চিয়ো কিন্তু তখনো নিজের বোনকে ভুলতে পারে নি। একদিন গেশিয়া বাড়ি থেকে রাতের দিকে পালিয়ে সাৎসু-র সাথে দেখা করল এবং সুযোগ মত দুজনে চিরদিনের মত সেই অভিশপ্ত এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যাবার প্ল্যান করল।
রাতে বোনের দেখা করে ফিরে আসার সময় বাড়িতে ঢুকে চিয়ো দেখতে পেল হাৎসুমোমো তার প্রেমিকের সাথে খুবই অন্তরঙ্গ অবস্থায় লিপ্ত রয়েছে। চিয়ো কিন্তু কিছু মনে করল না যদিও তখন ট্রেনী-দের কোন রকম পুরুষের সাথে মেলামেশার পারমিশন ছিল না, প্রেম এবং অন্তরঙ্গতা তো দূরের কথা। চিয়ো মনে মনে খুশী হয়েছিল হাৎসুমোমো নিজের মনের মানুষকে খুঁজে পেয়েছে বলে। কিন্তু হাৎসুমোমোর মনে ভয় ঢুকে গেল – যদি মালকিনকে চিয়ো বলে দেয়! তাই চিয়ো কিছু বলার আগেই হাৎসুমোমো বদনাম ছড়াতে শুরু করল চিয়ো-র চরিত্রের। চিয়ো তো এদিকে চিরতরে পালাবার প্ল্যান করছে বলে সেই সব নিয়ে তেমন মাথা ঘামালো না।
কিন্তু পালাবার দিনে দিনে বিধি বাম। ছাদ দিয়ে পালাবার সময় চিয়ো মাটিতে পরে বিশাল আহত হয়ে গেল। মালকিন গেল ক্ষেপে – আহত অবস্থায় চিয়ো আর গেইশা ট্রেনিং-র উপযুক্ত নয় বলে তাকে হঠিয়ে দিল সমস্ত শিক্ষা থেকে। কিন্তু এদিকে পয়সা দিয়ে তো কিনেছে চিয়ো-কে তার বাবার কাছ থেকে। তাই সেই পয়সা উসুলের জন্য মালকিন চিয়ো-কে চাকর বানিয়ে রাখল এর পর থেকে। নিজের ভাগ্যের এমন পরিবর্তনে খুব ভেঙে পড়ল চিয়ো – একদিন পার্কে বসে বসে নিজের মনে কাঁদছিল, এমন সময় তাকে কাঁদতে দেখে এগিয়ে এল কিয়োটোর প্রভাবশালী ব্যক্তি চেয়ারম্যান ইয়ামুরা। চিয়ো-কে বাচ্ছা মনে করে একটা আইসক্রীম কিনে তাকে ভোলাবার চেষ্টা করল।
চেয়ারম্যানের এমন ব্যবহারে চিয়ো খুব আপ্লুত হয়ে পড়ল। এত ভালোবাসা তাকে অনেকদিন কেউ দেখায় নি। চেয়ারম্যানের বয়স কিন্তু চিয়ো-র থেকে অনেক বেশী – চেয়ারম্যান সেই মুহুর্তে ভালোবাসার থেকেও আদর করেই বাচ্ছা মেয়ে ভেবেই সেই আইস্ক্রীম কিনে দিয়েছিলেন। কিন্তু চিয়ো-র মুখটা তাঁর মনে থেকে গেল। ওদিকে চিয়ো-র মনে সেই দিনের কথার ভেবে জন্ম নিল চেয়ারম্যানের প্রতি এক টান। চিয়ো জানত যে গেইশা বাড়িতে চেয়ারম্যানের আনাগোনা আছে, তবে চেয়ারম্যান যায় শহরের সব থেকে নামী গেইশা-দের কাছেই। সেই থেকে চিয়ো ঠিক করে নিল কিয়োটো-র গেইশা বাড়ি থেকে সে পালাবে না – বরং শহরের সবথেকে নামী গেইশা হয়ে উঠে চেয়ারম্যানের কাছাকাছি আসবে একদিন না একদিন।
এর পরে অনেক দিন কেটে গেছে – চিয়ো তখনো চাকরেরই কাজ করে। যে গেইশার কাজ করত চিয়ো সে অনেকদিন ধরে চেনে চিয়োকে এবং জানে তার ভাগ্য পরিবর্তনের কথা। সেই মেয়েটি নিজে থেকে গিয়ে মালকিনের সাথে কথা বলে অনুরোধ করল যদি চিয়ো-র গেইশা হবার ট্রেনিং আবার শুরু করা যায়। মালকিনের মত পরিবর্তন হল – চিয়োর ট্রেনিং আবার শুরু হল। ট্রেনিং শেষে একসময় চিয়ো-র নাম পরিবর্তন করে সায়ুরি নামে আবির্ভূত হল গেইশা বিনোদন জগতে। কিছু দিনের মধ্যেই সায়ুরি-র নাম ছড়িয়ে পরল – বিখ্যাত হতে শুরু করল আস্তে আস্তে। চেয়ারম্যানের সামনা সামনিও হল অনুষ্ঠানে – কিন্তু সায়ুরি বুঝতে পারল না চেয়ারম্যান তাকে চিনতে পারছে কিনা! সেই যে চিয়ো এটা চেয়ারম্যান বুঝতে পারছে কিনা। সায়ুরির খ্যাতি যখন ক্রমশ বাড়ছে ঠিক তখনি আবার এল এক বিপর্যয় – দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। কিয়োটো শহরে থেকে সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেল গেইশা –
শেষ পর্যন্ত চেয়ারম্যানের সাথে আবার দেখা হয়েছিল কি সায়ুরির? সেই অসম প্রেম কি সার্থকতা পেয়েছিল সময়ের সাথে সাথে? সেই সব জানতে হলে আপনাকে দেখে নিতে হবে ‘মেমোরস্ অফ এ গেইশা’ নামক সিনেমাটি। বা আর্থার গোল্ডেন নামক লেখকের ‘মেমোরস্ অফ এ গেইশা’ নামক উপন্যাসটিও পড়ে নিতে পারেন – যে উপন্যাসটির উপর ভিত্তি করেই পরে সিনেমাটি বানানো হয়।
তা আজকে ধান ভানতে শিবের গীত গাইছি কেন? ঠিক তা নয় – তবে আজকে জাপানের ছবি দেখতে গিয়ে এই সিনেমাটির কথাই মনে পড়ে গেল। গেইশা ব্যাপারটি নিয়ে আবছা জানা থাকলেও, আরো বেশী করে জানার ইচ্ছে শুরু হয় ‘মেমোরস্ অফ এ গেইশা’ নামক সিনেমাটি দেখার পর থেকেই। সে প্রায় পনেরো বছর আগের কথা – তখন পড়াশুনা করি। আমার এক আমেরিকান বান্ধবী জেন-এর ছিল এক ছোট খাট ‘ডি ভি ডি’ লাইব্রেরীর মত! পৃথিবীর নানা দেশের দূর্দান্ত সব সিনেমার সাথে হলিউডের সিনেমায় দেখেছি প্রচুর। তেমন ভাবে একদিন দেখে ফেলি এই সিনেমাটি। অনেকগুলো অস্কার নমিনেশন পেয়েছিল সিনেমাটি – জিতেছিল গোল্ডেন গ্লোব। সিনেমাটি বেশীর ভাগটাই কিয়োটো শহরকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছিল – সবচেয়ে ভালো লেগেছিল সিনেমাটগ্রাফি! সেই কি অদ্ভূত! অবশ্যই সেট ব্যবহার করা হয়েছিল সিনেমায় – আর তা ছাড়া সেই তখনকার কিয়োটো শহরের সাথে আজকের অনেকটা তফাত আছে। তবুও ঠিক করে নিয়েছিলাম যে কোন দিন সুযোগ পেলে কিয়োটোর সেই এলাকাটা দিয়ে একবার ঘুরে আসব। তারপর অবশ্য বেশ কয়েকবার ঘোরার সুযোগ হয়েছিল – আজকে তারই কিছু ছবি।
তাহলে গেইশা কাদের বলা হয়? গেইশা হল জাপানের বিনোদন প্রদানকারী মহিলা – যারা মূলত জাপানীজ গান এবং নাচের মাধ্যমে চিত্ত বিনোদন করে। এরা কিমোনো পরে থাকে, মুখে রঙ ইত্যাদি মাখে এবং চুল খুব যত্ন নিয়ে বাঁধে। তবে একটা ব্যাপার পরিষ্কার করে দেওয়া দরকার – এই গেইশা-রা কিন্তু বাববণিতা বা দেহব্যবসায়ী। বরং তার উলটো – জাপানের নিয়ম অনুযায়ী গেইশা-দের দেহব্যবসার সাথে লিপ্ত হতে কঠোর ভাবে নিষেধ আছে। দেহব্যবসার জন্য জাপানে তখনকার দিনে নির্দিষ্ট অঞ্চল ছিল এবং দেহব্যবসায়ীদের লাগত লাইসেন্স। অনেকটা আজকের দিনের আমষ্টারডামের রেড-লাইট ডিষ্ট্রিক্টের মত ব্যাপার আর কি। আসলে গেইশা এবং বারবণিতা-দের মধ্যে মিশিয়ে ফেলা হয় ভুল করে তাদের কিমোনোর জন্য। এরা সবাই কিমোনো পরে থাকে বলে আলাদা করে বুঝতে পারে না অনেকে।
গেইশা ইতিহাসের সাথে কিয়োটো খুব অন্তরঙ্গ ভাবে জড়িয়ে। আগে যেমন লিখেছি, গেইশা হওয়া মুখের কথা নয় – অনেক দিনের ট্রেনিং লাগে, ট্রেনিং-য়ের সময় গেইশাদের বলা হয় ‘মাইকো’। মাইকো থেকে গেইশা উত্তরণ। আর গেইশা-রা যেখানে থাকে সেই জায়গার নাম ‘হানামাচি’ – এই হানামাচি-তেই এদের ট্রেনিং হয় এবং সেই বাড়ির মধ্যেই পরে ওরা পারফর্ম করে। এক একটা হানামাচি কন্ট্রোল করে ‘মাদার’ – মানে ওই বাড়িওয়ালি মালকিন টাইপের আর কি, যে নিজেও আগে গেইশা ছিল।
গেইশাদের জন্য জাপানের সবচেয়ে বিখ্যাত শহর হল কিয়োটো – আর সেই কিয়োটোর মধ্যেও একটা বিশেষ জায়গা, যার নাম ‘গিওন’। আজকের ছবিগুলি সেই গিওন ডিষ্ট্রিক্টের। সপ্তম শতাব্দীতে জাপান সাম্রাজ্যের রাজধানী কিয়োটো-তে স্থানান্তরিত এমন সব বিনোদন মূলক জায়গার (প্লেজার ডিস্ট্রিক্ট) গজানো শুরু। তবে তখন কিন্তু গেইশা নামটি জন্মায় নি, যদিও গান/নাচের ট্রাডিশন ছিলই। প্রচলিত আছে যে ফুকাগাওয়া নামে এক মহিলাই নাকি প্রথম নিজেকে গেইশা বলে ডাকা শুরু করেন।
শুধু নাচের অনুষ্ঠান নয়, এই গেইশা-দের এক গুরুত্বপূর্ব স্থান ছিল টি-সেরিমনিতেও। চা পার্টিতে এরা এসে নৃত্যগীত পরিবেশন করা হত। আগেকার দিনে এদের মজুরী এবং পারফর্ম করার সময়ের হিসেব করা হত একটা ধূপ কাঠি পুড়তে কত সময় লাগে সেই হিসাবে। তবে আজকের দিনে এদের মজুরী ঠিক হয় ঘন্টা প্রতি।
কিয়োটোতে আরো দুই-তিনটি গেইশা ডিসট্রিক্ট থাকলেও সবচেয়ে নাম করা হল গিওন, যেমনটা আগে লিখেছি। আজকের দিনে এটা অবস্থিত কিয়োটো শহরের শিজো অ্যাভিনিউ-র আশেপাশে। এর পূব দিকে আছে ইয়াশাকা শেরিন (মন্দির/প্রার্থনা স্থান), এবং পশ্চিম দিনে কামো নদী। এই এলাকা জুড়ে আছে অসংখ্য দোকান, খাবার জায়গা এবং টি-হাউস যেখানে গেইশা এবং মাইকো-রা (ট্রেনি গেইশা) বিনোদন করে জনতার। আর একটা কথা কিয়োটো-তে গেইশা-রা অধিক পরিচিত ‘গেইকো’ নামে।
এই গেইশা-দের কিন্তু তাদের আস্তানা বা হানামাচির-র বাইরে দেখা পাওয়া খুব চাপের। অনেকে অবশ্য বাইরে যায় অনুষ্ঠানের ডাক পেয়ে – কিন্তু খুব গোপনীয় ভাবে এদের হানামাচি থেকে গাড়িতে করে তুলে নেওয়া হয়, যেন পাবলিক দেখতে না পায়। তাই গিওনের রাস্তায় চলার সময়ে দেখবেন অনেক সময় কালো কাঁচ ঢাকা গাড়ি হানামাচির সামনে এসে দাঁড়ালো – টুরিষ্টরা তাদের ক্যামেরা নিয়ে রেডি গাড়ি থেকে নামলেই গেইশার ছবি তুলবে – কিন্তু কেমন ভাবে টুক করে ঢুকে পরে, ছবি তোলাই যায় না। রাস্তায় যারা কিমোনো পরে ঘুরছে তারা বেশীর ভাগই টুরিষ্ট – কিমোনো ভাড়া পাওয়া যায়। সেই ভাড়া করে সারাদিন ঘুরে আবার ফিরত।
গিওন এলাকা সব সময় টুরিষ্টে ভর্তি – সারা পৃথিবির প্রচুর পর্যটক। তার মধ্যেও আবার সবচেয়ে বেশী ভীড় হয় হানামি-কোজি নামক রাস্তাটায় – সেটা সিজো অ্যাভেনিউ থেকে কেনেজি মন্দিরে সোজা গেছে। এই রাস্তার দুই ধারে সেই পুরানো দিনের কাঠের বাড়ি – রাস্তার সামনের বাড়ির দরজা এবং প্রবেশপথ কিন্তু খুব সরু - মানে চওড়ায় কম, লম্বায় বেশী।
গিওনের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, এই সে সব কাঠের বাড়িগুলি আসলে তৈরী হয়েছিল একসময় পান্থশালা হিসাবে। ইয়াসাকা সেরিন (এখন গিওন সেরিনও বলে) এ যে সমস্ত লোকজন আনাগোনা করত তাদের থাকার জায়গা হিসাবে এই গিওনের জনপ্রিয়তার শুরু। কালে কালে এই এলাকাটি সবচেয়ে জনপ্রিয় গেইশা স্থান হিসাবে পরিচিতি পায়।
যদি কিয়োটো যান তাহলে একবার কিছু সময়ের জন্যও গিওন দিয়ে ঘুরে আসতে ভুলবেন না – ইতিহাস ছুঁয়ে ফেলবেন। আর যদি সময় করে একটা টি-হাউসে পারফরমেন্স দেখতে পারেন তাহলে তো কথাই নেই! সারা জীবন মনে রাখার মত অভিজ্ঞতা!
লেখাটা পড়তে খুব ভালো লাগলো। মেময়ার্স অফ এ গেইশা আমার খুব ভালো লাগা সিনেমাগুলোর মধ্যে একটা। সিনেমাটায় আমার তিনজন ফেভারিট অয়্যক্টর আছেনঃ জিয়ি ঝ্যাং, গং লি, আর মিশেল ইয়ো। আর দুর্দান্ত সিনেম্যাটোগ্রাফিআর কালার কম্পোজিশান। হিরো সিনেমাটাও ঐ কারনে খুব ভাল্লেগেছিলো। বইটা পড়া হয়নি, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সময় পেলে পড়ে ফেলবো।
dc, ধন্যবাদ। সিনেমা আর অভিনেতা/নেত্রীদের ব্যাপারে একমত। আমারও ভালো লাগা