এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  আলোচনা  রাজনীতি

  •  স্তব্ধ জনজীবনে ওরা যেন চলমান গতি।

    Saikat Mistry লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | রাজনীতি | ২৬ অক্টোবর ২০২০ | ৩২৮১ বার পঠিত
  • সন্ধ্যার আলো ফুটে ওঠে। অল্প অল্প করে বেড়িয়ে আসে ছেলে- মেয়ের দল। রঙীন প্রজাপতির মতো।দাঁড়িয়ে দেখি। আমার ভালো লাগে।আমার পূজা নেই।ধর্ম আফিমের মতো, মানুষের মাঝে ভেদাভেদ বাড়ায়- সেই কবে মনে হয়েছিল। তারপর পূজা চলে গেল।উৎসব- অনুষ্ঠানে জনগণের সাথে নয়, একটু এগিয়ে থাকতে হবে। অনেকটাই এগিয়ে থেকে জীবন থেকে উৎসবও চলে গেল। কিন্তু চোখের সামনে দিয়ে চলমান উৎসব চলে গেলে বেশ লাগে।



    দীর্ঘ সাতমাস মানুষের জীবনের সব রঙ চলে গেছে। অর্থনীতির ভাঁড়ে মা ভবানী দশা। লাখ লাখ অভিবাসী মানুষের যোজন পথ হাঁটা, নির্মম দুর্ঘটনার ছবি আজও চোখে ভাসে। লাগাতার টেলিভিশনের নানা চ্যানেলে ভয় দেখানোর  কারবারী কর্পোরেটি বিশারদ   কুল ভয় আর আতঙ্কের বীজ বুনেছেন( যারা নিজেরাই বহুজাতিক মহার্ঘ চিকিৎসা বন্ধও করে দিয়েছিলেন)। রাষ্ট্র তাতে সার জল দিয়েছে অহর্নিশ। না এতসবের পরও কোন ভয়ের মহীরুহ গজায়নি।বরং ভয়ের আলখাল্লা খুলতে শুরু করেছেন লোকজন। অবশ্য " আতঙ্কিত" হওয়ার জন্য যতটা এলিট হতে হয়, তেমন এলিট মানুষজন অবশ্য সিঁটিয়ে আছে। তা থাক। সরকারি ব্যবস্থায় যে চিকিৎসক বন্ধুরা রাত- দিন কাজ করছেন; জানি তাঁরা রাগকরবেন। কিন্তু জীবনের যে চলমান স্রোত জীবনের  বিচ্ছিন্ন অবরোধকে ধুয়ে দিয়ে বইতে শুরু করেছে- বলব যাই হোক না কেন, জীবন বড় মধুময়।


    সন্ধ্যা নামলে বাতাসে শীতের শিরশিরে ভাব। শিউলির হালকা গন্ধ আজও ভাসে।বহুমৃত্যু- মারী আমরা দেখেছি। আগামীতেও হয়ত আরও বেশি দেখব। তবু জীবনের গতি  থামেনা। সাত- আট থেকে হয়ত পঁচিশ- ত্রিশ ওদের বয়স। সন্ধ্যার আলো  জ্বলতে শুরু করলে ওরা পথ নামে। অনেকে মিলে দলবেঁধে। কেউ কেউ দুজনে। হাতে হাত ধরা এক রঙীন প্রজাতি যেন।অন্ধকার নামে। আলোছেড়ে অনেকেই একটু অন্ধকারে সরে যায়। অবরোধের এই সময়ে হয়ত এত কাছে ওরা আসেনি। একটু ঘনিষ্ঠ হতে চায় ওরা। জানি, হয়ত মাস্ক খসে কদাচিত অধরে অধরে মিলে যাবে।এটুকুই ওদের পাওয়া। হয়ত ছড়িয়ে যাবে বীজাণুর বীজ। আজ ওরা বেপরোয়া ।আজকাল বড় আলো চারিদিকে। অন্ধকারের পরিসর, কাছে আসার পরিসর বড় কম। অপ্রতুল  সরকারি আলো। তার মাঝে এটুকু অন্ধকার ওরা খুঁজবে, খুঁজেই চলবে।



     রাস্কিন বন্ড পড়তে পড়তে ভাবি - " Young couples,... It is good to see new love in full bloom.Not all of them will remain in love with each other, but today they are and it makes them all beautiful,  and fearless. "  প্রেমিক যুগল দের জীবনপাত্র থেকে উছলে ওঠে সুখী ভালোবাসা ( কেউ বলবেন, এতো ছেনালিপনা, নিছক যৌনতা। সন্ধ্যার শিউলি। ভোরে ঝরে যাবে।তা হোক)।  জানি চিরদিন এই ভালোবাসা থাকবে না। আজ আছে। তাই ওরা সুন্দর। কোন মহামারীর ভয় ওদের আটকে রাখতে নাচার।


    শ্রেণিগত অবস্থানে যারা নিচের দিকে তাদের উপস্থিত বড় কম। দীর্ঘ লকডাউনে জীবন তাদের জেরবার। অর্থনীতিও ক্ষয়াটে হয়েছে। তবু ওদের কয়েক জনের সাথে দেখা হয়। থাকবন্দী সমাজে দুর্গাপূজা কখনই সর্বজনীন ছিল না। ধনী রাজ- রাজরা আর জমিদারের অন্দরমহল থেকে এই পূজা বেরিয়ে এল দেড়দশক আগে। তাকে বারোয়ারী এবং সর্বজনীন রূপ পাওয়ার জন্য হাঁটতে হয়েছে অনেকটা পথল। এখন পূজাটুকু গেছে। উৎসবটুকু আছে। না হলে এতলোক সামিল হবেই বা কেন?


    রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকি।  অন্যবছরের থেকে  লোককম। বয়স মানুষকে ভীতু করে। কিন্তু এই যুবকরা ভয়হীন। ওরাই পথজুড়ে। জানি, ওরা প্যান্ডেল দেখে না, দশহাতওয়ালা কোন পুতুল দেখে না, ধর্মেও বড় একটা মতি নেই। ওরা নিজেরা নিজেদের দেখে। আমার অনেক সাথী বলবেন, জগৎ বিচ্ছিন্ন ওরা। বহুবছর এই সময়  পার্টির ' বুক স্টল ' করেছি। ইস্তহার সাজিয়ে চলমান ' জনগণেশের' দিকে উদ্ধত, গর্বিতভাবে  তাকিয়ে ভেবেছি - এরা  কি নির্বোধরে বাবা! আমরা তত্ত্ববোঝাই। অথচ স্থানুবৎ।  ওদের কিছু না থাক গতিটুকু আছে। স্ট্যালিন বলতেন, নেতা আসে নেতা যায়, জনগণ অমর। আজ কথাটা এই চলমান তরুণস্রোতের দিকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে টেরপাই।


    ওনামের পর কেরলে কত করোনা বাড়ল তার তথ্য আমরা জানি। চলমান উৎসবের পরও এখানে সংখ্যা হয়ত বাড়বে। ঠিক জানি না।মাসের পর মাস জীবনের থমকে যাওয়া স্রোতটা যদি শত বিপদের  মেঘের ছায়া ফেলেও  সচল হয়েও ওঠে - আমার বেশ লাগে। কুয়াশা নামে। রাত বাড়ে৷ ভীড় পাতলা হতে থাকে।


    "... they invite their friends from the city and have jolly party.The wind carries the muted sound...theirs is not a party I would join, but the thought of happy people in the neighbourhood puts me in a good moid.'( Ruskin Bond, A book of simple living)  - এই হুল্লোর আমাদের মতো মানুষদের জন্য না। শীতার্ত বাতাস তাদের খুশির বার্তা বয়ে আনে।আশেপাশে খুশি- সুখী মানুষ থাকলে মন ভালো হয়ে যায়।


    হিসেবী মানুষরা এই ' বেপরোয়া ' স্রোতকে বাপান্ত করি। আতঙ্কিত হই। গাণিতিক হিসেবের খাতা খুলে মহামারীর আঁক কষি। জীবন গতিময়। গনিতের চেয়েও দুর্বার গতিতে বয়ে যায়। 


    লকডাউনে অনেকের কাজ নেই। যেটুকু আছে তাও সঙ্গীণ। গত কয়েকমাসে যৌনকর্মীরা একেবারে বসা। ভদ্দরবৃত্তের যাপনে তাদের যে খোঁজটুকু রাখতে হয়, সেটা মনেই আসেনা। অথচ, এই সময়ে অনেকেরই যোনতার হাতেখড়ি হয়। এবার কি হল, হচ্ছে, হবে জানি না৷ তারাই বলতে পারবে। এটা তো এক্সপ্লয়টেশনের পক্ষে ওকালতী। বন্ধুরা ভাববেন অনেকে।হ্যাঁ শ্রেণিবিভাজিত সমাজে সকলেই শোষিত। মানদা দেবীর " শিক্ষিতা পতিতার আত্মচরিত " পড়ার পর ভাবি,  সরলীকৃত শোষণের এই তত্ত্ব কথা কত জোলো, মনস্তাত্ত্বের গভীরে কোথায় এর বিচরণ  তা তারাই জানেন। আমরা অনুমান করতে পারি মাত্র। 



    পথ চললে আরও নানা দৃশ্য চোখে পড়ে। দলীয় স্টলগুলোয় প্রাগৈতিহাসিক যুগের স্বল্পালু রক্তিম সাথীরা আজও ইস্তেহারে চোখ গুঁজে। একদিন ওখানে বসে চলমান " জনগণেশ" কে ছায়াময় মনে হত। আজ বুঝি ওরা হাঁটছে, চলছে, সজীব, সতেজ অস্তিত্ব। মহামারীর থমকে যাওয়া জনজীবনে ওরাই একটা প্রবাহ। 


    জানি, চিকিৎসক বন্ধুরা বকা দেবেন। সে দিক গে। রাত বাড়ে। জনস্রোত পাতলা হয়।


    ছেলে মেয়েটির হাতে হাত।ওরা বিভোর হয়ে হাঁটছে।  পিচবাঁধানো রাস্তায় দাঁড়িয়ে  দুজন পুলিশ। একজন  এগিয়ে এসে  লাঠিহাতে হাঁকছে - তাড়াতাড়ি। রাত বেড়ে চলছে। জলদি চল। তবু ওরা মশগুল। মহামারীর মহাময় স্তব্ধতার জনজীবনের বুকের উপর দিয়ে গতিময়তার  বার্তা দিয়ে হেঁটে হেঁটে  ওরা চলে যাচ্ছে।

     
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যুদ্ধ চেয়ে মতামত দিন