।।কোজাগরী।।
কে জাগে রে !! ছোটবেলায় দুগ্গা পূজো ছিল পাড়ার পূজো। পূবপাড়া, মাঝেরপাড়া, পশ্চিমপাড়া। আমাদের বাড়িটা পড়তো মাঝেরপাড়ায়। পূজোটা হত ইস্কুলবাড়িতে, আমাদেরই পূজো, তবে পাড়ার, ঢাকিরা থাকতো আমাদের বাড়ীতে সিঁড়ির তলার ঘরে। ঢাকিদের সাথে একটা বাচ্চা ছেলেও আসত কাঁসি নিয়ে নাড়ু। নাড়ুকে হিংসে হোত, ওকে তো ইস্কুলে যেতে হয় না, কেমন পঞ্চমী থেকেই বাপের সাথে দুগ্গা পুজোর মন্ডপে। স্কুলে প্যান্ডেলের বাঁশ পড়ত মহালয়ার পরের দিন, মন উড়ুউড়ু, কবে ষষ্ঠী আসবে, ষষ্ঠী হয়ে ইস্কুলে ছুটি, সেই এক মাসের। সপ্তমী অষ্টমী নবমী টা কেটে যায় কেমন স্বপ্নের মতো, সীতানাথ ওর ভাই পচাকে দুই বেনী প্যাঁচানো সাপ বেলুন কিনে দেয়, সবাই রোল ক্যাপ ফাটায়, কালো টিনের বন্দুক, রুনুরটা স্পেশাল চকচকে স্টিলের, রাঙাকা এনে দিয়েছে হিঙ্গলগঞ্জের বড় দোকান থেকে, ঐ রাঙাকাই সব বায়না মেটায় রুনুর, পূজোর আগে যখন শাপলা ফুল ফোটে বাঁওড়ে, রাঙাকা তুলে এনে দেয়, ষাঁড়াষাঁড়ির বানে যখন খালে চিতিকাঁকড়ার ঝাঁক লাল হয়ে ভেসে ওঠে, কি করে ধরা হয় দেখাতে নিয়ে যাওয়া, ধান কাটার পর বিলে পড়ে থাকা মাউসিপাতার হুঁকো বানানো সওব সওব নিষিদ্ধ কাজে বড়দের বকা থেকে বাঁচিয়ে এই রাঙাকাই তার মুশকিল-আসান।
একটা শর্ত আছে রাঙাকা র এক আধটা গোপন চিঠঠি মাঝেসাজে সুমিপিসির কাছে দিয়ে আসে রুনু, আর সেটা হাতে পেলে সুমিপিসির ফরসা গালটা আবীর লাল হয়ে যায়, মুখটা কেমন যেন দুগ্গাঠাকুরের গর্জন তেল মাখানো মুখের মতো চকচকে হয়ে যায়। রুনু এই ডাকপিওনের কাজটা ভালবেসেই করে, সুমিপিসির কাছে প্রতিবারই পাওনা হয় একটা ফেরত চিঠঠি, আর একটা লর্ডসের টফি, নরম মিষ্টি জেলি ঠাসা।
রুনুর কান্না পায় দশমীর দিন, যখন বিকালের ভাসানে গেরামভর লোকেরা ভিড় করে নদীপাড়ে, পাঁপড়, ফুলুরি, কাঠিগজার, ঘুঘনির দোকাল বসে পেট্রোম্যাক্স বা হ্যাজাক জালিয়ে।
যখন মাঝ নদীতে বিসর্জনের নৌকা বাইচ চলে অনেক গাঁয়ের প্রতিমার, ঐ নদীর ভেড়িতে দুপারেই অনেক লোকের ভীড়ের মধ্যেই রুনু কেমন যেন একলা হয়ে যায়, কেরোসিন মুখে নিয়ে আগুনখেলা নৌকোর উপর, ঢাকিদের দুলে দুলে তালবাদ্য, সপরিবারে মা দুগ্গাকে নিয়ে নৌকো র সাতপাক, কোন কিছুই আর রুনুর মনটাকে দোলা দিয়ে যায় না।
শুধু মনে হয় আবার এক বছর পর আসবেন মা তাঁর ছানাপোনাদের নিয়ে, সেই কবে বর্ষা শেষে গহীন বিলে ঘাই মারবে বড় ভেকুট মাছ, আঁশশেওড়ার ফুল ফুটবে ছাতিমফুলের তীব্র গন্ধ, এখানে উখানে ঝোপে-ঝাড়ে সাদা কাশফুলের গোছা দুলবে, আকাশটা যেন বেশি নীল আর তাতে পিঁজা তুলোর মত থুপা থুপা মেঘা ভাসবে, তবে না।
প্রতিবার বিজয়ার দিন প্রতিমা'র মায়ের মুখটা হঠাতই ঝুপ করে লুকিয়ে যায় নদীর জলে, দুই নৌকো র মাঝে, আর রুনুর কান্না পায়, রাঙাকাকে জিগ্যেস করেছিল, মা'কে বিজয়ার পরে আর রাখা যায় না ?
রাঙাকা বলেছিল দূর বোকা বিয়ে হওয়া মেয়েদের বেশিদিন বাপের বাড়িতি থাকতি হয়? কেউ যত্ন করবেনি। দ্যাখ না আমাদের তো কোজাগরী লক্ষী পূজো আছে, তাপ্পরে অমাবস্যায় কালি পূজো, বাজি ফাটাতে হবেনি।
রোশনাই নিভে যাওয়া দুগ্গোপূজো র প্যান্ডেলের এক পাশে মা লক্ষী আসবেন, কেমন যেন বিরাট জাঁকজমকের পর দুঃখিনী মায়ের পূজো। একাদশী থেকে একটা টিমটিমে প্রদীপ জ্বলে ম্যারাপ বাঁধা প্যান্ডেলে, মা লক্ষী র পথচেয়ে।
বাড়িতে ঢাকি বিদায়ের পর মা- কাকিমারা ব্যস্ত খুবই কোজাগরী লক্ষ্মী পূজোর আয়োজনে, লাল পদ্ম, খড়িমাটির আল্পনা, নূতন দুধ আসা ধানের শীষ, পূজোর বাসন ছিলে-তেঁতুল দিয়ে ঝকঝকে করে মাজা; কত রকমের নাড়ু বানানো, আনন্দনাড়ু, মুগের নাড়ু, তিলের, চিঁড়ের নাড়ু, নারকোলের তক্তি, ছাঁচ মিঠাই, গুড়ের মুড়কি, আরো কত্ত কি !!
রুনু দুধ-ঠাকুমাকে শুধিয়েছিল কোজাগরী পূজা কেন বলে এই দুগ্গোপূজো র পরে লক্ষীপূজোকে, ঠাম্মা বলেছিল নক্ষী ঠাকুর আসেন ঐ রেতে পিতিটা ঘরে দেখতে কে তাঁর পূজা করি জেগি আছে, গভীর নিশুতি রাতে, ওনার বাহন নক্ষী পেঁচায় চড়ে দুরগুম দুরগুম ভুতভতুম করে, তাই এই কোজাগরী পূর্ণিমার পূজা। গভীর রাতে যখন সাদা ফটফটে জ্যোস্নার আলোয় পরী ওড়া মায়াবী রাতে মা পরিক্ষে নেন মর্তের মানুষের। কে জাগে রে ? !! কে জাগে আমার অপেক্ষায় ?
রুনু ভাবে আমাদের ভারতবর্ষও আজ সেই লক্ষীদেবীর বর্ণময় ও অকৃপণ দানের অপেক্ষায়।
কিন্তু রুনুর মনে হয় আমরা কি সত্যিই জেগে আছি ? রুনু কাকে শুধোবে ? সাইকিল সারানো ইদ্রিস চাচা না স্টীমার জেটিঘাটে ফ্র্যান্সিস ভাইকে ?
সুমিপিসির বিয়ে হয়ে গেল গেলবার টাকিতে। পিসেমশাই হাসনাবাদে কাটা কাপড়ের ব্যবসা করে। সুমিপিসি কি আজও জেগে থাকে ? রাঙাকা কি বলতে পারে কে জাগে আজ ?
কোজাগরী রাতে কে জাগে রে ?
(C) সমরজিৎ জানা