খাওয়াদাওয়া নয়, বাড়ি গাড়ি নয়, টাকা পয়সা নয় , শাড়ি গয়না নয়, সাজগোজ নয়, আমার একমাত্র শখ হলো বেড়ানো। কপালগুণে কর্তামশাইয়েরও শখ প্রবল বেড়ানোর! সুতরাং, আমাদের দুই বেড়ানোবাজের একমাত্র মেয়ে হলো ডাবল বেড়ানোবাজ। তবে এক্ষেত্রে মেয়ে আর আমি সমমনস্ক সমগোত্রীয় অর্থাৎ আমার আর মেয়ের আবার বেড়ানোয় বাছাবাছি নেই, পাহাড় জঙ্গল মরুভূমি সমুদ্র সবেতেই সমান রুচি। জাস্ট তল্পিতল্পা গুছিয়ে বেরিয়ে পড়লেই হলো। কিন্তু কর্তামশাই আবার ভয়ঙ্কর রকমের পাহাড়প্রেমী কিন্তু উনি আবার খাদেও বড্ড ভয় পান! বৈচিত্র্যময় সমাপতন!
মেয়ের সেকেণ্ড ইয়ারের ফাইনাল পরীক্ষা সেবার বেশ অনেকদিন পিছিয়ে যাওয়ায় শীতের ছুটিতে বেড়াতে যাওয়া হয়ে উঠলো না। তাতে কুছপরোয়া নেহি, দোলের তিন দিন আগে মেয়ের পরীক্ষা শেষ হলো, এবং আমরাও তৎকালের টিকিট কেটে ঠিক দোলের দু'দিন আগের দুপুরে করমণ্ডল এক্সপ্রেসে চেপে পড়লাম... গন্তব্য চেন্নাই হয়ে উটি। চেন্নাই থেকে নীলগিরি এক্সপ্রেসে মেট্টুয়াপালায়ম, এবং ওখান থেকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ রুটে টয়ট্রেনে করে উটি যাবার প্ল্যানিং। সেভাবেই টিকিট বুকিং হয়েছে। তবে মেট্টুয়াপালায়ম পৌঁছে দেখা গেলো আগের দিন দশেক ধরে লাগাতার বৃষ্টির কারণে টয়ট্রেন পরিষেবা বন্ধ। অগত্যা একটি গাড়ি ভাড়া করে ঝিরঝিরে অবিরাম বৃষ্টির মধ্যেই গিয়ে পৌঁছনো গেলো উটি শহরে। ছোট্ট ছুটিতে মাত্র চারদিনের জন্য আসা, তাতেই যেটুকু হয়। সত্যি বলতে কী দক্ষিণ ভারত ততদিনে ভাগে ভাগে বার চারেক ঘোরা। তবে সেবারে মার্চের প্রথম সপ্তাহেও নাকি উটকামণ্ডে মানে উটিতে বেজায় শীত চলছে। বেঙ্গালুরুবাসী পরিচিত একজনের মুখে শুনেই আর লোভ সামলাতে পারলেন না কর্তামশাই। উটির শীত উপভোগ করতে আমার শীতপ্রেমী এবং পাহাড়প্রেমী কর্তামশাই চেন্নাই হয়ে উটি যাবার টিকিট কেটেই ফেললেন। আর আমরা মা মেয়েতে বেজায় খুশি। কারণ ঐযে বললাম না, আমার আর মেয়ের কোথাও কোনো বেড়ানোতেই অরুচি নেই। বেড়াতে পেলেই হলো।
বেড়ানো মোটামুটি হলো, সবইতো আসলে আগেই দেখা ছিলো, কাজেই শপিং করে, দু'বেলা হেঁটে ঘুরে বেড়িয়ে, গাণ্ডেপিণ্ডে হোমমেড চকলেট আর বেকারি আইটেম খেয়ে খেয়ে আর লেকের ধারে বসে বসে শীত উপভোগ করেই দিব্যি টুক করে চারটে দিন কাবার। এবার ফেরার পালা ঘরপানে।
উটি থেকে ফেরার পথের টিকিটটি আবার যশবন্তপুর থেকে। সুতরাং ঠিক হলো একটি গাড়ি নিয়ে মাইশোর হয়ে যশবন্তপুর যাওয়া। তবে মুশকিল হলো যশবন্তপুর থেকে কলকাতা ফেরার টিকিটটি তখনো ওয়েটিংয়ে আছে। উটির হোটেল থেকে পরামর্শ দিলো যে মাইশোর হয়ে গেলে একরাত থেকে পরদিন তৎকাল টিকিট কেটে শতাব্দী এক্সপ্রেসে বেঙ্গালুরু যাওয়ার। এবং ওখান থেকেই কলকাতাগামী দুরন্ত এক্সপ্রেসের কানেক্টিং টিকিট কেটে দেবার পরিচিত লোক আছে। অগত্যা টিকিট ক্যান্সেল করাতে হবে মাইশোর গিয়ে। গাড়ি ভাড়া হলো। ড্রাইভার বেচারা "অনলি তামিল" ভাষী। বাধ্য হয়েই মাইশোর রুট হয়ে ফেরা। নামতেই হবে। ছুটি অতি সংক্ষিপ্ত। বাড়তি ছুটি নেওয়াও সম্ভব নয় আগামী কয়েকদিনে। সুতরাং, উপায়ান্তর নেই দেখে অনেকরকম নির্দেশ ড্রাইভারকে বুঝিয়ে দিয়ে, কর্তামশাই সিটবেল্ট বেঁধে, টেনেটুনে সবরকম পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষ করলেন। তারপর ড্রাইভারকে গ্রীণ সিগন্যাল দিলেন। তবে "অনলি তামিল" ভাষী ড্রাইভার যে কী বুঝলো, তা কেবলমাত্র সে নিজেই জানে। বিস্তর ঘাড়-টাড় নেড়ে যাত্রা শুরু হলো। অত্যন্ত বিশ্রীরকম খাড়াই পথ! প্রত্যেকটি বাঁকে আয়না বসানো, আর তলার ফলকে অ্যাম্বুলেন্স হাসপাতাল পুলিশ ইত্যাদি এমার্জেন্সি কিছু ফোন নম্বর লেখা। গাড়িতে তেমন গতি তোলা নিষেধ নিরাপত্তার কারণে। ধীরগতি এবং পথের ভয়াবহতায় উটি পাহাড়ে ওঠা এবং নামা দু'দিকের সওয়ারীদেরই অসীম ধৈর্যের পরীক্ষা চলছে। অপেক্ষায় মেট্টুয়াপালায়ম থেকে যাতায়াত সুবিধাজনক সুগম পথ। তবে মাইশোরগামী পথের বাড়তি আকর্ষণ মুধুমালাই ফরেস্টের ভিতর দিয়ে যেতে পারা।
উটি শহরের প্রান্তের সরকারি চেকপোস্ট ছাড়ার মিনিটকয়েকের মধ্যেই একটি অতি পরিচিত আওয়াজ কানে এলো। মেয়ের কান থেকে ইয়ারফোনটা টেনে খুলে দিলাম। আর মেয়েতো ফ্যাকফ্যাক করে হাসতে শুরু করলো। আমি হাত দিয়ে মেয়ের মুখটা চেপে ধরলাম। ড্রাইভারটি করুণমুখে আমাদের দিকে কিংকর্তব্যবিমূঢ়ভাবে তাকালো। আমি ঠোঁটে আঙুল রেখে ঈশারায় ওকে সাবধানে গাড়ী চালাতে বললাম। প্রায় ঘন্টা চারেক অতিক্রান্ত, ভয়ানক ঐ পথ পেরোতে। তবুও বাঁচোয়া বৃষ্টি ধরে গেছে। শম্বুকগতিতে চলে এবার আমরা মুধুমালাই ফরেস্টে ঢোকার ঠিক আগের বাম্পারে, গাড়ী বেশ জোরে ঝাঁকুনি খাচ্ছে। এবার একদম মিহিসুরে কর্তামশাই তখন ড্রাইভারের হাতটি ধরে বিশুদ্ধ বাংলায় বললেন, "ভাই, আস্তে আস্তে, আমরা পুরো ফ্যামিলি একসাথে, সাবধানে ভাই, সাবধানে!" এবার আর মেয়েকে আটকানো গেলো না। প্রবল অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো, আর হাসি বড্ড ছোঁয়াচে, আমিও হেসে ফেললাম, এমনকি ওই শান্তশিষ্ট নিরীহ নিপাট গোবেচারা "অনলি তামিল" ভাষী ড্রাইভারটিও আর ভাবলেশহীন মুখের হাসিটি কিছুতেই আর চাপতে পারলো না। সেও তার দন্তকৌমুদী বিকশিত করেই ফেললো। আর তাতে কর্তামশাইতো ভারী অপ্রস্তুত! রক্তবর্ণ চক্ষু মেলে শেষমেশ খাদের দিকে না তাকানোর অজুহাতে সুন্দর একটি বাহানা খাড়া করলেন। মেয়ে এবার বললো, "তবে চারঘন্টা ধরে চলা ঐ কনসার্টের মতো নাক ডাকাটা তবে কার ছিলো?" অমনি কর্তামশাই অবলীলাক্রমে বেশ গম্ভীর চালে বলে দিলেন, "কলকাতায় গিয়েই এবারে তোর মামকে ডাক্তার দেখাতে হবে ইমিডিয়েটলি। আজকাল দেখছি খুব জোরে জোরে নাক ডাকাচ্ছে তোর মাম। কে জানে স্লিপ অ্যাপনিয়া বা হার্টের প্রবলেম শুরু হলো কিনা? রোগের তো আর বয়স নেই! হলেই হলো!"
আরেকবার হাসির রোল উঠলো, আর মেয়ে আবার কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো। আমি ঠোঁটে আঙুল রেখে থামালাম। ঠিক তখনই গাড়িটা থেমে গেলো। কী হলো রে বাবা? কর্তামশাই এবার সবেগে হিন্দিতে আওড়ালেন, "কেয়া হুয়া ভাই?" যে যা খুশি ভাষাভাষী হোক না কেন, আবেগ ও অনুভূতির ভাষাটা বোধহয় বর্ডারলেস! আমাদের "অনলি তামিল" ড্রাইভারটি ঠোঁটে আঙুল রেখে চুপ করে থাকার ইঙ্গিত করলো। তারপর সে অঙ্গুলিনির্দেশ করলো সোজা সামনের দিকে। রাস্তা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে জনা পাঁচেকের এক ছোটখাটো হাতির দল, বা বলা ভালো একটি হাতির" ছোট পরিবার সুখী পরিবার"। উটি ভ্রমণে আসা পূর্ণতা পেলো। আর কিছু তেমন উল্লেখযোগ্য দর্শণ ঘটেনি। নেহাতই ছুটি কাটাতে এসে দেখা হয়ে গেলো প্রাকৃতিক পরিবেশে প্রকৃতি মায়ের দামাল সন্তানদের সাথে। নিরাপত্তা বৃদ্ধির খাতিরে আমাদের ড্রাইভার গাড়ির সব ক'টা কাঁচ তুলে দিলো, আর আমরা একবিন্দুও বিরক্ত না হয়ে ওখানেই আটকে রইলাম আরো ঘন্টাখানেক। সেবারের ঝটিকা সফরে সঞ্চিত হলো প্রকৃতির কোলে বসে বুনো হাতি দেখার এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। সেবারের সফরকালীন ছোটখাটো সব খারাপলাগাগুলোকে নিমেষে প্রকৃতি মা ইরেজার দিয়ে সযত্নে মুছে দিয়েছিলেন যেন। সার্থক ভ্রমণ!
--------------------------------------
© সংঘমিত্রা রায়চৌধুরী
বা বা বেশ অভিজ্ঞতা। প্রচুর বেড়ান যখন, সব গল্পগুলোই লিখে ফেলুন আস্তে আস্তে।