পদ্ম পাপড়ি দু একটি স্খলিত । প্রস্তরকলসের গাত্রে মহাকালের দংশনচিহ্ন । এইপ্রকার ভগ্ন অর্ধভগ্ন কলসগুলি সারিবদ্ধভাবে ভূমিতে দন্ডায়মান । পরস্পর শুধু নিম্নস্বরে আলোচনা করে একদা মন্দিরশীর্ষে শোভিত হবার প্রাচীন গৌরবস্মৃতি । অযত্ন লালিত ধুলিধুসরিত অগণিত প্রস্তর আমলক । মন্দিরদ্বারের ঊর্ধ্বস্তরের নির্মাণে প্রয়োজন হত ।
যতদূর দৃষ্টি প্রসারিত হয় ধু ধু প্রান্তর । কে বলবে ইতিহাস ? ক্ষুদ্র দুচারটি শিশু শুধু সংরক্ষণাগারের দ্বার খুলতে সক্ষম । সত্যি ইতিহাস কে বা জানে ! কত নিগন্থ কত আজীবকের প্রয়াস ব্যর্থ হল । কতবার সভা বসল --পাটলিপুত্রে , গুজরাতের বল্লভীতে । কত 'অঙ্গ' রচনা হল । বার বার হারিয়ে গেল । কতবার নিহ্বান --বিভাজন । বহুশ্রুত মত আটবার ।
শুধু থেকে গেল 'জিন' --জয়ী হও --সর্ব আসক্তি, আকাঙ্ক্ষা, ক্রোধ, অহংকার, লোভ জয় কর হে শ্রমণ । তবেই তুমি জৈন ।
মন যে আমার এইসব জয়ের ঠিক বিপরীতগামী । ভ্রমণ আসক্তি কমে না । পুস্তক আসক্তি, বন্ধু আসক্তি কমেনা । পুরুলিয়াগামী প্রধান রাজপথ থেকে যে শীর্ণ ধুলিপথ পায়রাচালি গ্রামে প্রবেশ করছে-- শকট সেপথে চলল । গন্তব্য --সে পরে বলবখন । হাতিখেদা --শীর্ণ গ্রামীন পথ শেষ হল । রাঢ় বঙ্গের এইসব অঞ্চলে পরিব্রজন করেছিলেন মহাবীর বর্ধমান । জন্ম যাঁর রাজবংশে , লিচ্ছবি নাম । পিতা সিদ্ধার্থ , মাতা ত্রিশীলা । বৈশালী নগরীর কুন্ডলগ্রাম । ২৩ তম পার্শ্বনাথের পর তিনি ২৪তম তীর্থঙ্কর । যীশুখ্রীষ্ট জন্মগ্রহণের ঢের দেরী --তা প্রায় সাড়ে পাঁচশো বছর । রোগ , দারিদ্র্য, মহামারী জর্জরিত বঙ্গভূম । বেদেরও আগে কাউকে পেয়েছিল । কেউ কাছে ডেকে বলেছিল ---অহিংসা --কারো প্রাণহানি কোরো না , মানুষ অথবা না-মানুষ , এমনকি জীবজন্ত, কীট পতঙ্গ , বৃক্ষ লতা কারো না । বৃক্ষমূল ভক্ষণ পর্যন্ত নিষিদ্ধ কারণ এর ফলে বৃক্ষহনন হয় । নিজের অজান্তেও কারো প্রাণহানি না হয় সজাগ থেকো, শুধু আত্মরক্ষার্থে প্রাণহানি পাপবহির্ভূত । অনেকান্তবাদ --মুক্তমনস্ক হও , সব মতকে সম্মানজ্ঞাপন কর । অপরিগ্রহ--নির্লোভ হও । ছিন্ন কৌপীন আর ক্ষুধাসম্বল মানুষগুলোর কাছে এসব বাণী যেন ক্ষীণ মৃচ্ছকটিক শিখা । তাঁরা শরণ নিল । দুই ও অর্ধসহস্র বৎসর অতিবাহিত । আজো সাক্ষী রাঢ় বঙ্গের গ্রামে গ্রামে জৈনস্থাপত্যের ভগ্নস্তূপ ।
1872 সালে জে ডি বেগলার সাহেব পুরুলিয়াতে খুঁজে পেলেন চব্বিশটি মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ । পাকবিড়রা !! অদ্য গন্তব্য । তিনটি মন্দির মূল স্থাপত্য বজায় রেখে মেরামত করা সম্ভব হয়েছে ।
সম্পূর্ণ মনুষ্য কলরব বিহীন অঞ্চলে পদচারণাকালে বিভ্রম ঘটতে থাকল । ওই যে প্রবেশ তোরণের দক্ষিণ দিকে কালো পাথরের পদ্মপ্রভুর নগ্ন মূর্তি । কায়োৎসর্গ ভঙ্গিমা । ভূমিতে নিবদ্ধ নিম্নমুখী দৃষ্টি থেকে কিছু কথা ভেসে আসছে । বুঝতেও পারছি । কি আশ্চর্য । কিন্তু আমি যে অর্ধমাগধী জানিনা একবর্ণ । এমন আশ্চর্য অনেক ঘটে --জনৈক গ্রামবাসী বলেছিল । গ্রামবাসীর কাছে তিনি ভৈরবনাথ । পদ্মপ্রভু তো সর্বত্যাগী , এমনকি লজ্জাও তিনি ত্যাগ করেছেন । তাই তাঁর মূর্তির মস্তক কোনো আচ্ছাদন গ্রহণ করেন না । যতবার ছাউনি করা হয়--ভেঙে পড়ে । এখনো তাকে ঘিরে শুধু চারটি ব্যর্থ ঔদ্ধত্যের স্তম্ভ ।
ঠিক মনের মতো কথাটি বললেন পদ্মপ্রভু --জগত নিত্য , কালচক্র ঘুর্ণায়মান, কোনো ঈশ্বর নেই , ঋষভনাথ পথ প্রদর্শক , বিশ্ব চিরদিন ছিল আছে । জৈনরা বলেন --পঞ্চসহস্র বৎসর পূর্বেও তিনি ছিলেন । ঋগ্বেদের ১০ম মন্ডল ১২শ অনুবাক ১১৬ঋক --"ঋষভনাথের মতো দেবতা দাও হে রুদ্রদেব " । সুতরাং আদিনাথ ঋষভনাথ বেদ পূর্ব সময়ে ছিলেন । হরপ্পা খননে মেলে কায়োৎসর্গ নগ্ন পুরুষমূর্তি , ঋষভনাথের বৃষ প্রতীক ।
প্রাক আর্য আলোবলয় ঘুরপাক খায় পাকবিররা মিউজিয়ামে । ওই তো আদিনাথ--প্রস্তর ফলকের কেন্দ্রে উপবিষ্ট । তাঁকে ঘিরে ৩৫৬ তীর্থঙ্কর । অনেকাংশে ভগ্ন । আদিনাথের মূর্তি আটটি ভঙ্গিতে । হাতের তালুতে , টেবিলে স্থাপন করা যাবে এমন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কত প্রস্তর মন্দির । পরিকর সহ কত তীর্থঙ্কর । অম্বিকা মূর্তি । কার ছেনি হাতুড়ির কাজ জানার কোনো উপায় নেই । পাকবিড়রা গ্রামে খননকার্যে পাওয়া গেছে সব । এসব মূর্তি ও মন্দির নবম দশম শতাব্দীতে সৃষ্টি তা প্রমাণিত কিন্তু প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের কোনো ফলক চোখে পড়ল না । প্রাচীর বেষ্টিত প্রান্তরে ছড়িয়ে থাকা ভগ্ন মূর্তি খন্ড তস্কর অনায়াসে ঝোলায় পুরতে পারে ।
প্রথম ও দ্বিতীয় মন্দির ওড়িশি ধাঁচের রেখদেউল । উত্তরমুখী । যথেষ্ট তফাতে তৃতীয় মন্দিরটি পূর্বমুখী । সব সবুজাভ ক্লোরাইট প্রস্তর নির্মিত। চূড়ায় পদ্মকলস । এইস্থানে এই প্রস্তর বিস্ময় জাগ্রত করে । মন্দিরে গর্ভগৃহস্থিত মহাবীর বর্ধমান বাঙ্ময় -- বিস্ময়কর কিছু নয় --চতুর্মাস যাপন করেছি রাঢ়ে , অন্তর দিত্থি জাগ্রত কর । কত শত শেটঠির যাতায়াত । ভালো করে কান পাতলে শোনা যাবে অষ্টম নবম দশম শতাব্দীর বাণিজ্য কোলাহল । দ্বারকেশ্বর , সুবর্ণরেখা, কংসাবতী, দামোদর, শিলাই নদী তখন যৌবনোচ্ছল স্রোতস্বিনী । আজকের শীর্ণধারা অথবা মৃত নদীখাত দেখে কল্পনা করাও কঠিন , কি গভীর ছিল তাদের নাব্যতা । সব শাখানদী উপনদী মিলে মিশে রাঢ়বঙ্গের নদীজালিকা --ছিল বণিকদের কাছে অতি আকর্ষণীয় জলপথ । তৈলকম্পী প্রধান বন্দরশহর । রাঢ় বঙ্গে ব্যবসাবাণিজ্য করেন উত্তর মধ্য ভারতের শ্রেষ্ঠীরা । বাণিজ্যতরনীর গতায়াতে একদা মুখর ছিল এই ধু ধু রুক্ষ প্রান্তিকভূমি । ধাতুদ্রব্য কাপাস বস্ত্র পশম আদানপ্রদান হত । অগন্থ ভদ্রবাহুর শিষ্যত্ব নিয়েছিলেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্য । এই ভদ্রবাহু মহাবীর বর্ধমানের নির্বাণের দুইশত বৎসর পর তাঁর জীবনী লিপিবদ্ধ করলেন-- "কল্পসূত্র" । মহামেঘবাহন বংশের রাজা উদয়গিরির হাতিগুম্ফায় শিলাখোদিত করছেন জৈনলিপি । নৃপতিগন যেপথে করে গমন -- বহু ধনীজন জৈনধর্ম গ্রহণ করেছিলেন । তাঁরা আসা যাওয়ার পথে অগণিত জৈন মন্দির নির্মাণ করেছিলেন রাঢ়বঙ্গে । অধিকাংশ কালগহ্বরে নিমজ্জিত, প্রতি গ্রামে মেলে জৈনস্তুপ । বাঁকুড়ার ধরাপাট , বহুলাড়া , দেউলভিড়া মন্দির এখনো অক্ষত । পুরুলিয়ায় চেলিয়ামা , দেউলভিটা , তেলকূপী । পাঞ্চেত বাঁধের ঔদ্ধত্যে তেলকূপীর অজস্র মন্দির সলিলসমাধিতে নিদ্রিত । এই মুহূর্তে ভগ্ন একটি মন্দির -- অর্ধবক্রাবস্থায় ।। তারও মৃত্যু আসন্নপ্রায় ।
পাকবিড়রা মন্দির প্রাঙ্গণে বাধা দেবার কেউ নেই । পায়ে পায়ে অন্ধকার গর্ভগৃহে প্রবেশ করি । ধূপ ধুনো অগুরু । পুষ্প চন্দন কুসুমমাল্য --সমকাল অতিক্রম করে সেই আদিকালের সুগন্ধ । সব তীর্থঙ্কর মূর্তির দুই পার্শ্বে খর্বকায় পরিকারদ্বয়ের সেবা উন্মুখ ভঙ্গি । পদ্মস্থিত পদদ্বয় । আমার বেয়াদপ নচিকেতা হঠাৎ প্রশ্ন করে বসল-- আদিনাথ --পুজাগ্রহণ করতেন কেন ? সর্ব স্পৃহা সর্ব আসক্তি জয় করলেন--কিন্তু ভক্তের সমর্পনমুদ্রা , ভক্তিনিবেদন , পুজা । অষ্টপ্রকার পূজা প্রাপ্য তীর্থঙ্করদের --জলপূজা, চন্দনপূজা, পুষ্পপূজা, ধূপপূজা, দীপকপূজা, অক্ষতপূজা, নৈবেদ্যপূজা ও ফলপূজা । এসব দ্বারা নিজে উচ্চাসনে বিচ্ছিন্ন থাকার এক আসক্তি সৃষ্টি হল না কি ? সাধনা দ্বারা নিজেকে বিশিষ্ট ভাবার আসক্তি ?
সহসা ঠক ঠক ঠক ঠক । সম্মুখে প্রাচীন বৃক্ষগাত্রে এক অর্বাচীন কাষ্ঠকুট্ট পক্ষী ।
ওরে --কোনো কিছুর চূড়ান্ত বলে কিছু নেই । যে চতুর্যামের কথা বলেছি , তার এক শতাংশ মান্য করলে ধরাধাম অন্যধারা হত ।
পাকবিড়রা গাইড , ভ্রাতা দেবাশিস মুখোপাধ্যায় স্থিরচিত্রযন্ত্র হাতে উধাও হয়েছিল । ফিরতেই ফের শকট অভিমুখে যাত্রা --ঘোরে বিড় বিড় করি অগমা--দ্বাদশঅঙ্গ--আচরণসূত্ত-কল্পসূত্ত--
অপূর্ব! ভাষার মায়ায় অতীতচারী হয়ে গেলাম।