।। *অন্য এক পূজোর পাঁচালী* ।।
সমরজিৎ জানা
কোভিডকালে একরাশ শিউলি ফুলের গন্ধ হঠাতই ভেসে এল। মাছের ভেড়ি, নদীবাঁধে ঘেরা বাদাবনে বড়োপূজোর বাজনা প্রতিবারই যেন বেসুরো বাজে, কোনবার আয়লা, কোনবার আমফান, কোনবার বাঁধ ভাঙ্গা বৃষ্টি, হিঙ্গলগঞ্জের, মামুদপুরের, বায়লানীর পূজো কে সর্বদাই অন্যরকম বুভুক্ষুপীড়িত করে রাখে। এবার আবার কি এক ছোঁয়াছুঁয়ি অসুখ এসেছে, দুগ্গা দেখেছে ভেড়ির উপর যে বাবুরা পলিথিনের প্যাকেটে করে চাল ডাল আলু সয়াবিন এর নাগেট দিতে আসে, তারা বলে নাকে কাপড়টা দেবেন টোকেন নেওয়ার সময়। এই টোকেন এক আশ্চর্য সাত রাজার মানিক ধন, থাকলে মা পাবে রেশন, নইলে ফক্কা। এখনো গ্রামের মধ্যে পুরনো বাড়িটার চাল নেই, আমফানে উড়ি গ্যাছে, বাপটা পঞ্চাইত থেকে একটা তেরপল পেয়েছিল বটে, কিন্তু বাড়িটা পুরোটা ঢাকবেনি।
তাই দুগ্গারা সিমেন্টের বাঁধের নীচেই ই তিরপল টানিয়ে দড়ি দড়া বেঁধি ই ঘর বানিয়েছে। রোজ সকাল হলেই নদীর দিকে চেয়ে থাকে দুগ্গা , ভটভটি এলে সবার আগে প্লাস্টিকে মোড়া টোকেনের কাগজ নিয়ে দৌড়তে হবে যে।
দুগ্গা পরাণের ইস্কুল বন্ধ, দুপুরির খাওয়াটাও। কেন কে জানে ?
পরাণের আবার অন্য আরেক কাজ পাশের বাঁওড়টা জলে ভরা, তাতে রুপোলি কাজলি পুঁটি, মৌরলা চকচক করে ওঠে, সেই চটা চটা পুঁটি, মৌরলা আর কাদা ছেঁচে গুলে মাছের পিছনে পড়ে থাকে সব্বোক্ষন। এবারে বড়ো পূজোও হবেনি শুনছে, গতবারেও অষ্টমী, নবমী তে খিচুড়ি খেইছিল পাত পেড়ে প্যান্ডেলের পিছনে। কি তার স্বোয়াদ। বড় পূজো আসে, বাপটা ঢাক বাজাতে যায় বসিরহাটে, পরাণও চলে বাপের সাথে কাঁসি নিয়ে। চার পাঁচ দিন কেটে যায় স্বপনের মতন, বাপটা পূজোর শেষে ট্যাহা পেলে কেনে মা'র শাড়ী, দুগ্গা র ফ্রক ইজের আর পরাণের জামা হাফ পেন্টুল হিঙ্গলগঞ্জে র আড়ত থেকে। পূজোর পর বিদাই, ঘরে ঘরে ঢাক বাজায়, ট্যাহা পায়, চাল আলু পয়সা সিধাও পায়, এবার তো বায়নাই হোল না, বাপটা ঢাক নিয়ে বসে আছে এখনও নদীর দিকে তাকিয়ে, ছাইতেও পারিনি বায়নার টাকা নেই।
কি একটা অসুখ এয়েছে যেন, ভেড়িতে আসা ভটভটি চাল ডালের সয়াবিন এর সাথে আকাশ নীল কাপড়ে র গার্ডার দিয়া নাক মুখ ঢাকার মাসক দিয়ে গেছে তিনবার । পরান উতে পয়সা বেঁধে রাখে।
তবুও বড়োপুজো আসছে দুগ্গা পরাণ বুঝতে পারে, শাপলা ফুটছে, দৈয়ের বিলে সিঙারাফল ও হ্চছে, কত লোক ডুব দিয়ে তুলছে, দুই কুড়ি তুলতে পারলে ইজারাদার দশ ট্যাহা দেয়, পরাণের বাপটা মানা করে, বলে অত জলে পড়ে থাগলি সান্নিপাতিক ব্যামো হবে, ওষুধ কোথায় পাবে, তাই পরাণ মাছ ধরে, পুঁটি,খলসে, পায়রাচাঁদা, গুলে, মা তাতেও রাগ করে, রাঁধার তেল কই ?
রোদ নরম সোনাপানা হইছে, আকাশটা নীল, মাঝ রেতে মায়ের আঁচলটা গায়ে জড়ায় দুগ্গা, নদীর ভেড়ির নীচে সাদা সাদা কাশফুলও ফুটছে, শিউলি ফুলে ভরে গেছে ইস্কুলবাড়ির গাছটা, মন কেমন করা শিউলি গন্ধ পায় দুগ্গা রোজ ভোর রাতে, কোঁচড়ভরে তুলেও আনে কোন কোন দিন, মা রাগ করে ফেলে দেয় ঝাঁটিয়ে, প্যাটে ভাত নাই, বড়োপূজার আগজনী।
দীনালী জ্যেঠা আর তার ছেলে পরিদাদা পাঁচ মাস আগে ফিরে এইছিল গাঁয়ে, উদিকপানে কুথায় কাজ করত বম্বে না কেরালায়, বলল আর গেরাম ছেড়ে যাবেনি, ইখানেই কাজ করবে, নাহয় মীন ধরবে, গত সপ্তাহেই তারা চলি গেল আবার, এখানে প্যাট চলবেনি। মীনের দাম পাওয়া যাচ্ছে না হাসনাবাদের আড়তি।
কেন কে জানে ??
দুগ্গার মনে পড়ে একবার বছর তিনেক আগে হিঙ্গলগঞ্জে পূজো প্যান্ডেলের পাশে ম্যারাপ বেঁধে ফটফটিয়া ছিনিমা তে দেখেছিল "ভূতের রাজা দিল বর। জবর জবর তিন বর।"
রেতেরবেলা গাঁয়ের পরে বিলের ধারে ঝুপসি হিজলগাছটার পাশে বাঁশবনে দুগ্গা যায় মাঝেমধ্যে ই, যখন শন শন করে বাতাস চলে, বাঁশঝাড়ে শব্দ হয় ক্যাঁইচকোঁউচ, গা ছমছম করে দুগ্গার; যদি দেখা হয়ে যায় ভূতের রাজার সঙ্গে তাহলে চাইবে এই বর - "পৃথিবীটাকে ভালো করে দাও ভূতের মহারাজা, বাপটা আবারও যেন কাজ পায়, বায়না হয় আবারও, ভেড়ির উপরে ঠায় না বসি থাকতে হয় সব্বোক্ষন, দীনালী জ্যেঠা পরিদাদারা থাকুক ইখানেই; বড়োপূজা হোক, বড়োমা আসুক সব্বাইকে নিয়ে।"
*মা, তোমার হাত বুলিয়ে দাও পৃথিবীর মাথায়।*