১
ক্রান্তীয় সমুদ্রবীচে দাঁড়িয়ে দেখি ভাঙা
দরজার পাল্লায় হাত-রেখে
সাদা বিধবাদের কঙ্কাল থেকে ঝরা চুন
আর ফসফেট-গুঁড়ো —
চাঁদ ক্রমে অজানা উড়ন্ত বস্তুর মতো
বিবর্ণ নষ্ট হয়ে গ্যালো।
আইসক্রিম স্টলগুলি ছাতা মেলে
অপরিবর্তিতভাবে
চলে গেল হাইওয়ের দিকে;
কার্তেজীয় তল ছেড়ে আভাঁগার্দ লেখকেরা
ক্রমশ পরিদৃশ্যমান।
সবুজ সাইনবোর্ডে লেখা: সাবধান!
ভিয়েনার পুরোনো গলিতে
অমুক মেটামডার্নিস্ট এখন নিকেলের ঘড়ি
বেচে খায়।
২
অন্ধকার হলওয়ের মাথায় দাঁড়িয়ে দেখি
দৈর্ঘ্যের শেষপ্রান্তে
একটা অ্যালুমিনিয়াম দরজা।
সামান্য আলো ছিটকে আসছে
দৃশ্য-বর্ণালীর ভেতর,
সাটিনের পর্দাগুলি মৃদু হাওয়ায় সঞ্চারণশীল —
মৃত্যু সম্পর্কে এই পর্যন্ত: জেগে উঠি বেডে;
মনে পড়েনা কেন হাসপাতালে এসেছি,
বিশেষত মধ্যরাতে
যখন ফোঁটা-ফোঁটা স্যালাইন
সময়ের হিসেব রাখছে
আর ব্যাকইয়ার্ডে তিনটে অ্যাম্বুলেন্স
মুখোমুখি স্থির।
আলো নেভানোর পরে
কোনো নন-ইউক্লিডিয়ান স্পেসে
ঢুকে যাচ্ছে স্বপ্নেরা: প্রেইরীর কুকুর,
নদীতীরে তাঁবু আর ছাইরঙা নুড়ি;
দূরে এক মহিলা জিওলজিস্ট হাঁটুগেড়ে
পরীক্ষা করছেন পাথরের রীতি।
৩
বন্ধ কারখানার ভেতর দাঁড়িয়ে দেখি
মেশিনেরা অবিকল শ্রমিকের জায়গায়
কিছু ডিজেল-মাংস চেয়ে অনেক পরিশ্রম
করে গ্যাছে।
এখন বিকেল; জন্ডিস রুগীর পেচ্ছাপ-
আলো গড়িয়ে পড়েছে পামের গুঁড়িতে —
শহরের শেষ মহল্লাগুলো জুড়ে
ছায়া পরিদর্শনরত।
দোতলা বারান্দা থেকে বাড়ীগুলি
ঝুঁকে আছে; পরিত্যক্ত রানওয়ের পাশে কাঁটাঝোপ,
ভাঙা অটোমোবাইল, তেলমোছা ন্যাকড়ার ফালি —
বান্ধবী নিখোঁজ হলে এখানে আসা যায়,
বৃষ্টি থামার পর এখানে মার্ডার হবে
হলিউড থ্রিলারের মতো।
৪
শীতকালীন ক্যাফেতে দাঁড়িয়ে দেখি,
গ্রেগর সামসার মতো,
একটা কমলালেবু-গোল পৃথিবীর ভেতর
কোনোদিন জেগে উঠতে হবে,
এই ভয়ে ফ্ল্যাট-আর্থ সোসাইটির সদস্যরা
বিষণ্ণ চোখে তাকিয়ে রয়েছে রাস্তার দিকে।
তাদের কফি ঠান্ডা হয়ে আসছে;
কালো মাছি বর্ডার এঁকে দিচ্ছে টেবিলের চারপাশে।
ইভনিং নিউজপেপারগুলি তাজা খুন
ও কিডন্যাপিংয়ের খবরে ভর্তি;
কোণে এক জার্মান প্রফেসর
আর.এল. স্টিভেনসনের গল্পে ডুবে আছেন —
আমি মনে মনে ভাবছি ড. গিডিয়ন ফেলের
একটা অসমাপ্ত লকড-রুম মিষ্ট্রির কথা।
জ্যোৎস্নার ফুটপাতে মানুষেরা হাঁটছে
রোবট-কুকুরের পিছু-পিছু।
৫
সেভেন-ইলেভেনের বাইরে দাঁড়িয়ে দেখি
একটি সাইবর্গ গ্যাসস্টেশনে অপেক্ষা করছে
তার সমকামী পার্টনারের জন্যে —
ঠা-ঠা রোদে পোস্ট্যাল ট্রাকগুলি চলে যাচ্ছে
উপকূল ঘেঁষে।
পিৎজাতে আনারস যোগ করতে চাওয়ায়
একবার এক ইটালিয়ান বুড়ো আমাকে ধমকেছিল;
পাশের অ্যাপার্টমেন্ট থেকে মাঝরাতে জোরালো
নীল রশ্মি বেরিয়ে বিকল করে দিচ্ছে
শহরের নেক্সট-জেন কমিউনিকেশন।
অনিদ্রার ভেতর, গতজন্মে যাকে ভালোবাসতাম,
সেই রাশিয়ান ব্যালেরিনার মুখ মনে পড়ে,
যে অজস্র ঘুমের বড়ি খেয়ে
গোলাপী জুতো খুলে রেখেছিল পাপোশের ওপর,
এবং রেডিওর বুলেটিনে নাৎসীরা পোল্যান্ডে ঢুকছে
শুনতে শুনতে মরে গিয়েছিল একা।
৬
স্যাঁতসেতে অ্যালিতে দাঁড়িয়ে দেখি
একটি শহুরে বেড়াল
মাছেদের কাঁটা আর আঁশ নিয়ে খেলা করে।
শ্যাওলায় ওল্টানো ডাস্টবিন;
তার নীচে পচে যাওয়া কেক আর অখাদ্য প্ল্যাস্টিক
চেটে পরাজিত বেড়াল ঘুমে ডুবে গেল।
দূরবর্তী গ্রহে পাথুরে জমির ওপর তখন
অ্যাস্ট্রোনটরা হেঁটে ফিরছে নিজেদের স্পেসশিপে,
ভেগাসের কোনো তৃতীয় শ্রেণীর মোটেল
থেকে হারিয়ে যাচ্ছে গোয়েন্দারা
এবং একটা আটবছরের ছেলে
এল-ডোরাডোর ছবি হাতে মুগ্ধ —
মিউজিক সিস্টেমে: গ্রাউন্ড কন্ট্রোল টু মেজর টম।
বরফ পড়তে তখনও দেরী।
৭
ডকইয়ার্ডে দাঁড়িয়ে দেখি ঝোড়ো হাওয়ায়
পিপেগুলো উল্টে জলে ভাসছে
আর ফুড ট্রাকের সামনে রেনকোট-পরা
বেশকিছু যুবকের লাইন;
রিপোর্ট বলছে একটা ক্রপ সার্কেল তৈরি হয়েছে
হাইওয়ের পাশে, প্রজাপতি-ধরা জাল নিয়ে
সিক্রেট এজেন্টরা নিযুক্ত স্ক্যান্ডেনেভিয়ায়।
পঞ্চাশের দশকে মস্কোর গোপন ল্যাবে
পরীক্ষা চালানো হয় বিভিন্ন পতঙ্গের ওপর;
বেশিরভাগ রেজাল্ট নেগেটিভ আসে।
শুধু একটি বিশেষ প্রজাতির ক্ষেত্রে সাফল্য মেলে,
এবং সেটা জানা যায়
ডেনমার্কের কোনো অখ্যাত টাউনে
একজন প্রাক্তন কেজিবি এজেন্টের
কাগজপত্র ঘেঁটে —
স্ট্রীকনিনে খুন হওয়া লোকটার কাবার্ডে রাখা ছিল
কয়েকটি মরা ভারমিলিয়ন
প্রজাপতি, যাদের গড় বয়েস ৪২ বছর!
৮
আন্ডারগ্রাউন্ড প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে দেখি স্বয়ংক্রিয়
দরজাগুলি খুলে যাচ্ছে, আলোর চেয়ে দ্রুতগামী
ট্রেনগুলো এসে থামছে স্টেশনে; ব্যস্ত মানুষেরা,
যেভাবে ১৯৩০-এর সাইফাই
কল্পনা করেছিল, পা রাখছে কামরায় —
ইলেকট্রনিক বোর্ডে গন্তব্য-শহরের নাম পাল্টে
যাচ্ছে দ্রুত: একজন বুড়ো জানলার ফ্রেমে
থুতনি রেখে বাইরে তাকিয়ে আছেন,
আহ, ভিন্টেজ রেডিওতে —
Love me, I'll love thee,
till desert sands grow cold!
(নিউইয়র্ক, ১৯১১)
একটা ফোটন জানেনা সময় কী আশ্চর্য জিনিস,
বুড়ো বিড়বিড় করলেন;
এফটিএল ড্রাইভ তাঁদের পৌঁছে দিচ্ছে
১৯৫০-এর প্যারিসে, ১৮৮০-র কলকাতায়।
ভিক্টোরীয় লন্ডনের রহস্যময় স্ট্রীটগুলি আর
বাঁকা আলোকস্তম্ভ, বৃষ্টিপিছল গ্রানাইটে
ঘোড়ার খুরের শব্দ, পর্দাটানা গাড়ীর ভেতর
চিন্তামগ্ন হোমস: টিভিপর্দায় আচমকা
হাততালির আওয়াজে বুড়ো ফিরে এলেন
১৯৬০-এর প্রান্তে, দর্শকের অট্টহাসি —
ক্যাজুয়ালি পাইপটা আবার ঠোঁটে রাখলেন গ্রাউচো।
১৯৮০-র গোড়ায়, যখন প্যাকম্যান ও অন্যান্য
আর্কেড গেম জনপ্রিয় হচ্ছে অ্যামেরিকা জুড়ে,
বেলা এগারোটার ম্যানহ্যাটানে
মইয়ের শেষধাপে ডান পা রেখে কোনো যুবক
হাতে-ধরা বইটায় মুখ গুঁজে আছে —
'দ্য টাইম মেশিন', প্রথম প্রকাশ: ১৮৯৫।
৯
অন্য ছায়াপথের এক শহরে দাঁড়িয়ে দেখি
গ্লাস প্যাটার্নের ওপারে অস্তগামী আলো।
ছোট ছোট শাটলগুলি উড়ে বেড়াচ্ছে হাইরাইজের
মাথায়, দূরে অদ্ভুত-জ্যামিতির পাহাড়ী সিল্যুয়েট;
রাস্তায় ভেন্ডররা গা-ঘিনঘিনে প্রোটিন বিক্রি করছে,
নিয়নের স্টলগুলির গায়ে থিগমোট্রপিক নকশা —
সামনে জড়ো-হওয়া ভিড়, ভিড় থেকে মুখ তুলে
একজন চশমাপরা মেয়ে হঠাৎ জিগ্যেস করল:
আইডেন্টিফিকেশন নাম্বার?
তার বুকের খাঁজে একটা ল্যাপিস-লাজুলি পাথর
আমাকে মনে করিয়ে দিলো পৃথিবীর কথা,
মেলিয়েজ ফিল্মের মতো অজস্র সাদা-কালো
ট্রিগার ছড়িয়ে পড়ছে নিউরন বেয়ে, পাশ দিয়ে
চলে যাচ্ছে কমলা পোশাকপরা সিক্রেট পুলিশ।
সে ও আমি কোনো বী-হাইভ স্ট্রাকচারের সামনে
গিয়ে দাঁড়াই; জানতে পারি সে একজন অ্যান্ড্রয়েড,
আর আমি এক ছদ্মবেশী এজেন্ট, মনে মনে ভাবি —
হেক্সাগোনাল মাঠের ওদিকে রিভার্স
ট্যুরিং টেস্ট সেন্টার, উদ্বিগ্ন বাবা-মা'রা
অপেক্ষা করছে মানুষ-শিশুদের জন্যে।
১০
সিঁড়ির নীচে দাঁড়িয়ে দেখি সন্ধ্যের রোদ যেন
রুগ্ন অ্যাথিনীয় যুবতীর কন্ঠার হাড় —
শহরের শেষ স্কাইস্ক্র্যাপারের চূড়া থেকে
ল্যান্ডিং গিয়ার গুটিয়ে নিচ্ছে হরপ্পার পাখিগুলি;
হাওয়া জাল কেটে চলে যাচ্ছে নদীহীন সভ্যতার পেটে।
এখন অন্ধকার
স্টিলেটো নখ গিঁথে আমাদের মৃত্যুমুখী করে।
খালি-হওয়া বাড়ীগুলোর বিজ্ঞাপন স্পষ্টতর হলো,
নিরুদ্দেশ বেড়ালের ছবি,
স্বপ্নে প্রাক্তন প্রেমিকা লাস্যময়ী মুখে
যাদের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছে
এবং ঘুম থেকে উঠে সুটকেশ গুছিয়ে
যারা চলে গ্যাছে দূরবর্তী ঠিকানার দিকে;
সেখানে অসুস্থ মেশিন মরে গেলে স্থানান্তরিত হয়,
ফস করে সিগ্রেট জ্বলে ওঠে
আর একটা নাইন এম এম শট: অবিশ্বাসঘাতক!